নিউইয়র্ক নির্বাচনে লড়ছেন সর্বোচ্চ বাংলাদেশী অভিবাসী প্রার্থী

জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনা পাল্টে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যপট, বদলে দিচ্ছে ঘটনার গতিপথ।  এপিসেন্টার নিউইয়র্কে লকডাউন উঠানোর মাত্র প্রথম সময় চলছে। কিন্তু শহর জুড়ে প্রতিবাদের মিছিল দেখলে বলার উপায় নেই কদিন আগেও এই শহরবাসী করোনাভাইরাসের আতঙ্কে গৃহবন্দী ছিলো।

করোনা আতঙ্ক, বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদের মিছিল, পাশাপাশি ঘনিয়ে আসা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনী আমেজ, সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরগরম।

আর এই নির্বাচনী লড়াইয়ে বিভিন্ন পদে শরিক হওয়ার জন্য এবার লড়ছেন সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশী-আমেরিকান প্রার্থী। জুন মাসের ২৩ তারিখের প্রাইমারীতে নির্ধারিত হবে তাদের মধ্যে কারা নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নিজ দলের প্রার্থী হবেন।

বাংলাদেশীরা যুক্তরাষ্ট্রে মূলত আসতে শুরু করে আশির দশকে। ১৯৭১-পরবর্তী সময় থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭৩-এ যে সংখ্যা ছিলো ১৫৪, ১৯৭৬-এ ৫৯০, সেই সংখ্যা ১৯৮০ সালে এসে দাঁড়ায় ৩,৫০০ জনে।

যুক্তরাষ্ট্রে এখন কয়েক লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছেন, যার মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশী-আমেরিকান বাস করেন নিউইয়র্ক শহরে।

নিউইয়র্ক শহরে এখন এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী-আমেরিকান থাকা স্বত্বেও সিটি কাউন্সিলে তাদের কোনো সরাসরি প্রতিনিধি নেই। এবার শহর জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আটজন বাংলাদেশী-আমেরিকান, যা এ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক।

মৌমিতা আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন যখন বয়স আট বছর। বাবা কাজ করেন একটা প্যাকেজিং মেডিসিন ফ্যাক্টরিতে। মৌমিতা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়ালেখার পাশাপাশি সমাজসেবা মূলক কাজের সাথে জড়িত।

মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে বাবা মার এমন স্বপ্ন থাকলেও মৌমিতাকে সমাজ-সেবা, রাজনীতিই টেনেছে। বার্নি স্যান্ডার্সের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। স্বপ্ন দেখছেন অভিবাসীদের নানা সংকট এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন, যদি ডিসট্রিক্ট লিডার হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান।

যুক্তরাষ্ট্রে এসে পারফিউম ওয়ার হাউজে কাজ করেছেন জয় চৌধুরী। সেখানে ভারী বাক্স উঠা-নামা করাই ছিলো তাঁর প্রথম কাজ। তিনি বলে, আমি যে কাজ করেছি তা সুঠাম কৃষ্ণাঙ্গও এক সপ্তাহের বেশি করতে পারতো না। তিনি ট্যাক্সি চালাচ্ছেন নয় বছর ধরে। জয় চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে দুইবার ৬০ হাজার স্টুডেন্টের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভর্তি ফি কমানোর জন্য গভর্নর অ্যান্ড্রো কুমোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এবার তিনি নিউইয়র্কের বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস্, এমহার্স্ট, উডসাইড এলাকায় অ্যাসেম্বলি ডিসট্রিক্ট ৩৪ থেকে নির্বাচন করবেন।

বাংলাদেশী তরুণ অভিবাসীরা রাজনীতিতে এগিয়ে এলেও পথটা তাদের মসৃণ নয়। জয় বলেন, এখানে পথ দেখানোর কেউ নেই, কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি অভিভাবক নেই যারা তাদের গাইড করতে পারেন। উল্টো আমাদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এখানে হিসপানিকরা আছেন, বা যারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তারা ডমিনেট করতে চায়।

এখানে বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে বিরাজমান বিভেদও বাংলাদেশী-আমেরিকান স্থানীয় রাজনীতিবিদদের জন্য একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এখানেও বাংলাদেশের চিরাচরিত আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ছায়া। কোনো প্রার্থী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অপছন্দের দলের সমর্থক হলে তাকে অনেক সময় ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন কমিউনিটির সদস্যরা।

এর পাশাপাশি আছে বাংলাদেশী কমিউনিটির ভোট দেবার ব্যাপারে উৎসাহের অভাব। এশিয়ান আমেরিকান এ্যান্ড প্যাসিফিক আইল্যান্ডার (এএপিআই)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়ান আমেরিকানরা তুলনামূলক ভাবে ভোট দেন কম।

২০০০ থেকে ২০১০ সালে ঠিক হিসপানিকদের পরেই ছিলো এশিয়ানদের বৃদ্ধির হার, যেখানে হিসপানিক জনসংখ্যা বেড়েছে ৪৩.০ শতাংশ, এশিয়ানদের বৃদ্ধি হয়েছে ৪২.৯ শতাংশ।

এশিয়ান আমেরিকানরা ভোটার ব্লক হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে এশিয়ানরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছেন। ইকুয়ালিটি ইনডিকেটর-এর পরিসংখ্যান বলছে, নিউইয়র্ক সিটিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে এশিয়ানরা ভোট দিয়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ, যেখানে সংখ্যাগুরু সাদা ভোটারদের পরিমাণ ছিলো ২২ দশমিক ৩ শতাংশ ও কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার ছিলো ২১ দশমিক ৩ শতাংশ।

পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপ অনুযায়ী, এশিয়ান ভোটারের সংখ্যা কম হবার পেছনে একটি বড় কারণ ভোটারদের অতিরিক্ত ব্যস্ততা হলেও, সমর্থকদের মতে এর পেছনে কারণ হলো কমিউনিটির প্রতি রাজনীতিবিদ ও প্রার্থীদের কম মনোযোগ। স্পষ্টতই বোঝা যায় বাঙালী কমিউনিটির ভেতরে ঐক্যের এক ধরণের অভাব আছে।

অথচ প্রার্থীদের দিকে তাকালে অন্যরকম দৃশ্য দেখা যায়। নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।

ঝাল নাম শুনেই মনে হয় এটা ঝাল-মুড়ির দোকান। কিন্তু না, ঝাল বাঙালী অভিবাসীদের ক্ষমতায়নের জন্য নির্মিত একটি সামাজিক উদ্যোগ। ঘরে থাকা মায়েদের ও নতুন ইমিগ্রান্টদের চাকরি দিয়ে এবং তারা ভবিষ্যতে যা করতে চান, সেভাবে তাদের প্রস্তুত করে থাকে ঝাল এনওয়াইসি।

ঝাল এর উদ্যোক্তা মাহফুজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে হার্ভার্ড থেকে মাস্টার্স করেছেন। অংশগ্রহণমূলক বাজেট, গৃহহীনদের সংকট, স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি কলেজগুলোতে ফ্রি পাবলিক শিক্ষা ইত্যাদি দাবী নিয়ে তিনি এসেম্বলি ডিসট্রিক্ট ২৪-এ প্রার্থী।

বাংলাদেশী-আমেরিকানদের বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অনেক বাংলাদেশী ভোটারের প্রাইমারীতে ভোট দেবার যোগ্যতা না থাকা। আইন অনুযায়ী প্রাইমারীতে ভোট দিতে হলে ভোটারকে সেই দলের রেজিস্টার্ড হতে হবে। নিউইয়র্কে এশিয়ান আমেরিকানদের ৫৯ শতাংশ রেজিস্টার্ড ডেমোক্রেট, ১২ শতাংশ রিপাবলিকান, ২৭ শতাংশের বেশি ভোটার কোনো দলে নথিভুক্ত না। এছাড়া বাংলাদেশী অভিবাসীদের একটা বড় অংশ ভোটারই না।

বছরের পর বছর ধরে কষ্টার্জিত অর্থ থেকে ট্যাক্স দেবার পরও এদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কণ্ঠ নেই, কোনো অধিকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী নাগরিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ মিউনিসিপাল বা প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না।

সীমিত ফান্ড, নিজেদের কমিউনিটির সচেতনতার অভাব থাকলেও নিজেদের নির্বাচনী অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। মেরী জোবায়দা। যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এমন এক সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছিলো ইসলামোফোবিয়া। এগিয়ে যাওয়ার জন্য কালো বোরখা তাঁর জন্য কোনো বাঁধা হয়নি। নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়েই এগিয়েছেন।

জোবায়দা কাজ করতে চান বর্ণবৈষম্যহীন নিউইয়র্কের জন্য - যেখানে সবার সমান অধিকার আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

জোবাইদা এসেম্বলি ডিসট্রিক্ট ৩৭-এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৯৮৫ সাল থেকে একটানা নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি মেম্বার ক্যাথি নোলানের বিরুদ্ধে। বিজয়ী হলে তিনি হবেন প্রথম বাংলাদেশী-আমেরিকান অ্যাসেম্বলীওমেন।

নিউইয়র্কে প্রার্থীদের সবাই ডেমোক্রাট প্রগ্রেসিভের পক্ষে লড়াই করছেন। বার্নি স্যানডার্স প্রেসিডেন্সিয়াল প্রার্থিতার দৌড়ে হেরে গেলেও ব্যালটে আছেন এবং তাঁর সমর্থকরা বিশ্বাস করেন যে অধিক সংখ্যক প্রগ্রেসিভ প্রার্থী বিজয়ী হলে বার্নির সমর্থন পেতে তাঁর প্রস্তাবিত নীতির সাথে সমঝোতা করেই এগুতে হবে জো বাইডেনকে।

কালোদের অধিকার সর্বোপরি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ের সাথে শুরু থেকেই এবারের প্রার্থীরা শরিক হয়েছেন। মানবাধিকার সমুন্নত একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছেন তারা, যেখানে কেউই নিগৃহীত হবেন না।

কংগ্রেস প্রার্থী সানিয়াত চৌধুরী লিখেছেন, আমার প্রতিপক্ষ গ্রেগরি মিক্স হলেন ভোক্তা সুরক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাব কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি কভিড সংকটের সময় আবারও বড় ব্যাংকগুলোকে বেইল আউট করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন না এসেনশিয়াল কর্মীদের জন্য ঝুঁকি-বেতন এবং পিপিই সরবরাহ করা জরুরী।

সানিয়াত প্রাইমারীতে মনোনয়ন পেয়ে নভেম্বরে বিজয়ী হলে হতে পারেন হানসেন হাশিম ক্লার্কের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী-আমেরিকান কংগ্রেসম্যান। ডেট্রয়েট-এ জন্ম নেয়া ক্লার্কের বাবা এসেছিলেন সিলেটের বিয়ানী বাজার থেকে, আর মা ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান।

নিজস্ব কমিউনিটির দাবি তুলে ধরতে নিউইয়র্কে বাংলাদেশী-আমেরিকানদের নির্বাচনী যুদ্ধে শামিল হওয়ার গল্প নতুন না, সফলতার ইতিহাসও আছে। উনিশ'শ আটা-নব্বই সালে ডেমোক্রাট প্রাইমারীতে কুইন্স কাউন্টির ডেমোক্রাট অর্গানাইজেশনের সমর্থন ছাড়াই ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে আট বছর ধরে স্টেট সিনেটের পদে থাকা সিনেটর ফ্রাঙ্ক পাদাভানকে পরাস্ত করে মোরশেদ আলম উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন।

দুই হাজার সালেও বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকলেও ডেমোক্রাট কুইন্স কাউন্টি মেশিন তাঁকে অনুমোদন না দেয়ায় তিনি পিছিয়ে যান। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা, ক্রমবর্ধমান নতুন অভিবাসী, নতুন নাগরিক এবং নয়া ডেমোক্রাটদের কথা বিবেচনা করে তাঁকে নিউ আমেরিকান কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়, যাকে মোরশেদ আলম মনে করেন নিউ আমেরিকানদের জন্য একটা স্বীকৃতি।

বিগত ২০ বছরে এই নতুন আমেরিকানদের টিকে থাকার লড়াই পরিণত হয়েছে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে।-বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //