যাত্রাশিল্পে দুর্দিন

বাংলা সংস্কৃতির পুরনো ঐতিহ্য যাত্রাপালা। এক সময় মানুষের বিনোদনের অন্যতম উপাদান ছিল এটি। শীত এলেই গ্রামগঞ্জে বসতো যাত্রার প্যান্ডেল। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক থেকে সামাজিক পালার কদর বেড়ে যেত এই সময়ে।

দূর-দূরান্ত থেকে দর্শক আসতেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, সোনাবান, গাজীকলি চম্পাবতী, মহুয়া সুন্দরী কিংবা রূপবানের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গল্পের পালা দেখতে। প্রিয় শিল্পীদের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরতেন তারা। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাপালারও পরিবর্তন ঘটে। আকাশ সংস্কৃতির গ্রাসে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের এই ঐতিহ্য। 

অশ্লীলতাসহ নানা অভিযোগে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিনোদনের এই অন্যরকম মাধ্যমটি। যাত্রার মূল উপাদান তাতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না বলে প্রবীণ শিল্পীরা নানা সময়ে মন্তব্য করেছেন। নামকরা পালাগুলো ভেঙে যায়। শিল্পীরাও বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েন।

তবে কেউ কেউ এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন। অপেক্ষায় রয়েছেন সুদিনের। তাদের চেষ্টা ও সরকারের সহযোগিতায় আবার সুদিন ফিরতে শুরু করেছে যাত্রায়। জাতীয় পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দলগুলোও নতুন পালার উদ্যোগ নিয়েছে। 

গত বছর পুরনো পালার পাশাপাশি নতুন নতুন পালার উদ্বোধন হয়েছে। ছিল মামুনুর রশীদের দ্বীপের নাম আন্ধার মানিক, মিলন কান্তিদের এক যে ছিলেন মহারানি ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে, আমিনুর রহমানের জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি অবলম্বনে শ্যামল দত্তের পালা, প্রাচীন যাত্রাপালা সোহরাব-রুস্তমের আধুনিক সংস্করণ; এ ছাড়া কবি আল মাহমুদের রচনা নিয়ে কতো দূর এগোলো মানুষ নামে একটি নতুন পালা মঞ্চায়ন করেছে স্বরূপকথা যাত্রা সংগঠন।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্বাচন করে জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে পালাগুলোর নির্মাণ ও মঞ্চায়ন কার্যক্রম শেষ হতে যাচ্ছে।

যাত্রাশিল্প নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির এসব কার্যক্রম যাত্রাশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘যাত্রাশিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য ৬৪টি জেলায় ৬৪টি দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনীর আয়োজন এবং প্রতিটি জেলায় যাত্রাপালা পরিবেশনের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিবন্ধিত যাত্রাদল দেশ অপেরা, লোকনাট্য গোষ্ঠী ও জয়যাত্রাকে নতুন দেশীয় যাত্রাপালা নির্মাণ ও প্রদর্শনীর জন্য এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে’

যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে বলেন, ‘এর ফলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচবে আমাদের এই যাত্রাশিল্প। এখনো যাত্রাপালা পরিবেশনে স্থানীয় প্রশাসন বাধা দেয় কিংবা অনুমতি দিতে গড়িমসি করে। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, যাত্রাপালায় কোনো প্রকার অশ্লীলতা হয় না। তবে যাত্রা শুরুর আগে কোনো কোনো এলাকার আয়োজক কমিটি যাত্রামঞ্চে অশালীন নৃত্যগীতের আয়োজন করে থাকে। এই নৃত্যের জন্য বাধ্য করেন স্থানীয় গডফাদার ও প্রভাবশালীরা। অতীতে এমন অজুহাতে যাত্রাশিল্প বন্ধের নানা অপচেষ্টা করা হয়েছে। এ যেন মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //