সাহিত্যের পৃথিবীতে মহামারি

পৃথিবী এখন মহামারিতে আক্রান্ত। প্রকৃতি হয়ে উঠেছে আমাদের মৃত্যুর সাক্ষী। করোনা নামের ভাইরাস সারা পৃথিবীর মানুষকে করে রেখেছে ঘরবন্দি। মানুষ প্রয়োজনেও আজ ঘর থেকে বের হতে পারে না, প্রতিটি রাষ্ট্র তার সীমান্তের দ্বার বন্ধ করেছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশ শুধু নয়- এক শহর থেকে অন্য শহর, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, কিংবা আমাদের পাশের প্রতিবেশীর বাড়িতেও যেতে পারছিনা।

পরিচিত জন কিংবা প্রিয়জনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। মুঠোফোনে বড়জোর খোঁজ খবর নিতে পারছি কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত থাকছি স্বজনদের সঙ্গে। প্রকৃত সত্য হলো- আমরা সবাই ঘরে থাকতে থাকতে এখন বন্দি ভাবছি নিজেদের। প্রকৃতি কী তবে বন্দি করে রেখেছে আমাদের, এমন প্রশ্ন সকলের মনে উঁকি দিচ্ছে এই সময়ে। 

প্রকৃতি আমাদের আজ বন্ধু নয়। কেননা, আমাদের অত্যাচার দিনের পর দিন ধরে যুগের পর যুগ ধরে সয়ে গেছে প্রকৃতি। আমরা প্রকৃতিকে সামান্য গুরুত্বও দিইনি। সর্বদা অবহেলা করেছি। প্রকৃতি ছিল আমাদের ধর্তব্যেরও বাইরে।

আমারা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চেয়েছি, সেই বাসযোগ্য করতে গিয়ে নগরায়নের দিকে ঝুঁকেছি। বৃক্ষ নিধনে নেমেছি, নদী ধ্বংস করেছি, সমুদ্রকে বানিয়েছি আবর্জনার স্তূপ। পৃথিবীর পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো প্রতি বছর যে পরিমাণ পারমাণবিক বর্জ্য ফেলে পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি করে তা সীমাহীন, ভাবনারও তা যেন অন্ত নেই। বায়ুমণ্ডলে ওজনস্তর ক্ষয় হচ্ছে, সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে গহ্বর। দেখা দিয়েছে জীবজগতে প্রাণের সংশয়। শিশুরা আক্রান্ত হতে শুরু করেছে, বয়স্করাও আক্রান্ত হচ্ছে মরণ ব্যাধিতে।

সমস্ত কিছু কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে গিয়ে খেয়াল করছি না- এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। এমনি করে আমরা খেয়ে ফেলছি দক্ষিণারঞ্জন মিত্রর সেই ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের রাক্ষসদের মতো সবকিছু। একেবারে দুই আঙুলে চেপে মারতে চাইছি যেন পৃথিবীকে, পৃথিবীর সব প্রাণকে। প্রাণের একটা চক্র রয়েছে। প্রাণের সেই চক্রের কোনোটির জীবন যাপনে ব্যাহত হলে, বাকিগুলোরও জীবনের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়।  

কিছুকাল আগেই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সড়ক ‘যশোর রোড’-এর গাছ কাটার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশ কিংবা অন্য দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত আইন আদালত কিছুই মানেনি, ভাবেনি প্রকৃতির কথা। নিশ্চিন্তে তারা অনুমতি দিয়েছিল সড়কের দু’পাশের শতবর্ষী গাছগুলোকে কেটে ফেলবার।

শেষমেশ দেখা গেলো- সমাজের কিছু দায়িত্বশীল মানুষ সেই রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন, আদালতের কাছে গিয়েছেন। এমনি করেই সবখানেই এই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া সব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে হয়- শান্তিকামী পৃথিবীর মানুষদের। পৃথিবীর একমাত্র লোনাজলের বন আমাদের সুন্দরবন।

সেই সুন্দরবনের খুব কাছেই তৈরি হচ্ছে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বন তো কিছু করতে পারে না, মুখে মুখে প্রতিবাদ করতে পারে না, মানুষের ওপর তৎক্ষণাৎ চড়াও হওয়ার সাধ্যও তার নেই। তবে বৃক্ষরা শেষ হয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ ঠিকই নেয় কোনো এক সময়। ক্ষতিকর বর্জ্য আর রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় এই বনও একদিন শেষ হয়ে যাবে- মানুষ তার প্রাণ বাঁচানোর অক্সিজেন ধ্বংস করে ঘরে আলো জ্বালবে, মানবসভ্যতার উন্নয়ন ঘটাবে, শিল্পে উন্নয়ন ঘটাবে, বাণিজ্য করবে- রাষ্ট্রের মাথা উঁচু হবে সত্যিই তাই, নাকি শেষ হবে ধীরে ধীরে নিজের প্রাণ? এ সব প্রশ্ন করার নয় আজ, প্রকৃতির পৃথিবী সব সময় তার প্রতি অন্যায় অপরাধের প্রতিবাদ করে ভিন্নরূপে ভিন্নভাবে। 

বহু বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল এক মহামারি আজকের মতো করোনা ভাইরাস রূপে নয়। সেটা ছিল- প্লেগ, গুটি বসন্ত, টাইফয়েড, কলেরা আরও অনেক রূপে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে। তখনো মানুষ মরেছে অগুনতিতে। ছিল না কোনো প্রতিষেধক, ছিল না আজকের মতো এমন সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও।

টাইফয়েড নিয়ে ১৯০৬ সালে একটি ঘটনা ঘটেছিলো- ঘটনার কেন্দ্র ছিলো এক রাঁধুনি মেয়ে। মেয়েটির নাম মেরি ম্যালন। বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করতেন; কিন্তু হাত ধুতেন না, পরিচ্ছন্ন থাকতেন না। এই অপরিষ্কার থাকার কারনেই সংক্রমণে মোট ৫৩ জন রোগাক্রান্ত হয়েছিলেন তার মাধ্যমে। মারা গিয়েছিলেন চারজন। নির্জন দ্বীপে ২৮ বছর কোয়ারেন্টিনে ছিলেন তিনি। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন টাইফয়েডে। তার কারণে মেরির নাম হয়ে গিয়েছিল- টাইফয়েড মেরি। সেই সময়ে আমেরিকার ঘুম যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল টাইফয়েড থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।

আজকের দিনেও মানুষ মরছে দেশে দেশে। মানুষ ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠছে, কিন্তু মানুষ বুঝতে পারছে না তার ভুল। কেবলই দোষারোপ করে চলেছে এক দেশ আরেক দেশকে, এক সরকার আরেক সরকারকে। রোজকার খবরে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ধনীরা খাবার গুদামজাত করছে, লুকিয়ে রাখছে।

আবার একশ্রেণির লোভী মানুষ খাবার দেয়ার নাম করে সেসব ‘পুকুরচুরি’ করছে। দায়িত্বশীল লোকেরা থাকছেন নিশ্চিন্তে- অনলাইন বক্তব্যে আর ভিডিও বার্তায়। শত বছর আগে তো এমন ই-রাজ্য ছিলো না; কিন্তু তখনকার দিনেও স্বার্থপর রাজা ছিলো। যে তার প্রিয় লোকজনদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল গোপনে এমন ঘটনা গল্পে পড়েছি। শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে মানুষ আজকের দিনে খাদ্যাভাবে ধুঁকছে, দুর্বল হয়ে পড়ছে- করোনা প্রতিরোধ করা যেন তাদের শরীরে সাধ্য নয় এমন অবস্থা।

সমাজের দর্পণ সাহিত্য। যারা লেখেন সমাজের সব কিছু নিয়ে তারাই সাহিত্যিক। সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, রোগ বালাই, অন্যায়, অত্যাচার, মহামারি সব উঠে আসে তাদের কলমে। তাদের চোখে সব ধরা পড়ে। ‘অন্ধের শহরে আয়না বেচতে’ আসা এই সব সাহিত্যিকরাই আজকের দিনের করোনাক্রান্ত সময়েও লিখছেন, যেমন লিখেছিলেন পূর্বেকার সময়গুলোতে সে সময়ের লেখকরাও।


পৃথিবীজুড়ে ভাইরাস, মহামারি, দুর্ভিক্ষের উপস্থিতি নিয়ে অসংখ্য সাহিত্য তৈরি হয়েছে। পৃথিবীখ্যাত মহাকবি হোমার রচিত মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’। এখানে কাহিনিতে দেখা যায়- অ্যাগামেনন ক্রিসেইসকে বন্দি করার শাস্তিস্বরূপ গ্রিকদের শায়েস্তা করতে ট্রয় নগরীতে প্লেগ নামক মহামারি পাঠানো হয়। বিখ্যাত কথাকার আলব্যেয়র ক্যামুর লেখা ‘দ্য প্লেগ’।


‘প্লেগ’ নামের এই রচনায় দেখা যায়- আলজেরিয়ার ছোট্ট এক শহর ওরাও। সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিলেন সেই শহরের মানুষ। হঠাৎ একদিন শহরে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হলো। ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষও ইঁদুর মারতে শুরু করলো। প্রথমে মানুষ মরা ইঁদুরগুলোকে ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ফেলতে লাগলো। একসময় শহরের সব ইঁদুর মারা গেলো। কিন্তু ইঁদুর থেকে পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়লো এক মহামারি।


ক্যামু ছাড়াও মহামারি নিয়ে কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। এ উপন্যাসও শুরু হয়েছে একটি সদ্য মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে। এ ছাড়া মহামারি নিয়ে রয়েছে স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য স্ট্যান্ড’ (১৯৭৮)। দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক ডোয়েন মেয়ারের ‘ফিভার’ (২০১৬)। লিং মা-এর ফিকশনাল নভেল সিভিয়ারেন্সে রয়েছে- ‘শন ফিভার’ নামের কাল্পনিক মহামারির কথা। মহামারি নিয়ে আরেক বিখ্যাত উপন্যাস হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’।


ইতালির লেখক জোবান্নি বোকাচ্ছোর গল্প সঙ্কলন ডেকামেরন (১৩৫৩)-এ তিনি লিখেছেন- ১৪শ’ শতকে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে ব্যাক প্লেগ নামক মহামারিতে মৃত্যু নিয়ে গল্প। লোকজন প্লেগের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে ইতালির ফ্লোরেন্সের বাইরে একটি বাড়িতে দুই সপ্তাহের জন্য আশ্রয় নেয়। ‘ব্লাক ক্যাট’ খ্যাত কালজোড়া আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালেন পো ছোট গল্প লেখেন- ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’ নামে। গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালে।

এতে পো দুর্যোগ কিংবা মহামারি রোধে কর্তৃপক্ষের যথাযথ কার্যক্রম নিতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি দেখিয়েছেন। রোমকূপ থেকে রক্ত বের হয়ে মানুষজন মারা যেত। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে রাজা প্রসপারো ‘রেড ডেথ’ নামক মহামারি থেকে রক্ষা পেতে তার সভাসদদের নিয়ে এক আবদ্ধ মাঠে আশ্রয় নেন এবং একমাত্র লোহার গেটটাও বন্ধ করে দেন। নিশ্চিতে রাজা ও অন্যরা আনন্দ ফুর্তিতে মশগুল হন। ছদ্মবেশী বল নামক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে হই-হুল্লোড়ের মধ্যে ছদ্মবেশী এক আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটে যে আগন্তুক রাজাসহ বাকিদের হত্যা করেন সেখানে।

সম্প্রতি করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় লেখক সিলভিয়া ব্রাউনি ও লিন্ডসে হ্যারিসন রচিত- ‘অ্যান্ড অব দ্য ডেজ: প্রেডিকশন অ্যান্ড প্রোফেসিস অ্যাবাউট দ্য অ্যান্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের গ্রন্থটির বিক্রি বেড়েছে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত হওয়া এই গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল-২০২০ সাল নাগাদ এক ধরনের নিউমোনিয়া রোগ সারাবিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। সম্ভবত সাহিত্যপ্রিয় মানুষ গ্রন্থটি কিনেছেন এই কারণেই।

কেননা করোনাভাইরাসও তো মহামারিরূপে হাজির হয়েছে। যেমন বিক্রির শীর্ষে উঠে এসেছে ক্যামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি প্রকাশের ৭৩ বছর পর ফের।

সাহিত্যের দুনিয়ায় করোনাভাইরাস নিয়ে নতুন নতুন সাহিত্য রচিত হচ্ছে। উঠে আসছে বিশ্বের নানান দিকের করোনাক্রান্ত সমাজের না বলা সব কথা। আজকের দিনে নিজেকে যেমন রক্ষা করতে হবে, তেমন পাশের মানুষটিকেও রক্ষার জন্য সব ব্যবস্থাও রাখতে হবে। সাহিত্যের দুনিয়ায় মহামারি যেভাবে উঠে এসেছে, তা পাঠ করলেই বোঝা যায়। তবে সব কিছুর আগে প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে আমাদের- যাতে পুনরায় আর মহামারি না আসতে পারে আমাদের এই আলোর পৃথিবীতে, সাহিত্যের দুনিয়ায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //