বইমেলার মানবিচার

প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারিতে ধারাবাহিকভাবে মাসব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু কোনো বছরই মানহীন হাজার হাজার বই প্রকাশে অনুৎসাহিত হচ্ছেন না তথাকথিত লেখক, কবি ও প্রকাশক। 

এবারো তার ব্যত্যয় হয়নি। মেলায় স্টলের সংখ্যা আরো বেড়েছে। এবার ৬৬২টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। 

গতবারের চেয়ে এবার স্টল বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৩টি। এটা সরকারি হিসাব। বিভিন্ন এনজিও বা রাজনৈতিক সংগঠন বাদ দিলেও প্রায় ৬০০টি প্রকাশনা সংস্থা অংশ নিয়েছে ধরে নিতে পারি। একটি দেশে এত প্রকাশনা সংস্থা, অথচ অধিকাংশই মানহীন-প্রাণহীন সাহিত্য, এটা কি চিন্তা করা যায়? 

প্রতি বছরই এতো আইটেমের বই প্রকাশিত হচ্ছে, এখানে কয়টা বই মনে রাখার মতো বা পড়ার মতো! তবু কেন প্রতি বছর বেড়েই চলেছে প্রকাশনী সংস্থা, এটা চিন্তা করার বিষয়। সবকিছু দেখে শুনে মনে হতে পারে এটা আমাদের সেই পুরনো অভ্যাস বা বিশ্বাস, আমরা হয়তো সংখ্যায় বিশ্বাস করি মানে নয়। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুতেই সংখ্যার দৌরাত্ম্য। 

একটা কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, এই জমানা প্রযুক্তির। আজকের যে বইয়ের আকৃতি, এটার বয়স কত? এর আগেও কি বই ছিল? আমরা একটা সময় পর্যন্ত কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের মনে হয়, বই যেন প্রাণী জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম নিয়েছে। বইয়ের এই আকৃতি একসময় ছিল না। তখন বড় বড় শিটে, পাতায় বা অনুন্নত কাগজে অনুন্নত কালিতে অনুন্নত কলম ডুবিয়ে লেখা হতো। সেটা ক্রমান্বয়ে আজকের বইয়ের রূপ ধারণ করেছে। 

আবার ভবিষ্যতেও এই রূপ থাকবে না হয়তো। ইতোমধ্যে বইয়ের আরো অনেক ফর্মেট যেহেতু চলে এসেছে, সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি- আগামীতে বইয়ের এই আকৃতি আর থাকবে না। একটা ছোট ডিভাইসে হাজার হাজার বই জমিয়ে রেখে ইচ্ছেমতো পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেখানে বইয়ের মতো একটা বস্তু, যা কিনতে প্রচুর টাকা খরচ হয়, আবার যা ওজনে ভারি। বই জমিয়ে রাখার জন্য আলাদা স্থান দরকার। আবার বই সংরক্ষণ করতে আলাদা যত্ন-আত্তির দরকার। 

তাই ধরেই নেয়া যায়, বইয়ের এই ফরমেটও আগামীতে থাকবে না। সেটার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত? এটা বললেও অনেকে তেড়ে আসবে, কারণ তারা বইয়ের এই ফরমেটে আসক্ত। তারা ভাবতেও পারে না, বই আর থাকবে না। 

যা-ই হোক, মেলার কথায় ফিরি। এবার মেলাটাকে একটু বেশিই রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। এটাও চিন্তা জগতের জন্য একটা অশনি সংকেত। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এটা কোনো বইমেলা নয়, দেখে শুনে মনে হয়, এটা আওয়ামী লীগের কোনো কাউন্সিল স্থান।’ বইপত্রের মধ্যেও অহেতুক রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কথা মাথায় রেখে লেখা বই। যে কেউ বঙ্গবন্ধুর ওপর যা খুশি নাম দিয়ে যত্রতত্র বই লিখছে, এটা বেশ অস্বাস্থ্যকর। সেটা বেড়েছে ভয়াবহভাবে।

আরেকটা বিষয় এবার চোখে পড়েছে- সেটা হচ্ছে সেন্সরশিপ। এক প্রকাশক দাবি করেন, তার প্রকাশিত বইয়ের দুটি প্রবন্ধ বাদ দিতে বলেছে একাডেমি কর্তৃপক্ষ। কারণ তারা কোনো বিতর্কিত বই দেখতে চায় না মেলায়। তাদের ধারণা, বিতর্কিত বইয়ের কারণেই মেলায় গত কয়েক বছরে হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায় নিহত হয়েছেন। 

ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না? রোগের কারণ খুঁজে রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার বদলে রোগীকে হত্যা করার মতো! আমার তো মনে হয় লেখালেখির জন্মই হয়েছে বিতর্ক করার উসিলায়। একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা না গেলে সাহিত্য জগতে শুধু অস্বাস্থ্যকর সাহিত্যই জন্মে নেবে। দুনিয়ার সাহিত্যের দিকে তাকান- যা এখনো যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছে, সবই বিতর্কিত বই। সেখানে এইসব সিদ্ধান্ত একেবারেই অশিক্ষিত মানসিকতাই প্রকাশ করে। এই যে শত শত স্টল- একটা জিনিস ভেবে মর্মাহত হতে হয়, বিজ্ঞানভিত্তিক বইপত্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বিজ্ঞানভিত্তিক তেমন কোনো স্টলও চোখে পড়েনি। তেমনি প্রযুক্তির যুগে আমরা বাস করি। অথচ মাত্র দুয়েকটা প্রযুক্তিভিত্তিক বইয়ের স্টল চোখে পড়েছে। বিকল্প চিন্তাকে যেখানে সারাবিশ্বে লালন করা হচ্ছে, সেখানে বিকল্প চিন্তাকেই বন্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টা ও পরিণতি খুবই মারাত্মক হতে বাধ্য।

বাইরে থেকে মেলায় ঢোকার সময় পুলিশের চেকিং কি রুখতে পারছে ধূমপায়ীদের। মেলায় যত্রতত্র দেখা মেলে ধূমপায়ীদের। এই ধূমপায়ীরা নিরন্তর সাধারণের অসুবিধার কারণ হচ্ছে। শুধু চেক দিয়ে, দিয়াশলাই কেড়ে নিয়ে কি মেলায় ধূমপান রোখা যাবে? মেলায় বরং ধূমপায়ীদের জন্যই তাৎক্ষণিক শাস্তির বা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা গেলে হয়তো একে থামানো যেত। 

আর বইয়ের প্রকাশনার খবর প্রকাশের ছলে মেলার মাইকগুলো আসলেই যন্ত্রণাদায়ক। রীতিমতো শব্দদূষণ। 

আরেকটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত- মেলায় ঘুরতে ঘুরতে লোকজন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। মেলায় অহেতুক খাবারের দাম বাড়ানো হয়। এই অভিযোগ একাডেমির বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই। এখনো তার কোনো সুরাহা হয়নি। নিম্নমানের খাবার অনেক দামে কিনে খেতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের।

বইমেলায় আরেকটা জিনিস চোখে পড়েছে- হঠাৎ বেড়ে গেছে বইয়ের দাম। ফর্মাপ্রতি একটি নির্দিষ্ট দাম রাখার বিষয়টি কেউ আর মানছেন না। চীনে কাগজের দাম বেড়ে গেছে বলে পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর মতো বইয়ের দামও বাড়ানো হচ্ছে! 

যে পাঠকরা এখনো বই কিনছেন, এতে তারাও নিরুৎসাহিত হবেন কিনা ভেবে দেখা জরুরি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //