পিকাসোর নারীরা

বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো (১৮৮১- ১৯৭৩), ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ এই জীবনে একের পর এক কালজয়ী চিত্রকর্মের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হন এই মহান শিল্পী। চিত্রশিল্পের জগতে মহীরুহ পাবলো পিকাসো ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন তা তাঁর ভক্তদেরও ইচ্ছে করে জানতে।

জানা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন প্রেমিক পুরুষ- প্রণয়ের সম্পর্কে লিপ্ত ছিলেন একাধিক নারীর সঙ্গে। তাঁর জীবনী নিয়ে নতুন করে বলার আর কিছু নেই- তবে তাঁর জীবনের অজানা একটি দিক নিয়ে ২০০৯ সালে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন মার্ক হাডসন। ‘পিকাসো- চ্যালেঞ্জিং দ্য পাস্ট’ শিরোনামে ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনীতে নারীদের সঙ্গে পিকাসোর ‘কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপ’ বা জটিল সম্পর্কের দিকটিতে তুলে ধরা হয়।

এই রচনাটিতে কীর্তিমান এই শিল্পীর মৃত্যুর এত বছর পরেও অভিযোগ উঠেছে- পিকাসো নাকি তাঁর চিত্রকর্মের জন্য নারীদের শুধু ‘ব্যবহার’ করতেন। আধুনিক শিল্পকলার এক অনন্য নাম পিকাসো, যিনি কিউবিজমের জনক। স্থাপত্য থেকে শুরু করে আধুনিক ফ্যাশন পর্যন্ত ভিজ্যুয়াল আর্টের প্রায় সব মাধ্যমেই রয়েছে এই কালজয়ী শিল্পীর প্রভাব।

প্রত্যেক শিল্পীই কিছু না কিছু থেকে প্রভাবিত হয়ে তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেন। স্বভাবতই তাই প্রশ্ন এসে যায়, কীসের প্রভাব পিকাসোর অন্তরে তাড়না জাগায়- সাধারণ পর্যবেক্ষণকে ভেঙেচুরে একেবারে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিষয়কে ক্যানভাসে বন্দি করার?

এই প্রশ্নের অনুসন্ধান থেকেই জানা যায়, বৈচিত্র্যময় পিকাসোর জীবনে অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর জীবনে আসা নারীরা। তাদের একেক জনের একেক রকম বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পড়ে তাঁর কাজের মধ্যে, শিল্পের স্বপ্নীল যে ভুবনে বাস করতেন পিকাসো ঠিক সেখানে। তাই ধরে নেওয়া হয়- পিকাসোর জীবনে আসা বহু নারীর প্রভাবেই হয়তো পিকাসোর চিত্রকর্মের স্টাইলেও দেখা মেলে বৈচিত্র্যের। তাঁর একেকটি কাজের স্টাইল এবং পর্যায়কালকে তাঁর প্রেমিকাদের নামে নামকরণ করলেও হয়তো ভুল হবে না, একথা চিত্রকলা বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন।

শিল্পী পিকাসো নাকি কথা বলার আগে আঁকা শুরু করেছিলেন। আর দশটি শিশুর মতো মা-বাবা নয়, বরং তাঁর মুখে প্রথম যে শব্দটি শোনা যায় তা হলো ‘লাপিয’, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘পেন্সিল’। সেই একই ব্যক্তির মধ্যে বেশ বড় ধরনের একটি পরিবর্তন দেখা যায় নারীঘটিত সম্পর্কগুলোকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৩ সালে পিকাসো তাঁর রক্ষিতা ফ্রাসোয়া গিলতকে বলেন এ কথা- ‘নারীরা যন্ত্রণা সৃষ্টির যন্ত্র।’ ৯ বছর ধরে চলা এই সম্পর্কের শেষে ৬১ বছর বয়সী পিকাসো তাঁর এই ২১ বছর বয়সী ছাত্রীকে বলেন- ‘আমার জীবনে নারীরা কেবল দুই রূপে স্থান পায়-দেবী অথবা পাপোশ।’

ফার্নান্দে অলিভিয়ার- মডেল ফার্নান্দে অলিভিয়ারের সঙ্গেই সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রণয়ে ছিলেন পিকাসো। পিকাসোর সঙ্গে ছিলেন ১৯০৪-১৯১১ সাল অব্দি, মেয়েবেলার দুঃসহ স্মৃতি আর কমবয়সে ভুল মানুষকে বিয়ে করার যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনি প্যারিসের বোহেমিয়ান জীবনে আশ্রয় নেন।

ফার্নান্দের এই বোহেমিয়ান জীবনেই আসেন পিকাসো। প্রায় ৮ বছরের সম্পর্কের এই সময়ে তাকে নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকেন পিকাসো। আর এই সময়টিই ছিল কিউবিজম বিপ্লবের- তবুও কখনো পিকাসোর শিল্পসত্তা তাকে স্পর্শ করেনি। বিবাহিতা ফার্নান্দের সঙ্গে ১৯০৪ সালে পিকাসোর দেখা হওয়ার পর থেকে আর অন্য কারও জন্য তাকে মডেলিং করতে দেননি পিকাসো। ১৯৮৮ সালে পিকাসোর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন স্মৃতি নিয়ে তাঁর বই বের হয় যার নাম- লাভিং পিকাসো।

ইভা গোয়েল- ১৯১২ সালে ফার্নান্দের সঙ্গে পিকাসোর সম্পর্কের অবসান হওয়ার পর নতুন করে জড়িয়ে পড়েন ইভা গোয়েল নামেই বেশি পরিচিত এই নারীর সঙ্গে। ক্ষণজন্মা ইভা সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। ১৯১৫ সালে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইভা আর তার অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন পিকাসো। পরবর্তীতে- ‘আই লাভ ইভা’ পেইন্টিংয়ে তাঁর প্রতি পিকাসোর ভালোবাসার প্রকাশ দেখা যায়।

ওলগা খোখলোভা- ওলগা ছিলেন পিকাসোর প্রথম স্ত্রী, তার প্রথম সন্তান পাউলোর জননী ইউক্রেনিয়ার নৃত্যশিল্পী ওলগা খোখলোভা। শিল্পী যখন রোমে ব্যালে প্যারেড ডিজাইন করছিলেন, তখন এই ব্যালে শিল্পীর সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। তারা ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় বিয়েও করেন।

তাদের বৈবাহিক জীবন কলহপূর্ণ ছিল। ওলগা একদিকে ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উচ্চবিত্ত সমাজের আনুষ্ঠানিকতাপ্রিয় মেয়ে, অন্যদিকে পিকাসো ছিলেন সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান। কাজেই তাদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্বের কারণ সহজেই অনুমেয়। ১৯২১ সালে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। ১৯৩৫ সালে তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে ওলগা পিকাসোর নামে একের পর এক অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেন। 

ফরাসি আইন অনুযায়ী তাদের বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়নি কেননা- পিকাসো তাঁর সম্পদ ভাগ করতে রাজি ছিলেন না।

মারি থেরেস- ১৯২৭ সালে মারি খুব অল্প বয়সেই শিল্পী পিকাসোর প্রেমে পড়েন, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। স্বর্ণকেশী এই তরুণীর সঙ্গে আর্ট গ্যালারির বাইরে দেখা হয় পিকাসোর, সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তারা। ব্যাপারটা মারি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রী ওলগার অজানা ছিল, পিকাসো প্রায় আট বছর লুকিয়ে রেখেছিলেন এই প্রেম। মায়া নামে মারি আর পিকাসোর এক কন্যাসন্তান জন্ম হয়। মায়া জন্মের এক বছর পরেই পিকাসো আবার দোরে মারের সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হোন। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ১৯৭৭ সালে আত্মহত্যা করেন মারি।

দোরে মার- জন্মগতভাবে ক্রোয়েশিয়া এবং ফরাসি মিশ্র রক্তের হেনরিটা থিওডরা মার্কোভিচ, যিনি দোরে মার নামেই পরিচিত, একাধারে আলোকচিত্রী, চিত্রশিল্পী এবং কবি ছিলেন। গ্যের্নিকার ছবি তোলার সূত্রে ১৯৩৬ সালে ৫৪ বছর বয়সী পিকাসো যুগোস্লাভিয়ান আলোকচিত্রী দোরে মারের সঙ্গে মিলিত হন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি পিকাসোর সবসময়ের সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু পিকাসো তাঁর পরবর্তী প্রেমিকা ফ্রাসোয়ার জন্য দোরে মারকে ছেড়ে যান। দোরে মার তার জীবনের শেষ দিনগুলো পিকাসোর সঙ্গে কাটানো সুসময়ের কথা ভেবে অতিবাহিত করেন।

ফ্রানকোয়স গিলত- পরিবারের পছন্দে আইন বিষয়ে পড়তে যাওয়া গিলত সুযোগ পেয়েই প্রিয় বিষয় শিল্পকলায় ভর্তি হয়ে যান। ১৯৪৩ সালে শিল্পকলার এই ছাত্রীর সঙ্গে পিকাসোর প্রেম হয়। তাঁদের ঘরে ক্লদ ও পালোমা নামে দুটি সন্তানের জন্ম হয়। 

জ্যাকলিন রোক- ভ্যালারিসের মাদুরা পটারি স্টুডিওতে সহকারী বিক্রেতা ছিলেন জ্যাকলিন, এখানেই পিকাসো তাঁর সিরামিকসের কাজগুলো করাতেন। ১৯৫৪ সালে হতাশ নিঃসঙ্গ পিকাসো ২৭ বছর বয়সী জ্যাকলিনের সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৬১ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। এ সময় পিকাসোর বয়স ৭৯। জ্যাকলিনকে নিয়ে পিকাসো ৪০০টি পোট্রেট এঁকেছিলেন।

পিকাসোর প্রেমিকাদের মধ্যে শুধুমাত্র ওলগা এবং জ্যাকলিনই মাদাম পিকাসো হতে পেরেছিলেন অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর মর্যাদা পেয়েছিলেন, কারণ স্প্যানিশদের মধ্যে স্ত্রী জীবিত থাকাকালীন অন্য কাউকে বিয়ে করার রীতি ছিল না। ১৯৮৬ সালে গুলি করে আত্মহত্যা করেন জ্যাকলিন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //