বিশেষ গুরুত্বের জাতীয় ক্রিকেট লিগ

আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ মাত্রই একটি মাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। সেখানে জয়ের আশা করলেও উল্টো পরাজয়ের বেদনায় নীল হতে হয়েছে সাকিব আল হাসানের দলকে। ২২৪ রানের বড় ব্যবধানে পরাজয় আরও একবার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ এগোনোর পরিবর্তে বরং পিছিয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। সেই ভাবনা থেকেই এবারের জাতীয় ক্রিকেট লিগ পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। অক্টোবরের ৮ তারিখেই শুরু হচ্ছে দেশের ‘প্রথম’ শ্রেণির এই প্রতিযোগিতা। 

টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রার কয়েক বছর আগে থেকেই দীর্ঘ পরিসরের এই লিগের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু শুরুর সময়ে যেভাবে গুরুত্ব পেত এখন সেই গুরুত্ব কিছুটা কমে গেছে অনেকাংশে। জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই এখন আর এই লিগ খেলতে চান না। নানারকম বাহানা আপত্তি দেখিয়ে এই লিগ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা খেলায়াড়রা। যার প্রভাব দীর্ঘ সময়ের জয় পড়েছে দেশের ক্রিকেটে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। হাতে যথেষ্ট সময় থাকার পরও এখানে না খেলার প্রভাব এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। শুধু আফগানিস্তান কেন পাঁচ দিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে উন্নতির কোনো ছাপই পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেদের মাটিতে খেলা হওয়ার পরও রাসেল ডেমিঙ্গোর শিষ্যরা কোনো প্রভাবই বিস্তার করতে পারেনি। এমনকি একটা সেশনও রশিদ খানের দলকে চেপে ধরতে পারেনি তামিম ইকবাল ছাড়া বাংলাদেশ দল। ম্যাচটি পাঁচ দিনে গড়ানোর কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে বেরসিক বৃষ্টি। যদিও এই বৃষ্টিই আবার বাঁচাতে চেয়েছিল বাংলাদেশকে। রীতিমতো ব্যাট হাতে পঞ্চম দিনের প্রায় পুরোটা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল; কিন্তু যে আঠারো ওভারের মতো খেলা হলো সেটাই ঠেকাতে পারল না ব্যাটসম্যানরা। অনেকটা দিকভ্রান্ত নাবিকের মতোই ম্যাচটা বড় পরাজয় হয়। 

অথচ স্বাগতিক দল হিসেবে যতটা সুবিধা নেওয়ার তার কিছুই নিতে পারেনি বাংলাদেশ। টেস্ট খেলার যে মানসিকতা প্রয়োজন তার কোনোটিই দেখা যায়নি। এরপরই দেশের ক্রিকেট কাঠামো নিয়ে ভাবনা চলে আসে ক্রিকেট কর্মকর্তাদের মধ্যে। কেউ কেউ তো বলেই ফেলেন দেশের ক্রিকেট কালচারটাই এখন আর টেস্ট ক্রিকেটবান্ধব নয়। সাদা পোশাকের ক্রিকেটটা যে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কাছে গুরুত্ব পায় না সেটি একরকম পরিষ্কারই। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া কিংবা অনেক দূরে থাকা ক্রিকেটাররাই মূলত খেলে থাকেন এখানে। বলা যায়, লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চাপানোর ভাবনা যাদের নেই তারাই জাতীয় লিগ খেলে থাকে। ম্যাচ ফি বাড়িয়েও এর গুরুত্ব বাড়ানো সম্ভব হয়নি। সে কারণে ‘পিকনিক ক্রিকেট’ হিসেবেও এই লিগকে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। 

অনেক সময় আবার ক্রিকেট বোর্ডের কাছেও সেভাবে গুরুত্ব পেত না এটি। সে কারণে কিছুটা বিলম্বে হলেও বোঝা গেছে এর গুরুত্ব। টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটের দৌরাত্বের কারণে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সাধারণের ভাবনাটা এখন অনেকটাই দূরে সরে গেছে। তবে সর্বশেষ অ্যাশেজ সিরেজে অষ্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মধ্যকার তৃতীয় টেষ্টে বেন ষ্টোকসের অসাধারণ ১৩৬ রানের ইনিংসটি আবারও সবচেয়ে পুরনো ফরম্যাটের এ ক্রিকেট যে এখন কতটা গুরুত্বের সেটা বোঝা গেছে।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) দিয়ে কুড়ি ওভারের ক্রিকেট মানুষের বিনোদনের অংশ হয়ে গেছে। দুনিয়াজুড়েই এখন জোয়ার চলছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। সে কারণেই এখন বিপিএল যতটা গুরুত্ব পায় ততটা পায় না জাতীয় লিগ। তবে যে ভারত টি-২০ ক্রিকেটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে তারাই কিন্তু বেশি গুরুত্ব দেয় তাদের রনজি ট্রফিকে। সেটি আবার কয়েক স্তরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ‘এ’ দল কয়েক মাস আগে সেরকম একটি সংস্করণে খেলে এসেছে। মমিনুল হক সৌরভের নেতৃত্বাধীন দলটি যদিও ফাইনালে খেলতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশে যে জাতীয় লিগ হতে পারে টেস্ট ক্রিকেটের আদর্শ প্রস্তুতি, কিন্তু সেই আসরের গুরুত্ব নেই। ক্রিকেট বোর্ড বারবার অনুরোধ করে খেলোয়াড়দের দিয়ে গুরুত্ব বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এবার যেন অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে সামনেই ভারত সফর রয়েছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ক্রিকেটের দেশে যাবে বাংলাদেশ দল। 

জাতীয় লিগ দিয়ে বিরাট কোহলির দেশে যাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবেন মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবালরা। জানা গেছে জাতীয় দলে খেলা প্রায় সব ক্রিকেটারই এবার খেলবেন জাতীয় লিগে। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল) খেলার কারণে শুরুতে থাকতে পারছেন না এই লিগে। পাশাপাশি অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ইনজুরির জন্য খেলতে পারছেন না। বিশ^কাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে খেললেও এখন বিশ্রামে থাকা তামিম এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এই লিগকে। যে কোনো ক্রিকেটারের জন্যই এবার পুরো ফিট হয়েই খেলতে হবে জাতীয় লিগ। কোনো আনফিট ক্রিকেটার এবার খেলার জন্য বিবেচিত হবেন না।

২১তম জাতীয় ক্রিকেট লিগ এবার তাই বিশেষ গুরুত্বের। নভেম্বরে ভারত সফরের আগে এখানে খেলে নিজেদের প্রস্তুতি সারবেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। জাতীয় লিগে ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করছেন নির্বাচকরা। এরকম প্রতিশ্রুতি এর আগে দিলেও এবার জাতীয় লিগে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণে কঠোর হচ্ছে বিসিবি। সিনিয়র ক্রিকেটাররাও ফিরতে মরিয়া জাতীয় লিগে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ জানালেন, ‘আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের শেষ দিন যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন আমরা এনসিএল নিয়ে কথা বলছিলাম। কে কোন দলে খেলবে, কার খেলা কোথায়। আমার মনে হয় সবাই খেলবে এবং পারফর্ম করার চেষ্টা করবে। আমরা সবাই কমবেশি সিরিয়াস জাতীয় লিগ নিয়ে। 

আমরা ক্রিকেট খেলতে চাই সেটা জাতীয় ক্রিকেট লিগ হোক, বিসিএল হোক, যেহেতু এটা আমাদের জন্য অনেক বেটার।’ ২০১৫ সালে তামিম, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ শেষবার জাতীয় লিগ খেলেছিলেন। তামিম চার ম্যাচ, মাহমুদউল্লাহ পাঁচ ও সাকিব মোটে এক ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে মুশফিকুর রহিম খেলেছিলেন এক ম্যাচ। বিসিবির ইচ্ছা ভারত সফরের আগে জাতীয় লিগের দুই রাউন্ডে অংশ নিক ক্রিকেটাররা। টেস্ট ক্রিকেটাররা খেলতে পারবেন তিন রাউন্ড। ৩ নভেম্বর টোয়েন্টি-২০ দিয়ে ভারতে বাংলাদেশের মিশন শুরু হবে। পরের দুটি টোয়েন্টি-২০ ৭ ও ১০ নভেম্বর। ১৪ নভেম্বর ইডোনে শুরু হবে প্রথম টেস্ট। দ্বিতীয় টেস্ট হবে ইডেন গার্ডেনে ২২ নভেম্বর থেকে। লম্বা বিরতি শেষে মাঠে নামার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তামিম। 

সিপিএলে গেলেও সাকিবের নাম আছে খুলনার ৩০ জনের স্কোয়াডে। আছেন দুই বছর আগে সর্বশেষ জাতীয় লিগ খেলা মাশরাফি বিন মুর্তজাও। তবে সাকিব সিপিএল থেকে সরাসরি ভারতের সফরের প্রস্তুতি ক্যাম্পে যোগ দেবেন। মাশরাফিরও খেলার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া খুলনা বিভাগের প্রাথমিক স্কোয়াডে সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ মিঠুন, মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, রুবেল হোসেনসহ তারকাদের প্রায় সবাই আছেন। মুশফিক-মাহমুদুল্লাহরাও নিজ বিভাগের হয়ে খেলবেন। বিসিবি চাইলেও জাতীয় দলের সব তারকাকে জাতীয় লিগে পাবে না। ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে রয়েছেন টেস্ট দলের মুমিনুল হক, মেহেদি হাসান মিরাজ, সৌম্য সরকার ও সাদমান ইসলাম। এ ছাড়া বিজয়, জহুরুল, নুরুল হাসান, আবু জায়েদ, সানজামুল, নাজমুল হোসেনরা রয়েছেন শ্রীলঙ্কা সফরে। তামিম যেমন এই লিগ দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করবেন পাশাপাশি সিনিয়র ও বর্ষীয়ান আবদুর রাজ্জাক কতটা কার্যকরী সেটিও প্রমাণিত হয়ে যাবে এবার।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //