মাসুদ রানা কার?

‘বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভূত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। পদে পদে তার বিপদ-শিহরণ-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি।’ 

যারা ‘মাসুদ রানা’ পড়েছেন তাদের কাছে কথাগুলো বেশ পরিচিত। কত দিন টিফিন না খেয়ে, রিকশার বদলে হেঁটে বাঁচানো টাকায় অর্ডার করতাম মাসুদ রানা। সপ্তাহখানেক পর ডাকযোগে কড়া নাড়তো বইগুলো। নাওয়া-খাওয়া ভুলে এসব পেপারব্যাকে ডুব! হারিয়ে যাওয়া কল্পনার জগতে। প্রিয় মাসুদ রানার জন্য যে মায়ের হাতে কত মার খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। 

যুগে যুগে অসাধারণ ও কালজয়ী সব লেখক এসে আমাদের কথাসাহিত্যে নতুন নতুন ধারা যোগ করেছেন বা করছেন। সমৃদ্ধ এই বাংলা কথাসাহিত্যকে তারা নিয়ে গেছেন সুবিশাল উচ্চতায়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে রহস্য, গোয়েন্দা, থ্রিলারধর্মী কাজ খুবই কম, হাতেগোনা। তাই এক রকম সেই শূন্যস্থানে খুব সহজেই বসে যেতে পেরেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন ও তার সেবা প্রকাশনী। বাঙালি পাঠককে কিছুটা হলেও সাহিত্যের এ ধারার তৃষ্ণা মিটিয়েছেন তিনি। 

বাংলার প্রথম স্পাই থ্রিলারধর্মী সুপারহিরো চরিত্রটিও কাজী আনোয়ার হোসেনের এক অনবদ্য সৃষ্টি। বলা যায় বাঙালির ভালোবাসার সুপারহিরোর নাম ‘মাসুদ রানা’, যে কেবল দুর্ধর্ষ গুপ্তচর কিংবা গোয়েন্দাই নন, বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বপ্নের নায়কও বটে! সহায়ক চরিত্রে প্রথমেই আসে মেজর জেনারেল রাহাত খানের নাম, যিনি বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। স্বাধীনতার আগের বইগুলোতে অবশ্য সংস্থাটির নাম উল্লেখ থাকত পিসিআই (পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স) হিসেবে। সোহেল, সলিল, সোহানা, রূপা, গিলটি মিয়া চরিত্রগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ‘সোহানা’ হলো লেখকের কল্পনার বাঙালি মেয়ে, মাসুদ রানার ভালোবাসা। পাঠক ঘৃণাভরে স্মরণ করেন বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী, উ সেনদের। 

১৯৬৬ সালে ‘ধ্বংস পাহাড়’ দিয়ে শুরু, সেবা প্রকাশনী থেকে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের চার শতাধিক গুপ্তচরবৃত্তীয় কাহিনীর বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রধান চরিত্রটি মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ডের বাঙালি সংস্করণ। সিরিজের প্রথম দুটি মৌলিক হলেও, পরবর্তীকালে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত বইয়ের আধিক্য। 

তবে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজটি সাধারণ বাঙালি পাঠকের ঘরে যে একেবারে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। ষাট দশকের শুরুতে এ সিরিজের বইয়ে নর-নারীর বিবাহবহির্ভূত যৌনতার বিবরণ পাঠক সমাজকে কিছুটা হলেও থমকে দিয়েছিল। তখন ‘প্রজাপতি’ মার্কাওয়ালা (সেবা প্রকাশনীর লোগো) বইগুলো পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে এক প্রকার। তাই পড়তে হতো একেবারে দরজায় খিল দিয়ে! 

সম্প্রতিও একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে মাসুদ রানাকে নিয়ে। এ সিরিজের ‘ঘোস্ট রাইটার’ হিসেবে পরিচিত দুইজন লেখক শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিন অভিযোগ তুলেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা প্রকাশনীর বিরুদ্ধে। তাদের দাবি, তারাই বেশিরভাগ মাসুদ রানা লিখেছেন, কিন্তু রয়্যালটি পাননি চুক্তি অনুযায়ী। 

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মাসুদ রানা স্বত্ব নিয়ে মামলা লড়ছিলেন দুই লেখক। গত ১৪ জুন কপিরাইট অফিস এক আদেশে বলেছে, মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমের। এ খবরে রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছেন পাঠকরা। কারণ কয়েক দশক ধরে জনপ্রিয় এ থ্রিলার সিরিজটির লেখক হিসেবে তারা যে কাজী আনোয়ার হোসেনকেই জানেন। 

রায় দিয়ে কপিরাইট অফিস বলছে, লেখকস্বত্ব কখনোই বিক্রয় বা ক্রয়যোগ্য নয়। কেউ ব্যবসার স্বত্ব কিনতে পারেন, প্রকাশনাস্বত্ব কিনতে পারেন, কিন্তু লেখকস্বত্ব নয়। একজনের লেখা আরেকজনের নামে ছাপা বা প্রকাশ বেআইনি। একজনের মেধাস্বত্ব আরেকজনের হতে পারে না। ফলে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ নিয়ে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে। 

যদিও কপিরাইট অফিসের এমন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদেশের মূল কপি হাতে পেলেই আপিল করব। আমি পক্ষপাতের শিকার।’ 

পুরো বিষয়টি তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, ‘মাসুদ রানা তো অ্যাডাপটেশন। এটার মূল লেখা আমার না, আমাদের লেখক প্যানেলেরও না। মাসুদ রানা চরিত্রটি আমার সৃষ্টি। তাতে রাহাত খান, সোহেল, সোহানা ইত্যাদি জনপ্রিয় চরিত্র আছে; একটা বিশেষ ঢঙে সেগুলো আমিই তৈরি করেছি। পাঠক সাদরে গ্রহণ করল। এভাবেই চলছিল। একটা সময়ে আমি আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। ব্যবসা-বাণিজ্যও দেখতে হচ্ছে। তখন আমি শেখ আবদুল হাকিমকে বললাম- আপনি লিখতে চান এটা? আমিই বলে দেব, ঠিক কীভাবে লিখতে হবে। কীভাবে চরিত্র হবে। আর সে অনুযায়ী যদি লিখেন, তাহলে আপনাকে এককালীন টাকা দেব ও এটার ওপর আপনার কোনো রাইট থাকবে না। কারণ মাসুদ রানা সিরিজটা আমার, এটা তো আর আপনার নামে প্রকাশ করা যাবে না। আমার সব শর্তে আবদুল হাকিম রাজি হন। এরপর টানা ৪৫ বছর ধরে লিখলেন সেবা প্রকাশনীতে। নানা ধরনের বইও তিনি লিখেছেন। সেগুলো কিন্তু তার নামেই গেছে। শুধু মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজে আমার নামে গেছে। এগুলো লিখে আনার পর টাকা দিয়ে দিয়েছি। তারপর সেটা আবার সম্পাদনা করে ছাপার উপযোগী করেছি।’

এ প্রসঙ্গে শেখ আবদুল হাকিম বলেন, ‘যখন লেখা শুরু করি, তখন আমার বয়স ১৮ বছর। কপিরাইট বিষয়টি বুঝতাম না। আইন জানতাম না। তখন আমার টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই টাকা পেয়েছি, লিখেছি। তিনি যা বুঝিয়েছেন, তা-ই বুঝেছি। পরে তিনি রয়্যালিটিও দিয়েছেন; কিন্তু যা প্রাপ্য তা দেননি। যখন আইন জানলাম, তখন আমার চোখ খুলে গেছে। তাই এখন প্রতিকার চেয়েছি। যদি সমঝোতা হয়, তাহলে আর মামলার প্রয়োজন হবে না। আমি তো আমার প্রাপ্য টাকার জন্য আইনের আশ্রয় নিতেই পারি।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল জনপ্রিয় অনুবাদক ও লেখক প্রমিত হোসেনের সাথে, যিনি খুব কাছ থেকেই মিশেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিনের সাথে। 

মাসুদ রানার স্বত্ব নিয়ে মামলা করার বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তিনি, ‘ঘোস্ট রাইটারের কোনো নাম থাকে না বইয়ে, স্বত্ব থাকে না। লেখক-প্রকাশক বোঝাপড়া অনুযায়ী তাদের যত টাকা দিয়ে বিদায় করতে পারেন, তাতেই শেষ। লিখিত চুক্তিও থাকে না এতে কোনো। শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিনও ঘোস্ট রাইটার। এত বছর পর এসে জনপ্রিয় সিরিজ মাসুদ রানার স্বত্ব নিয়ে তাদের মামলা করার কোনো যুক্তিই নেই। কারণ এসব বই লেখার বিনিময়ে তারা প্রয়োজনীয় টাকা নিয়েছেন, বইয়ে তাদের নাম যাবে না- সে কথাতেই। তাছাড়া তাদের লেখা সম্পাদনা কিংবা রি-রাইট করেই নিজের নামে প্রকাশ করতেন কাজী আনোয়ার।’ 

মামলার রায় প্রকাশের পর থেকেই কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখকসত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে প্রমিত হোসেন বলেন, ‘সোজাসাপ্টা করে, অল্প কথায় গুছিয়ে লেখার প্রয়াস কাজী আনোয়ার হোসেনের। বাংলা সাহিত্যে যিনি যোগ করেছেন একটি নতুন মাত্রা, এনেছেন রিপোর্টাজ ভাষা। শুধু আনলেনই না, প্রতিষ্ঠাও করেছেন এ ভাষা শৈলীকে; সেবা প্রকাশনীর বা সেবার ভাষা। এখন যারা তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা হয়তো বিষয়গুলো জানেন না। আর ঘোস্ট রাইটার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, অভিযোগের মানদণ্ডে তাকে মাপার কিছু নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //