‘মাসুদ রানা’র ২৬০টি বই শেখ আবদুল হাকিমের: কপিরাইট অফিস

কয়েক দশক ধরে জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র অধিকাংশ বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নয়, শেখ আবদুল হাকিম।

পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আবদুল হাকিমের কাছ থেকে লেখা নিয়ে আনোয়ার হোসেন নিজের নামে প্রকাশ করতেন বলে জানিয়েছে কপিরাইট অফিস।

কপিরাইট অফিসের এই ঘোষণার পর দুই পক্ষই আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।  

এতদিন পাঠকরা জানতেন, মাসুদ রানা সিরিজের সব বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন আর তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেবা প্রকাশনী। তাই এই খবরে পাঠকরাও ধাক্কা খেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

গত বছর জুলাইয়ে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব দাবি করে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল করেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম।

তিন দফা শুনানি, দুই পক্ষের যুক্তি-পাল্টা যুক্তি ও তৃতীয় পক্ষের বক্তব্যের আলোকে গত রবিবার কপিরাইট অফিসের এক রায়ে বলা হয়েছে, সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেন কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘন করেছেন।

কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী জানান, মাসুদ রানা সিরিজের প্রায় ৪৫০টি বইয়ের মধ্যে ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের দেয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তিনিই বইগুলোর লেখক। সেই সাথে কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখকও তিনি।

তিনি আরো বলেন, সেগুলোর মধ্যে আগেই তার নামে ছয়টি বইয়ের কপিরাইট করা ছিল। বাকি বইগুলোও নিজের নামে স্বত্বের জন্য কপিরাইট অফিসে আবেদন করতে পারেন।

পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি ও কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের প্রকাশ বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য সেবা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছে কপিরাইট অফিস। সেই সাথে আবদুল হাকিমের নামে কপিরাইট নিবন্ধনকৃত প্রকাশিত বইগুলোর বিক্রিত কপির সংখ্যা ও বিক্রয় মূল্যের হিসাব বিবরণী আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ রায়ের বিরুদ্ধে আনোয়ার হোসেন আগামী ৩০ দিনের মধ্যেই কপিরাইট অফিসে আপিল করতে পারবেন বলে জানান জাফর।

আবদুল হাকিম বলেন, মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে অবশেষে স্বীকৃতি পেলাম। এখন এই বইগুলো বিক্রি বাবদ পাওনা অর্থ আমি ফেরত চাই।

পাওনা টাকা যদি না দেয়া হয় তাহলে তিনিও আদালতে যাবেন। তিনি বলেন,যদি সমঝোতা হয়, তাহলে আর মামলার প্রয়োজন হবে না। আমি তো আমার প্রাপ্য টাকার জন্য আইনের আশ্রয় নিতেই পারি।

অপরদিকে আনোয়ার হোসেন কপিরাইট অফিসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আদেশের মূল কপি হাতে পেলেই আপিল করবো। আমি পক্ষপাতের শিকার।

কপিরাইট অফিসের মূল কথা হলো, লেখকস্বত্ব কখনোই বিক্রয় বা ক্রয়যোগ্য নয়। কেউ ব্যবসার স্বত্ব কিনতে পারেন, প্রকাশনাস্বত্ব কিনতে পারেন, কিন্তু লেখকস্বত্ব নয়। একজনের লেখা আরেকজনের নামে ছাপা বা প্রকাশ বেআইনি। একজনের মেধাস্বত্ব আরেকজনের হতে পারে না। ফলে মাসুদ রানা সিরিজ নিয়ে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে।

কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেছেন, কপিরাইট আইনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে৷ কিন্তু কপিরাইট অফিসের কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা নেই। এই শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত আদালতে যেতে হবে। ক্ষতিপূরণের মামলাও হতে পারে। আর শেখ আব্দুল হাকিমকে এই রায়ের ভিত্তিতে প্রতিটি বইয়ের আলাদা করে কপিরাইট নিবন্ধন করতে হবে।

এ পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের ৪৬৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কাজী আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি ১৯৬৫ সালে প্রথম মাসুদ রানা লেখা শুরু করেন। তিনি নিজে সরাসরি ২০টির মতো বই লিখেছেন। তবে পরপর নয়, বিভিন্ন সময়ে। বাকি বইগুলো লেখক প্যাানেল দিয়ে লিখিয়েছেন।

তিনি বলেন, মাসুদ রানা চরিত্রটি আমার সৃষ্টি। বিদেশি বই বাছাই করেছি আমি। এরপর লেখকদের আমার গল্পের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলেছি। তারা লিখে আনার পর আমার পছন্দ হলে কিনে নিয়েছি, টাকা দিয়ে দিয়েছি। তারপর সেটা আবার সম্পাদনা করে ছাপার উপযোগী করেছি। সিরিজের লেখকও আমি। আমার সিরিজে তো অন্য কেউ লেখক হতে পারে না।

শেখ আবদুল হাকিম স্বশিক্ষিত। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বলে তিনি জানান। তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে লেখা শুরু করেন, তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর।

তিনি বলেন, যখন লেখা শুরু করি, তখন আমি কপিরাইট বিষয়টি বুঝতাম না। আইন জানতাম না। আর আমার টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই টাকা পেয়েছি, লিখেছি। তিনি যা বুঝিয়েছেন তাই বুঝেছি। পরে তিনি রয়্যালিটিও দিয়েছেন। কিন্তু যা প্রাপ্য তা দেননি। তাই এখন প্রতিকার চেয়েছি।

তিনি লেখক না ডিকটেশন নিতেন জানতে চাইলে আবদুল হাকিম বলেন, আমিই লিখেছি। তার পক্ষে মাসে কিভাবে ১৮-১৯টি বই ডিকটেশন দেয়া সম্ভব?

লেখক প্যানেলে আরো কয়েকজন ছিলেন। আবদুল হাকিম ২০০০ সালের পর সেবা প্রকাশনী ছেড়ে দেন। গত বছরের ২৯ জুলাই তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেন।

মাসুদ রানা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একই ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছেন আরেক লেখক ইফতেখার আমিন। সেই অভিযোগও শিগগিরই নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানান জাফর রাজা চৌধুরী।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানা নতুন করে চলচ্চিত্রায়নও হচ্ছে। এর মধ্যেই সেবা প্রকাশনীর বিপক্ষে কপিরাইট অফিসের আদেশ এল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //