লাইলি মজনু

লাইলি-মজনুর কিসসা শুনেছিলাম প্রথম সেই কৈশোরে, আমাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনে খেজুর পাতার পাটিতে শুয়ে শুয়ে। আজো মনে আছে সে রাতে জোছনা ছিল। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ ছিল আকাশে। আমাদের বাড়ির কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন জোনাবালি নামের এক বাধা মাইনের কৃষক। আমরা ডাকতাম জোনাবালী চাচা।

সারাদিন কাজের শেষে, রাতের উঠোনে শুরু হতো, জোনাবালী চাচার গল্পের আসর। আমীর সাধু-ভেলুয়া-সুন্দরী, মধুমালা-মদনকুমার এমনি নানান কিসসা শুনতাম আমরা তাঁর কাছে। তাঁর গল্প শুরু হত এভাবে, ‘কিচ্ছা শুনে কিস কিষানী শুনে কিচ্ছার মায়, পান তামাক না খাওয়াইলে কি কিচ্ছা শোনান যায়।’

এভাবেই শুরু হয়েছিল কৈশোরের স্বপ্নদেখা চোখ নিয়ে লাইলি-মজনুর কিসসা শোনা। জোনাবালী বলতেন এভাবে, একদেশে ছিল এক বিরাট বড় লোক। নাম তার আমীর। আল্লার কাছে অনেক সাধ্যসাধনা করে তার ঘরে আসে এক পুত্র সন্তান। আকাশের গায় যেমন চন্দ্র শোভা পায় তেমনি এই পুত্র সন্তান বাবা মায়ের কোলে শোভা পায়। চান সুরুজও পুত্রের রূপ দেখে লজ্জা পায়। অপরূপ এই পুত্রের নাম রাখলো কএস। এই পুত্র জন্মের পর থেকেই সুন্দর নারী, সুন্দর ফল নানান কিছু পাওয়ার জন্য অস্থির থাকে।

আকাশের চাঁদ সুন্দর, তাকে দাও। সূর্য সুন্দর তাকে দাও। একদিন বাবা ছেলেকে পাঠালো পাঠশালায়। সেই পাঠশালায় ভর্তি হলো মালিক রাজার কন্যা লাইলি। পাঠশালায় প্রথম দেখাতেই দুইজনের প্রেম হয়। একজন আরেকজনকে না দেখলে তাদের জীবন বাঁচে না।

এই প্রেমের কথা প্রথমে জানলো বন্ধুরা, তারপর শিক্ষকরা, একদিন পিতা-মাতার কানে গেল এই প্রেমের খবর। অবশেষে এক কান দুই কান করে সারাদেশের মানুষ জেনে গেল লাইলি-মজনুর প্রেমের কাহিনী। এই ছিল আমার কৈশোরে শোনা লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনি শোনার প্রথম অভিজ্ঞতা।

বড় হয়ে আরো জানলাম, বই পড়ে জানলাম এই অমর প্রেমকাহিনির উৎস আরবের মরু প্রান্তরে। কিন্তু আমি কৈশোরে যে গল্প শুনেছি তাতে একবারও মনে আসেনি কাহিনি এদেশের নয়। কারণ গল্পের যে আকাশ, যে বৃষ্টির বর্ণনা, যে সবুজ বৃক্ষের কথা তাতে আমার মনে বাংলাদেশের ছবিটাই ভেসে উঠতো। বড় হয়ে জানলাম বাঙালি কবি দৌলত উজীর বাহরাম খান লায়লী-মজনু কাব্য রচনা করে এই কাহিনীকে বাঙালির ঘরের কাহিনী করে তুলেছেন।

আরব-পারশ্য-বাংলাদেশ সারা বিশ্বের বিরহী-বিরহিনীর দগ্ধ হৃদয়ের নাম লাইলি-মজনু। এই প্রেম কাহিনি বাঙালির প্রাণেমনে মিশে গেছে বাঙালি কবি দৌলত উজীর বাহরাম খানের লায়লী-মজনু নামের অসাধারণ আখ্যান কাব্য রচনার পর। 

দৌলত উজীর বাহরাম খানের লায়লী-মজনু কাব্যের গল্পটির চরিত্রগুলো আরবীয় কিন্তু একেবারেই আমাদের অতিচেনা কাছের মানুষ তারা। কবি বাঙালির পরিবেশ ও জীবনভাবনার অন্তরঙ্গতায় আখ্যানটি রচনা করেছেন।

বাহরাম খান লাইলির রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, 

লায়লী তাহার নাম মালিক নন্দিনী।

পূর্ণ শশী জিনি মুখ জগত মোহিনী।

এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পড়া-লেখা ভুলে শুধু প্রেমের পাঠ নেয়। অন্যকিছু ভালো লাগে না। একথা মা জানলে লাইলির পাঠশালায় যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। পাছে পত্র লেখে এজন্য কলম ভেঙে ফেলেন মা। লাইলিকে দেখার জন্য কএস অন্ধ ভিখারীর বেশ ধরে লাইলির বাড়িতে গিয়ে দেখা করে।

পিতা তা জানতে পেরে কএসকে মেরে তাড়িয়ে দেন। কএসের বদনাম ছড়িয়ে যায় সবখানে। বেদনায়, বিরহে কএস পাগল হয়ে যায়। তার নাম হয়ে যায় মজনু অর্থাৎ পাগল। বাবা অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু মজনুর উন্মত্ততা কাটে না। মজনুর বাবা আমীর লাইলির বাবা সুমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। পাগলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন লাইলির বাবা।

অনেক অনুরোধের পর রাজি হন লাইলির বাবা। মজনু বিবাহ আসরে আসে। লাইলির কুকুর দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে এবং কুকুরের রূপের প্রশংসা করে মজনু। বিয়ে ভেঙ্গে যায়। আবার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে বনে চলে যায় মজনু। সারা পৃথিবীতে সে শুধু লাইলিকে দেখে।

অন্যদিকে লাইলিও মজনুকে ভুলতে পারে না। তার চিন্তায় শুধুই মজনু। লাইলিকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয় ইবনে সালামের পুত্রের সঙ্গে। কিন্তু লাইলি স্বামীকে গ্রহণ করে না। মজনুর বিরহদশা দেখে নয়ফলরাজ লাইলির বাবাকে যুদ্ধে পরাজিত করে লাইলিকে নিয়ে আসেন। কিন্তু রূপান্ধ নয়ফল নিজেই বিয়ে করতে চান লাইলিকে। তিনি মজনুকে হত্যা করতে গিয়ে নিজেই বিষমিশ্রিত সুরা পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। লাইলি চলে যায় পিতার সঙ্গে। মজনু ফিরে গেল তার অরণ্যবাসে।

একবার লাইলি সপরিবারে ভ্রমণে বেরিয়েছিল শামদেশে। নজদ বনের পাশ দিয়ে যেতে গোপনে উটের পিঠে চড়ে মজনুর সঙ্গে দেখা করে লাইলি। বলে :

পরিণয় কর মোরে সদয় হৃদয়ে।

করিএ তোহ্মার সেবা এক মন কায়ে॥

মজনু এই এই প্রস্তাব পেল রাতের নির্জনে তার কাছ থেকে যার জন্য জীবনের প্রতিটি পল প্রতিটি নিঃশ্বাস নিবেদন করেছে। মজনু পাগল, মজনু প্রেমিক কিন্তু সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যায়নি। বলে-

গুপ্তরূপে তোমাকে করিলে পরিণয়।

আরব নগরে লোকে দুষিব নিশ্চয় ॥

লাইলি এই আঘাত সইতে পারেনি। বিরহের আগুন তাকে গ্রাস করতে থাকে ক্রমাগত। কোনো এক হেমন্তে ঝরে যায় লাইলি। মৃত্যুর আগে মাকে বলে যায় তার মৃত্যু সংবাদ যেন মজনুকে তিনি জানিয়ে দেন।

লাইলির মা নিজে গিয়ে লাইলির মৃত্য সংবাদ দেন মজনুকে। লাইলির কবরে নিঃসাড় পড়ে থাকে মজনু। লাইলির কবরেই তার মৃত্যু ঘটে। কবি কামনা করেন :

কবরেতে দুইজন বক্ষে বক্ষ সর্বক্ষণ

মজিয়া রইব মন সুখে।

দুনিয়াতে পাইল দুঃখ কবরেত হৈব সুখ

নিজ প্রিয় লইবেন বুকে ॥ 

লাইলি মজনুর গল্পের সার-সংক্ষেপ আহমদ শরীফ সম্পাদিত লায়লী-মজনু মূল গ্রন্থের আলোকে করা হয়েছে।

লাইলি-মজনু প্রেমকাহিনী পৃথিবীর মুসলমান জাতির কাছে ঘরোয়া এবং এক অনুপম সম্পদ। এটি বংশ পরম্পরায় ধরে রাখা ঐতিহ্যেরই অংশ।

এখনো এই প্রেমকাহিনীর আবেদন কমে যায়নি মুসলমানের অন্তর থেকে। তাই বলে এই কাহিনী একেবারেই কোন সম্প্রদায় বিশেষের হয়ে থাকে নি।

কবিদের হাতে শব্দে ছন্দে সুরে তালে সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে আপমর মানুষের প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠেছে। কেউ প্রেমে পাগল হলে কিংবা প্রেমের উন্মত্ততা বুঝানোর জন্য মজনু বলা হয়। আদর্শ প্রেমের উদাহরণ হিসেবে কোন কিছু বলতে গেলে প্রথমেই আসে লাইলি-মজনুর নাম।

বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজ পর্যন্ত যত গল্প উপাখ্যান শেকড় গেড়ে আছে তারমধ্যে এই লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনী একটি উল্লেখযোগ্য আখ্যান। বাঙালির নিকট রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখার প্রেমের গল্প যে ভাবে পরিচিত লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনীও তেমনি পরিচিত।

গল্পটি এত গভীরভাবে বাঙালি জীবনে আলোড়ন তুলেছে, বাঙালির আত্মগত ভালোবাসার অংশ হয়ে উঠেছে যে কল্পনার এই দুই নর-নারী আপনের চেয়ে আপন আজও বাঙালি জনজীবনে। প্রেমের মধ্যদিয়ে আল্লাহকে পাওয়ার যে সাধনা সুফী সাধকরা করেছেন তাতে বিরহের আগুনে পুড়ে খাঁটি হওয়ার দিকেই তাঁরা জোর দিয়েছেন সমধিক।

নজরুলে সেই বিখ্যাত গান, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোল’ শ্রোতার কানের ভেতর দিয়ে মনের ভেতরে ভাবাবেগ তৈরি করে এবং একইসঙ্গে চোখের সামনে মরু প্রান্তর অরণ্যের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা বিরহী মজনুর একটি দৃশ্যমানতাও তৈরি হয়ে যায়। তখন এই কাহিনী সত্য কি মিথ্যা, কল্পনার না বাস্তবের তা গৌণ হয়ে ওঠে। শুধু বুকের ভেতরে বেদনার লু হাওয়া বয়ে যায় অতৃপ্ত দুই প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য।

সমাজ যাঁদের ব্যথা বোঝেনি, পরিবার যাদের প্রেমকে স্বীকার করেনি। বঞ্চিত দুইটি জীবন ঝরে গেছে পরিণয়হীন। আজো অনেকেই বিশ্বাস করে যে বেহেস্তে লাইলি-মজনুর বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়েও অনেক কিংবদন্তী চালু আছে এদেশে। এভাবে একটি প্রেমের কাহিনী মানুষের কাছে পবিত্র এক বন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অথচ এই কাহিনী কার কলমে কিংবা কল্পনায় প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছিল তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আজও মেলে নি।

কাহিনীর স্থান-কাল-পাত্র আরবীয় হলেও আরবীয় সাহিত্যে এই আখ্যানের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। হয়তো আরবের কোনো মৌখিক কাহিনী ফারসি কবিদের হাতে এমনতর অমর প্রেমের কাহিনী হয়ে উঠেছে। বাঙালি জীবনে যেভাবে এই গল্পটি বেড়ে উঠেছে তার পেছনে বাঙালি কবি দৌলত উজীর বাহরাম খানের নাম জড়িয়ে আছে।

দৌলত উজীর বাহরাম খানের কাব্যের নাম লায়লী-মজনু। কাব্যটি ১৫৪৩ সন থেকে ১৫৫৩ সনের মধ্যে লিখিত হয়েছে বলে পন্ডিতগণ অনুমান করেছেন। লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনীও অধ্যাত্ম প্রেমের উদাহরণ রূপে টিকে আছে বাঙালি জনপদে। শুধু তাই নয় প্রেমকে চিরন্তন এক সত্যের প্রতীক ধরে জীবনের মোক্ষলাভের নিয়ামক হিসেবে যে ধারণাটির জন্ম হয়েছে তার উৎসে রয়েছে লাইলি মজনুর অমর প্রেমকাহিনী।

বাংলাদেশে যেভাবে মথুরা-বৃন্দাবনের রাধা-কৃষ্ণ বাঙালির হয়ে উঠেছে তেমনি আরব দেশের প্রেক্ষাপটে কল্পিত লাইলি মজনুও বাঙালি জীবনের অংশ হয়ে সকলের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে। এর প্রভাব এতটাই ব্যাপক হয়েছিল যে ছেলে-মেয়েদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও লাইলি-মজনু প্রাধান্য পেত। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের পাশাপাশি সুফী মতবাদেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল।

প্রেমের মধ্যদিয়ে পরম সত্যকে পাওয়ার সাধনায় তাই বিভিন্ন প্রণয় কাহিনীর চরিত্রগুলো আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি অর্থাৎ মানুষকে সুফীরা বলতেন ‘আশেক’ এবং স্রষ্টাকে বলতেন ‘মাশুক’। আশেক সব সময়েই মাশুকের দিকে ধাবিত হয়। যেমন রাধা ধাবিত সারাজীবন কৃষ্ণের দিকে। অর্থাৎ সৃষ্টি অপূর্ণ বলে সব সময়েই পূর্ণতার প্রতীক স্রষ্টার দিকে ছুটে চলে। মিলনের মধ্যে এর পরিসমাপ্তি ঘটেনা। বিরহের মধ্যদিয়ে, চিত্তের অনবরত দহনের মধ্যদিয়ে সেই পরম সত্যকে খোঁজার মধ্যেই চরম আনন্দ নিহিত।

তাই লাইলির সঙ্গে মজনুর বিয়ে হয়নি। একটার পর একটা বাঁধা এসেছে। এই বাঁধা কখনো সমাজ থেকে উদ্ভূত কখনো আবার প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরের ভেতরে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। বাহরাম খানের হাতে লাইলি মজনুর প্রেমকাহিনী লৌকিক জীবনের অনুষঙ্গে বাঙালির ঘরোয়া জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে কিন্তু আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই প্রেমকাহিনীর পবিত্রতা এতটুকুও মলিন হয়নি। বাহরাম খানের গল্পের নারী পুরুষ আরবের কিন্ত এদের গড়ন গঠনে বাংলাদেশের মানুষের বেদনার অনুরণন প্রতিমুহূর্তে ধ্বনিত হয়। বাহরাম খানের কাব্যের পরিবেশ মরুপ্রান্তরের নয় একেবারেই শ্যামলিম বাঙলার ছায়ায় ছায়ায় রচিত হয়েছে। 

দৌলত উজীরই প্রথম কবি যিনি মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের ধারায় এই লাইলি মজনুর কাহিনী সংযোজন করেছিলেন। তিনি মুখে মুখে শোনা লাইলি-মজনুর গল্প এবং ফারসি সাহিত্যের কবি নিযামী, খসরু কিংবা আব্দুর রহমান জামীর কাহিনী মিলিয়ে তাঁর আখ্যান রচনা করেছিলেন। বাহরাম খানের পরে বাঙলা ভাষায় লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনী নিয়ে আরও অনেক গ্রন্থ লেখা হয়েছে।

পুথিসাহিত্যের কবি মুহম্মদ খাতের (১৮৬৪), আবুজদ জহিরুল হক (১৯৩০), ওয়াজেদ আলী (১৯৪৪) রচিত লাইলি-মজনু কাব্য গ্রাম বাঙলার ঘরে ঘরে বহুল পঠিত ছিল। গদ্যে লেখা লাইলি-মজনু আখ্যানের রচয়িতারা হলেন মহেশ চন্দ্র মিত্র (১৮৫৩), শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩), আব্দুল গফুর সিদ্দিকী অনুসন্ধান বিশারদ, শাহাদাৎ হোসেন, মীর্জা সোলতান আহমদ, দ্বারকানাথ রায় (১৮৫৯), (নাটক) রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৯১)। বাঙলায় রচিত লাইলি-মজনুর কাহিনির উৎস ফারসি ধরা হলেও কে প্রথম এই কাহিনী আদি রচয়িতা তা জানা যায় না।

ড. আহমদ শরীফের মতে দশ শতকের ইরানি কবি রুদকীর কবিতাতেই সম্ভবত প্রথম লাইলি মজনুর প্রেম প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। ফারসি ভাষায় নিযামী গঞ্জাবী (১১৮৮), আমীর খসরু (১২৯৮), আব্দুর রহমান জামী (১৪৮৪), আব্দুল্লাহ হাতিভী (১৫১১), হিলালী আস্ত্রাবাদী (১৫৩৩), দামিরী (১৫২৪-৭৬), মীর্জা মুহম্মদ কামে কাসেমী গুণাবাদী (১৫৭২) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

এসব কবির লেখার ভেতর দিয়ে যে অমর প্রেমিক-প্রেমিকা বেড়ে উঠেছে তা বাঙালি কবি বাহরাম খানের হাতে এসে বাঙালির চিরন্তন প্রেমের আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

লায়লী-মজনু আখ্যানকাব্যে আমরা দেখি যে লাইলি-মজনু কেউই পরিবার পরিজনের অবাধ্য হয়নি। প্রেমের প্রতি তারা একনিষ্ঠ থেকেছে কিন্তু এই একনিষ্ঠতা সমাজধর্ম সামাজিক নিয়মকে ভূলুণ্ঠিত করে সংঘটিত হয়নি। তারা নিজেরা বেদনার্ত হয়েছে, বঞ্চিত থেকেছে, অনবরত রক্তাক্ত হয়েছে হৃদয় বেদনায় কিন্তু তা সমাজ বিধ্বংসী আবহ তৈরি করেনি।

তাদের ক্রন্দনধ্বনি বিরহী হিয়ার নিদারুণ যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেছে। একেকটি ঋতু আসে আর সে ঋতুর প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহানল দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে। বাঙালি করুণ রসের ভেতরে ডুবে থাকতে যে আনন্দ পায় তার পরিচয় এই কাহিনীতে লভ্য। যেমন রাধাকৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতার সঙ্গে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তেমনি লাইলি মজনুর বিরহার্তিকে তুলে ধরার জন্য বাহরাম খান ষড় ঋতুর আশ্রয় নিয়েছেন।

বৈষ্ণব পদাবলির মতোই এদের কানেও পরস্পরের নাম মধুবর্ষণ করে। বেঁচে থেকেও এরা কেঁদেছে বিরহে, মৃত্যুর পরেও তারা কাঁদিয়েছে শ্রোতাকে। যে প্রেম হয়েছিল শৈশবের প্রথম দেখায়, যৌবনের প্রখর বসন্তে তার তীব্রতা বেড়েছে কিন্তু যন্ত্রণাকে অঙ্গাবরণ করে। তবে ফারসি কবিদের হাতে একেবারেই কামগন্ধহীন আধ্যাত্মিক যে প্রেমকাহিনী লাইলি মজনুকে ঘিরে রচিত হয়েছে তা বাঙালি কবির হাতে ঘটেনি।

বাঙালি কবির প্রেমের প্রেরণা রাধাকৃষ্ণের প্রেমেকাহিনী। সমাজের বাধা প্রেম প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে সমাজ ও প্রেমের দ্বন্দ্ব নিয়ে নানা গান রচিত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনের কোন মহত্তম উপলব্ধি হয়তো তাতে নেই কিন্তু জীবনের সরলতম স্বীকারোক্তির পরিচয় সেখানে মেলে।

যেমন, আমাদের কিশোর বেলায় গ্রামের গায়েনদের কণ্ঠে শুনতাম, ‘বন্ধু জানিয়া জানলা না, বন্ধু শুনিয়া শুনলা না, নষ্ট করলো পাড়ার লোকে বন্ধু ভাঙলো পিরিতি।’ এই পাড়ার লোকের কথা বৈষ্ণব পদাবলিতে আছে, লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনীতেও আছে। বাস্তব জীবনকে কেন্দ্র করে লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনী বেড়ে উঠেছে বলেই তা কখনো ফারসি কাব্যের অন্ধ অনুকরণ হয়ে থাকে নি।

লাইলি মজনু রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। তাদের জীবনেও বসন্তের পত্রপুষ্প শোভা মিলনের আহ্বান নিয়ে আসে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে অনেক বড় করে দেখে বলেই আটপৌরে বাসনা তাদের গ্রাস করতে পারেনা।

বাংলাদেশে হতাশাগ্রস্ত প্রেমিক-প্রেমিকারা যেমন সংসার বিমুখ তেমনি মজনু ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যায়- এটা বাঙালির গৃহত্যাগী মানসিকতার ঐতিহ্যকেই তুলে ধরে। তাই আরবের লাইলি মজনু বাঙলার জলে কাঁদায় মিলে মিশে বাঙালির প্রেমভালোবাসার চিরন্তন নিদর্শন হয়ে আছে।

আজো তাই আদর্শ প্রেমিক প্রেমিকা বুঝাতে রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েটের নামের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় লাইলি-মজনুর নাম। লাইলি-মজনু এখন আর ব্যক্তি নয়, এই পৃথিবীতে চিরন্তন প্রেমিক প্রেমিকার প্রতিনিধি তারা দুইজন

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //