পৃথিবীর পথে বুদ্ধদেব বসু

পৃথিবী নিয়ে ভাবনা কবিদের এক প্রিয় বিষয়। শিল্পের বীজ মানসলোকে রোপিত হলেও পৃথিবীর পথ পরিব্রাজন করেই তৃপ্ত হয় শিল্পী মন। সে পথকে ম্যাক্সিম গোর্কি যেভাবে দেখেছেন বাংলার কবিসত্তার অনুভব তার থেকে অনেকটাই আলাদা। আবার আদিযুগ, মধ্যযুগ, রোমান্টিক যুগ অথবা আধুনিক কবিতায় তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ নয়। অগ্রজ কবিদের প্রভাব পরবর্তীদের রচনায় থেকে যায়। কিন্তু সমসাময়িকদের কিছু শব্দও যখন অন্য কবিকে আলোড়িত করে তখন সেই শব্দের গুরুত্ব অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য নয়। জীবনানন্দের সুপরিচিত কবিতা বনলতা সেনের প্রথম লাইনে আছে ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে। অন্যদিকে ত্রিশের দশকের অন্যতম কবি বুদ্ধদেব বসুর কাব্য গ্রন্থের নাম ‘পৃথিবীর পথে’।

বুদ্ধদেব বসু রচনা সংগ্রহের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর পথে কাব্যগ্রন্থ বুদ্ধদেব বসু কর্তৃক ৪৬/১ রণেশ মিত্র রোড, ভবানীপুর, কলকাতা হতে জুলাই ১৯৩৩ সনে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১/৮ ডিমাই ৪+৪৪ পৃষ্ঠা দাম এক টাকা। কাব্যগ্রন্থের নামপত্রে মুদ্রিত ছিল পৃথিবীর পথে/ বুদ্ধদেব বসু প্রণীত/ প্রেমের কবিতা ১৯২৬/২৮) জ্যাকেটের ছবি এঁকেছেন অনিল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। জ্যাকেটের প্রথম ফ্ল্যাপে ডিএম লাইব্রেরি দ্বারা ‘বন্দির বন্দনা’ সম্বন্ধে শ্রী অরবিন্দের একটি মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। জ্যাকেটের তৃতীয় ফ্ল্যাপে ছিল বন্দির বন্দনা সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের আলোচনা। পৃথিবীর পথে মোট ১৯টি কবিতার সংকলন গ্রন্থ। এই কবিতাবলীর মধ্যে নিম্নেবর্ণিত কবিতাগুলোর প্রথম প্রকাশের বিবরণ পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো ওগো বিদ্যুল্লতা (কল্লোল, আগস্ট ১৩৩৪) অসূর্যম্পশ্যা (প্রগতি, ভাদ্র ১৩৩৪) সুদূরিকা (প্রগতি, ভাদ্র ১৩৩৪) বৈশাখী পূর্ণিমা (কল্লোল, আষাঢ় ১৩৩৫) বাসর রাত্রি (প্রগতি, ফাল্গুন ১৩৩৪) তৃতীয়া (প্রগতি, পৌষ ১৩৩৪) উৎসর্গ (কল্লোল, আশ্বিন ১৩৩৫), তবু তোমা ভুলি নাই (কল্লোল, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫) তোমারে বেসেছি ভালো (কল্লোল, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫) বুদ্ধদেব বসু প্রকাশিত কবিতা পুনর্মুদ্রণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন। কিছু কিছু সংস্কার, বর্জন, সংযোজন, যতিচিহ্নের এবং বানানের পরিবর্তন ছিল তার স্বাভাবিক ঘটনা। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো প্রথম প্রকাশের সময় যেভাবে ছিল গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর তা অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যতিচিহ্নের পরিবর্তন তো বটেই। কোনো কোনো শব্দের উচ্চারণজনিত বানান যেমন সৃজিয়াছো, করিছো, রচিয়াছো পূর্বে উল্লেখিত হয়েছিল ও-কার বর্জিত হয়ে। আর কিছু নাহি সাধ কবিতাটি কবির বন্দির বন্দনা কবিতাগ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণে (প্রকাশ-সেপ্টেম্বর ১৯৬২) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এর আগেই কবিতাটি পৃথিবীর পথে (প্রকাশ জুলাই ১৯৩৩) এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পৃথিবীর পথে কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির নাম ‘পূর্বরাগ’। কবিতাটির শুরু হয়েছে নিসর্গের নিবিড় স্নিগ্ধ বর্ণনা দিয়ে। ‘ফাল্গুনের অপরাহ্ন নেমে এলো স্নিগ্ধ, সুমধুর/ নিঃশব্দ চরাপাতে/ উদার প্রান্তর ভরে/ শ্যাম তৃণ পল্লবের মুখে।

ছড়াইলো আলোর আবীর;/ধূসর গগনে মেখে দিয়ে গেলো রাঙা রক্তের প্রলেপ/পত্রহীন, শুষ্ক, ঋজু, দীর্ঘ বৃক্ষ রাশি/ পশ্চিম দিগন্ত পাড়ে করিয়াছে ভিড়/ তারই পাছে সূর্য অস্ত যায়/ নীলব গৌরবে।’ তারপরেই কবি বর্ণনা করেন পৃথিবীতে গোধূলির নেমে আসার সংবাদ। তারপর এক সময় ‘ম্লানতরো হয়ে আসে গগনের ছবি, ডুবে যায় রবি।’ এরপর রাত্রির জন্য প্রতীক্ষা। ‘এখনি নামিবে অন্ধকার;/ এখনি উঠিবে জ্বলি তারকার মণি। বাতাস উঠেছে জেগে; বয়ে নিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস;/ কয়ে যায় কানে কানে।’ এরপরেই কবির স্বাগত সংলাপ। ‘আমি কহি মনে মনে; আমি কারে করিবো আহ্বান রাত্রির উৎসব সভা তলে?/ কার তরে স্তিমিত দীপের আলো বারম্বার তুলিবো জ্বালিয়া/ নবীন ইন্ধনে। এরপরেই গভীর বেদনা নিয়ে ঝরে পড়ে তার পূর্বরাগ-‘ম্লানতরো হয়ে গেছে সন্ধ্যার গগন- আমার ব্যথায় কোন সাড়া তার বাজে নাই বুকে;/ ম্লান, উদাসীন এই সন্ধ্যার গগন। কাব্যগ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতায়ই প্রকাশ পেয়েছে কবি মনের প্রেমের আর্তি। দ্বিতীয় কবিতা ওগো বিদ্যুল্লতায় আছে গীতলতা। অনেকটাই রাবীন্দ্রিক ধাঁচ। প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই কবিতাটি কবির নাম মুছে দিলে যে কারও কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলেই মনে হতে পারে। যেমন- ‘ওগো বিদ্যুল্লতা আমার হৃদয়ে কেন তুমি আজি। দীপ্ত রচন-রতা?/মেঘের কণ্ঠে জ্যোতির মালিকা/কেন মিছে, হায়, পরালে, ক্ষণিকা?/সবে না নে ভার, ছিঁড়ি যাবে ডোর/নিবে যাবে সব আলো/আকুল আকাশে তুমি মিলাইবে মধুর স্বপন আবার কৃষ্ণা নিশির কালো।/তবে রেখে দাও এক নিমেষের আলোকের ফুল্লতা। ওগো বিদ্যুল্লতা। ...’ এভাবেই লিখেছেন ‘শেষ অভিসার’ ‘অসূর্যস্পশ্যা’, ‘সদূরিকা’, ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’, ‘প্রেমপত্র’, ‘বাসর রাত্রি’, ‘তৃতীয়’, প্রভৃতি কবিতা। এর মধ্যে ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ কবিতাটি ত্রিপদী ছন্দে রচিত। অনেকটা মধ্যযুগের কৃত্তিবাসদের ঢঙে। যেমন- ‘বৈশাখী পূর্ণিমা এলো বৈশাখী পূর্ণিমা এলো বৈশাখী পূর্ণিমা এলো আজ, নদীর চঞ্চল জলে, পল্লব অঞ্চল তলে নব্যজ্যোৎস্না কাঁপিছে সলাজ। ...’ এরপরে বিরহির চিঠি কবিতাতে চিত্রকল্প পেয়েছে আধুনিক মাত্রা। তবে ছন্দ এবং শব্দ চয়নে রক্ষিত হয়েছে বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারাবাহিকতা। যেমন-
আকাশটা আজ মরে আছে
মেঘলা দিনের ঘোলা আলোয়,
সকাল বেলার রাঙা কমল
ডুব মেরেছে দীঘির কালোয়।
আলোর পাখি মুখ ঢেকেছে,
পাথার পাহার মিলিয়ে গেছে
ভস্মরেণুর আল্লনাতে
সেজেছে আজ নীলের আলোয়।

পরবর্তী কবিতাগুলোর মধ্যে আছে ‘উৎসর্গ’; ‘আর কিছু নাহি সাধ’, ‘তথাপি বাঁচিয়া রবে?’ ‘পাপী’, ‘মুক্তিস্নান’, ‘তবু তোমা তুলি নাই’, সেই ভালো, রহিয়ো নির্ব্বাক’, তোমারে বেসেছি ভালো, ও ‘প্রথম চুম্বন।’ বুদ্ধদেব বসুর জীবনের প্রথম দিকে লেখা এই কবিতাগুলোতে তার নিজস্বতা এবং স্বকীয়তার ছাপ থাকলেও শব্দ চয়নে ছন্দের গঠনে, বিষয়ে প্রকরণে অগ্রজ কবিদের প্রভাবও ছিল অনস্বীকার্য। বেশিরভাগ কবিতাই তার দীর্ঘ। কোনো কোনো কবিতায় নজরুলের ঘরানাও দেখা গেছে। যেমন ‘উৎসর্গ’ কবিতায় তারি তরে রচি মোর গান; যেজন, এসেছে কাছে ভালোবেসে, হাতে হাত ছুঁয়ে, স্পর্শের তরঙ্গ দিয়ে দেহ- তট গেছে মোর ধুয়ে;
যাহার কেশের গন্ধে মোর মালঞ্চের ফুল হয়েছে সুরভী।
যার আঁখি কামনায় মনের গগনে মোর ফুটিয়াছে রবি
আমার কেশের মেঘে যার রাঙা আঙুলের বিদ্যুৎ বল্লবী
পুলকিত শিহরণে বারম্বার গেছে খেলা করি।

অথবা ‘পাপী’ কবিতায়-
‘আমারে করিও ভয়; জেনো আমি তোমাদের
নাহি একজন
তোমরা গড়েছো গৃহ, রচিয়াছো শান্তি ভরা
সংসার অঙ্গন।...’

তবে একজন আধুনিক কবির তীব্র রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া যায় বুদ্ধদেবের এই গ্রন্থভুক্ত শেষ কবিতায়
‘আমি শুধু চেয়েছিনু করাঙ্গুলি স্পর্শতর
দিয়েছিলে তুমিই চুম্বন;
প্রথম চুম্বন সেই কম্পিত কুসুমসম ফুটেছিল
সম্পূর্ণ সুন্দর’
মুদিত পদ্মের মতো ঢলে পড়েছিল।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //