নজরুলের ইসলামী সংগীত সৃষ্টির নেপথ্য ইতিহাস

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার ইসলামী সংগীতে দিয়েছেন নতুন প্রাণ নতুন সুর। তাঁর লেখা সংগীত ছাড়া বাংলা ভাষায় ইসলামী সংগীত ভাবাই যায় না। তাঁর সমসাময়িককালে কবি গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য দু’-একজন কবি ইসলামী সংগীত লিখলেও কাজী নজরুলই ইসলামী সংগীতের ভান্ডারকে কানায় কানায় পূর্ণ করেছেন। যা আজ ও আগামী প্রজন্মের জন্য নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করবে নি:সন্দেহে। 

কবির ইসলামী গান প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তার নজরুল সাহিত্য বিচার গ্রন্থে ‘নজরুলের গান এবং তার বৈশিষ্ট্য প্রবন্ধে লিখেছেন- Òজরুল ইসলাম নানা রকম গান লিখেছেন। আধুনিক গান, গজল গান, ইসলামী গান, কীর্তন, রামপ্রসাদী, শ্যামা সংগীত ও বিভিন্ন রকম সংগীত। তিনি একা অজস্র ইসলামী গান লিখেছেন, এবং তাঁর ইসলামী গান সবিশেষ পরিচিত বলে আমরা ইসলামী গান শুনলেই মনে করি সেটা নজরুলের। ইসলামী গান গোলাম মোস্তফা সাহেবও লিখেছিলেন এবং আরও অখ্যাত কবি কেউ কেউ। কিন্তু নজরুলের মতো সামগ্রিকভাবে জনচিত্ত গ্রাস করতে পারেননি তারা কেউ। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের গানের ভেতরে আছে উন্নত উপমা, চিত্রকল্প, দর্শন। সেই সঙ্গে সুরে সুরে আছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের খেয়াল, ঠুংরি ও টপ্পার সংমিশ্রণ। নজরুলের আগে বাংলায় কেউ গজল গান লেখেননি। বাংলার আনাচে-কানাচে যে গজল গান ছড়িয়ে পড়েছিল। সুরের মূর্ছনায় তা সবই নজরুলের।Ó

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩০ পরবর্তী সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সাহচর্যে আসার পর থেকে লোকগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদের তাগিদে ইসলামী গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য তিনি লিখলেন- 

ক) ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ

খ) ইসলামের ঐ সওদা নিয়ে, এলো নবীন সওদাগর।

আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গান দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি বের করলে শ্রোতারা তা লুফে নেয়। কবি নজরুলই মুসলমান জনগোষ্ঠীর চোখের মণি হয়ে ওঠেন। এই গান এখনো আমাদের রোজার শেষে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাথে সাথে হৃদয়কে সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে দেয়। এই গান ছাড়া ঈদ আমাদের অসম্পূর্ণ মনে হয়। এর পর থেকে তিনি ইসলামী গান একের পর এক রচনা করতে থাকেন।

হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর দুনিয়াতে আবির্ভাবের মুহূর্তটিকে তার কল্পনার জগতের মাধুরী মিশিয়ে লিখলেন অপূর্ব একটি গান- 

“তোরা দেখে যা আমিনা / মায়ের কোলে, যেন ঊষার কোলে / রাঙা রবি দোলে ”

আরেকটি গানে লিখলেন- 

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ/ এলোরে দুনিয়ায়/ আয়রে সাগর আকাশ-বাতাস/ দেখবি যদি আয়।

অন্যখানে লিখলেন- বক্ষে আমার কাবার ছবি/ চক্ষে মোহাম্মদ রাসূল।

‘মোহাম্মদের নাম জপেছিলি/ বুলবুলি তুই আগে/ তাই কিরে তোর কণ্ঠের ও গান/ এত মধুর লাগে।

এ ছাড়াও তিনি অন্য এক গানে লিখলেন-

আল্লাহ আমার প্রভু/ আমার নাহি নাহি ভয়/ আমার নবী মোহাম্মদ/ তাঁহার তারিফ জগৎময়।

‘শোনো শোনো ইয়া ইলাহি আমার মুনাজাত/ তোমারই নাম জপে যেন হৃদয় দিবস-রাত।

ইসলামের প্রতি তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা, শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখতে পাই তিনি যখন আল্লাহর কাছে যাওয়ার ব্যাকুল আশায় মগ্ন তখন তিনি লেখেন-

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন কবর থেকেও মুয়াযযিনের আজান শুনতে পাই। মসজিদের পাশেই তাঁর কবর হয়েছে। 

কবি আল মাহমুদ কাজী নজরুল সম্পর্কে বলেছেন, কাজী সাহেব উপরে ছিলেন সাধারণ মানুষ আর ভিতরে ছিলেন দারুণ ক্লাসিক্যাল। এই ক্লাসিক্যাল মানুষটি কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র কবিই ছিলেন না, বাংলা সাহিত্যের চির দৃপ্তমান উজ্জ্বল নক্ষত্র। লেটো গানের দলের দুখু মিয়া একাধারে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সাংবাদিক, সম্পাদক, সৈনিক, ইমাম, মুয়াযযিন, রুটির কারিগর, বাদক, সংগঠক ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। 

এক.

শুরুতেই বলছিলাম, কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফেনের রেকর্ডের জন্য আব্বাস উদ্দিনের অনুরোধে ইসলামী গান লেখায় মনোনিবেশ করেন। আব্বাসউদ্দিন নিজের আত্মজীবনী ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা’  গ্রন্থে নজরুলের ইসলামী সংগীত লেখার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। শ্যামা সংগীতের রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছেন। যাত্রাপথে তাঁর পথ আগলে ধরেন সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদ। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে তিনি এগুতে দিবেন না।

আব্বাস উদ্দীন নজরূলকে সম্মান করেন, সমীহ করে চলেন। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকেন। নজরুল বললেন, ‘বলে ফেলো তোমার আবদার।’ আব্বাস উদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। দেখুন না, পিয়ার কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।’

বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিলো শ্যামা সংগীতের। শ্যামা সংগীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দু নাম ধারণ করেন। মুন্সী মহম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সংগীত গাইলে গান চলবে না।

নজরুল নিজেও শ্যামা সংগীত লেখেন, সুর দেন। গানের বাজারের যখন এই অবস্থা তখন আব্বাস উদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী উত্তর দেবেন? ‘ইসলাম’ শব্দটার সঙ্গে তো তাঁর কতো আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন,কোরআন শিখেছেন এমনকি তাঁর নিজের নামের সঙ্গেও তো ‘ইসলাম’ আছে।

আব্বাস উদ্দীনকে তো এই মুহূর্তে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলা যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে সুর মেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। আবেগে গা ভাসালে চলবে না। গান রেকর্ড করতে হলে তো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য আবার ভগবতী বাবুর কাছে যেতে হবে। ভগবতী বাবু হলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ। নজরুল বললেন, আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা। আব্বাস উদ্দীন ভাবলেন, এইতো, কাজীদার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলাম, ভগবতী বাবুকে কিভাবে রাজী করাতে হয় সেটা এখন দেখবেন।

গ্রামোফোনের রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে আব্বাস উদ্দীন অনুরোধ করলেন। কিন্তু, ভগবতী বাবু ঝুঁকি নিতে রাজী নন। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাস উদ্দীন আহমদ যতোই তাঁকে অনুরোধ করছেন, ততোই তিনি বেঁকে বসছেন। ঐদিকে আব্বাস উদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এতো বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না। অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয়মাস চললো অনুরোধ প্রয়াস। এ যেন পাথরে ফুলফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা!

একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাস উদ্দীন আহমদ বললেন, ‘একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?’ ভগবতী বাবু আর কতো ‘না’ বলবেন। এবার হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।’ আব্বাস উদ্দীনের খুশিতে চোখে পানি আসার উপক্রম! যাক, সবাই রাজী। এবার একটা গান নিয়ে আসতে হবে।

নজরুল চা আর পান পছন্দ করেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাস উদ্দীন নজরুলের রুমে গেলেন। পান মুখে নজরুল খাতা কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাস উদ্দীন আহমদ অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মতো সময় যেন থমকে আছে। সময় কাটানোর জন্য আব্বাস উদ্দীন পায়চারী করতে লাগলেন।

প্রায় আধ ঘন্টা কেটে গেলো। বন্ধ দরজা খুলে নজরুল বের হলেন। পানের পিক ফেলে আব্বাস উদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন। এই কাগজ তাঁর আধ ঘন্টার সাধনা। আব্বাস উদ্দীন আহমদের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল। আব্বাস উদ্দীন খান কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন:-

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।”

আব্বাস উদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি কি জানতেন, তাঁর হাতে বন্দী গানটি একদিন বাংলার ইথারে ইথারে পৌঁছে যাবে? ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে বেজে উঠবে- ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে?

দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেলো। আব্বাস উদ্দীন আহমদ জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তাঁর মুখস্তও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কিনা এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি শঙ্কায় আছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কিভাবে সুর দিতে হবে দেখিয়ে দিলেন।

হারমোনিয়ামের উপর আব্বাস উদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই। সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে বের হলো- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। ঈদের সময় গানের এ্যালবাম বাজারে আসবে। আপাতত সবাই ঈদের ছুটিতে।

রমজানের রোজার পর ঈদ এলো। আব্বাস উদ্দীন বাড়িতে ঈদ কাটালেন। কখন কলকাতায় যাবেন এই চিন্তায় তাঁর তর সইছে না। গানের কী অবস্থা তিনি জানেন না। তাড়াতাড়ি ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলেন।

ঈদের ছুটির পর প্রথমবারের মতো অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যতো এগুচ্ছেন, বুকটা ততো ধ্বক ধ্বক ধ্বক ধ্বক করছে। অফিসে গিয়ে কী দেখবেন?গানটা ফ্লপ হয়েছে? গানটা যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর জীবনেও ইসলামি গানের কথা ভগবতী বাবুকে বলতে পারবেন না। ভগবতী বাবু কেন, কোনো গ্রামোফোন কোম্পানি আর রিস্ক নিতে রাজি হবে না। সুযোগ একবারই আসে।

আব্বাস উদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এই যুবক গানটি কোথায় শুনলো? নাকি আব্বাস উদ্দীন আহমদ ভুল শুনছেন? না তো ? তিনি আবারো শুনলেন যুবকটি ঐ গানই গাচ্ছে। এবার তাঁর মনের মধ্যে এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো। অফিস ফিরে বিকেলে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে এবার দ্বিগুণ অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে। তারমধ্য থেকে একটা ছেলে গেয়ে উঠলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। আব্বাস উদ্দীন এতো আনন্দ একা সইতে পারলেন না। তাঁর সুখব্যথা হচ্ছে।

ছুটে চললেন নজরুলের কাছে। গিয়ে দেখলেন নজরুল দাবা খেলছেন। তিনি দাবা খেলা শুরু করলে দুনিয়া ভুলে যান। আশেপাশে কী হচ্ছে তার কোনো খেয়াল থাকে না। অথচ আজ আব্বাস উদ্দীনের গলার স্বর শুনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল বললেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে!

অল্প কয়দিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। ভগবতী বাবুও দারুণ খুশি। একসময় তিনি ইসলামি সংগীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলছেন, ‘এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও না!’ শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ।

বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সংগীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে সব ধর্মের মানুষকে। একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সংগীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সংগীত গাইবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। ধীরেন দাস হয়ে যান গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে যান সোনা মিয়া, হরিমতি হয়ে যান সাকিনা বেগম, সীতা দেবী হয়ে যান দুলি বিবি, ঊষারাণী হয়ে যান রওশন আরা বেগম। তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সংগীত গেয়েছেন। যেমন: অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষাল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়।

 দুই

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গান লেখার সহজাত প্রতিভা ছিলো। খাতা কলম দিয়ে যদি কেউ বলতো, একটা গান লিখুন, তিনি লিখে ফেলতেন। একদিন আব্বাস উদ্দীন নজরুলের বাড়িতে গেলেন। নজরুল তখন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীনকে হাতের ইশারায় বসতে বলে আবার লেখা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে যোহরের আযান মসজিদ থেকে ভেসে আসলো। আব্বাস উদ্দীন বললেন, ‘আমি নামাজ পড়বো। আর শুনুন কাজীদা, আপনার কাছে একটা গজলের জন্য আসছি।’

কবি শিল্পীকে একটা পরিস্কার জায়নামাজ দিয়ে বললেন, ‘আগে নামাজটা পড়ে নিন।’ আব্বাস উদ্দীন নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল খাতার মধ্যে কলম চালাতে শুরু করলেন। আব্বাস উদ্দীনের নামাজ শেষ হলে নজরুল তাঁর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নিন আপনার গজল!’ হাতে কাগজটি নিয়ে তো আব্বাস উদ্দীনের চক্ষু চড়কগাছ। এই অল্প সময়ের মধ্যে নজরুল গজল লিখে ফেলছেন? তা-ও আবার তাঁর নামাজ পড়ার দৃশ্যপট নিয়ে?

‘হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ, দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।’

নজরুলের লেখা ইসলামী গানগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। গানগুলো রচনার প্রায় নব্বই বছর হয়ে গেছে। আজও মানুষ গুনগুনিয়ে গানগুলো গায়। বাংলায় ইসলামি গানের যে নবজাগরণ নজরুল সূচনা করেছিলেন, যে পথ দেখিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই পথের পথিক হয়েছেন জসীম উদদীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক, বেলাল হোসাইন নূরী, তোফাজ্জল হোসাইন খান, আবদুর রাজ্জাক রাজু এবং হাল আমলের কবি মুহিব খান প্রমুখ।

তিন

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি অনেক গানে বিদেশী সুরের অনুসরণ করেছেন, আরবী, ফার্সি ভাষার শব্দের ব্যবহার করেছেন। গজল আঙ্গিকে তিনি লিখেছেন অনেক ইসলামী গান। তুরস্কের প্রায় পাঁচশো বছরের পুরানো বিখ্যাত ‘কাটিবিম উসকুদার’ গানটির সুর অনুসরণে তিনি লিখেছেন, ত্রিভূবনের  প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়, আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়। নজরুল ছাড়া গানে সীমানা ছাড়িয়ে ভাষার ব্যবহার করার দু:সাহস আর কেউ দেখাতে পারেনি। নজরুলের এই দু:সাহসিকতাই আর আব্বাসউদ্দিনের নিরলস চেষ্টাই বাংলা গানে ইসলামী সংগীত শ্রোতাদের মনে আলাদা আবেদন তৈরী করতে সক্ষম হয়।

লেখার তথ্যসূত্র:

১। আব্বাসউদ্দীনের আত্মজীবনী  ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা’।

২। শাহাবুদ্দীন আহমদ এর  ‘নজরুলের গান এবং তার বৈশিষ্ট্য” গ্রন্থ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //