পালামৌ: প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপের এক দীপ্তি

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৭ জুন ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁটালপাড়ায় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সঞ্জীব ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে মেঝো আর তাঁর দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন সাহিত্যিক, একজন বাংলায় রচিত প্রথম আধুনিক উপন্যাসের স্রষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন সাহিত্যিক পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পিতা যাদবচন্দ্র অতি গোঁড়া ব্রাহ্মণ হলেও সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং উদার মানসিকতা তৈরিতে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন। সে আমলে উত্তর চব্বিশ পরগণায় কথাসাহিত্য পরিবার নামে খ্যাত ছিলো তাঁর পরিবার।

শৈশবের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণের পরে সঞ্জীবচন্দ্র মেদিনীপুরে স্কুলে ভর্তি হন এবং শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিতার সুপারিশে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হলেও তিনি ইংরেজিতে ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সঞ্জীবচন্দ্র ‘বেঙ্গল রায়টস: দেয়ার রাইটস অ্যান্ড লায়াবিলিটিজ’ নামক একটি ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা করেন। বইটি ইংরেজ শাসকমহলে এতটাই প্রভাব বিস্তার করল যে, সঞ্জীবচন্দ্র কৃষ্ণনগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পেয়ে যান। কিন্তু শেষাবধি সে চাকরিও তাঁর থাকেনি। এসকল পরিস্থিতিতে সঞ্জীব ছিলেন সাহিত্যের প্রতি নিবেদিত এক প্রাণ। 

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘যাত্রা’ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি নিয়মিত বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। এই ধারাবাহিকতায় ১২৮৭ বঙ্গাব্দ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের মধ্যে ছয়টি পর্বে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’ প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে ১৩৫১ বঙ্গাব্দের বৈশাখে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়, সম্পাদনা ও মুদ্রাকর ছিলেন- ‘শনিবারের চিঠি’র শ্রীসজনীকান্ত দাস। 

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পালামৌ’ স্বল্পপরিসরে অনবদ্য, সরল এক ভ্রমণকাহিনি যেখানে আধুনিকতার গতিময়তা নেই, বর্ণনার বাহুল্য নেই কিন্তু আছে প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপের এক দীপ্তি, যা এই ভ্রমণকাহিনিকে অনেকাংশে সার্থকতা দান করেছে।

লেখক এই ভ্রমণ কাহিনিকে হয়তো সুবিন্যস্ত করতে পারেননি, কিন্তু তিনি যেখানে যতটুকু দরকার তারচেয়ে বেশি বৈ কম দেননি। আদিম ‘কোল’ জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা, আচার-ব্যবহার প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই আছে তাঁর রচনার পরতে পরতে। তারপরও এই লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে হঠাৎ হঠাৎ মনে আসা স্মৃতির অংশ বিশেষ, যা এই লেখাকে সার্থক করতে অনেকখানি বাধাগ্রস্ত করেছে। কিন্তু তারপরও সেখানেই লেখকের অভিনবত্ব। ব্যতিক্রম আবেদন এই বইয়ের সেই দোষগুলোকে ঢেকে দিয়েছে সুনিপুনভাবে। ভাষার সার্থক প্রয়োগ, উপমার বর্ণচ্ছটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে নিয়ে গিয়েছে এই ভ্রমণ কাহিনিকে। সাবলীল বর্ণনায় এই রচনা পেয়েছে আলাদা মাত্রা। 

লেখক এখানে তাঁর ভাবনার সাথে পাঠকের মিল হবে কি হবে না তা ভাবেন নি। যা মনে হয়েছে, যা তিনি উপলব্ধি করেছেন তাই উঠে এসেছে তাঁর লেখনিতে। ‘সেই নির্জন স্থানে মনকে একা পাইতাম, বালকের ন্যায় মনের সহিত ক্রীড়া করিতাম। এই পাহাড়ের ক্রোড় অতি নির্জন, কোথাও ছোট জঙ্গল নাই, সর্বত্র ঘাস। অতি পরিষ্কার, তাহাও বাতাস আসিয়া নিত্য ঝাড়িয়া দেয়। মৌয়া গাছ তথায় বিস্তর। কতকগুলি একত্রে গলাগলি করে বাস করে, আর কতকগুলি বিধবার ন্যায় এখানে সেখানে একাকী থাকে, তাহারই মধ্যে একটিকে আমি বড় ভালোবাসিতাম, তাহার নাম ‘কুমারী’ রাখিয়াছিলাম। তখন তাহার ফল কি ফুল হয় নাই, কিন্তু তাহার ছায়া বড় শীতল ছিলো। আমি সেই ছায়ায় বসিয়া ‘দুনিয়া’ দেখিতাম।’এই বর্ণনায় নেই কোন কাঠিন্য কিন্তু লেখকের চিন্তা, তার মনের অবস্থা সবটুকুই প্রতীয়মান। আজ আমাদের কাছে যার কোন দায় নেই- কাল সেই আমাদের গভীর ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়, মনকে শান্ত করে, বর্তমানকে ভালবাসতে শেখায়। তাই এই ভ্রমণ কাহিনির শেষাংশে উঠে এসেছে ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভ। যার প্রকাশ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে তাঁর ভ্রমণকাহিনির শেষ ছত্রে- ‘আমাদের দেশী মদ একবার বিলাতে পাঠাইতে পারিলে জন্ম সার্থক হয়, অনেক অন্তর জ্বালা নিবারণ হয়।’ কারণ দেশি মদে নেশা আছে। আর ইংরেজরা সেই নেশার ঘোরে একটিবার তাদের অন্যায় স্বীকার করে নিলে ইতিহাস হয়তো অনেকখানিই পাল্টে যেত, তাই হয়তো লেখক বোঝাতে চেয়েছেন।

‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ বিখ্যাত, শাশ্বত ও চিত্তাকর্ষক এই বাক্যটি ছেলেবেলাতেই মুগ্ধ করে রেখেছিল,  ‘পালামৌ’ গ্রন্থটিকে এই একটি বাক্যই যেন সার্বজনীন খ্যাতিতে অনবদ্য করে তুলেছে। গ্রন্থটিতে মনে রাখার মতো এমন কিছু বাক্য রয়েছে যা জীবনের প্রতি পদে স্মরণীয়। বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রত্যেক প্রথিতযশা সমালোচক গ্রন্থটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আধুনিক সাহিত্য’ নামক গ্রন্থে সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ সম্পর্কে সুবিস্তৃত বলেছেন। রবি ঠাকুরের সেই আলোচনা নিশ্চয়ই সকলের পাঠ্য-সুপাঠ্য। 

এখানে সেই আলোচনা থেকে কিয়দংশ উল্লেখ করতে পারি, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘পালামৌ ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি সঞ্জীবচন্দ্রের যে একটি অকৃত্রিম সজাগ অনুরাগ প্রকাশ পাইয়াছে এমন সচরাচর বাংলা লেখকদের মধ্যে দেখা যায় না। সাধারণত আমাদের জাতির মধ্যে একটি বিজ্ঞবার্দ্ধক্যের লক্ষণ আছে-আমাদের চক্ষে সমস্ত জগৎ যেন জরাজীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সৌন্দর্যের মায়া-আবরণ যেন বিস্রস্ত হইয়াছে-এবং বিশ্বসংসারের অনাদি প্রাচীনতা পৃথিবীর মধ্যে কেবল আমাদের নিকটই ধরা পড়িয়াছে। সেই জন্য অশন বসন ছন্দ ভাষা আচার ব্যবহার বাসস্থান সর্ব্বত্রই সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের এমন সুগভীর অবহেলা। কিন্তু সঞ্জীবের অন্তরে সেই জরার রাজত্ব ছিল না। তিনি যেন একটি নূতনসৃষ্ট জগতের মধ্যে একজোড়া নূতন চক্ষু লইয়া ভ্রমণ করিতেছেন। “পালামৌ”তে সঞ্জীবচন্দ্র যে বিশেষ কোনো কৌতূহলজনক নূতন কিছু দেখিয়াছেন, অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্ব্বত্রই ভালবাসিবার ও ভালো লাগিবার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন।

“পালামৌ” দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্রকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবোধ থাকিলে জগতের সর্ব্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্যের সুধাভাণ্ডার উদঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাঁহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে-কৃষ্ণবর্ণ কোলরমণীই হৌক, বনসমাকীর্ণ পর্ব্বতভূমিই হৌক্, জড় হৌক, চেতন হৌক, ছোট হৌক্, বড় হৌক সকলকেই একটি সুকোমল সৌন্দর্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে।...’  

গদ্যসাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই তাঁর অগ্রজ সম্পর্কে আক্ষেপ করেন, কেননা সঞ্জীবচন্দ্র সাহিত্যের নবজাগরনের জন্য যেভাবে সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত ছিলেন- ঠিক সেই মূল্যায়ন তাঁর হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর দাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে নিয়ে লেখেন- ‘প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই জীবিতকালে আপন আপন কৃতকার্যের পুরস্কারপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন। অনেকের ভাগ্যে তাহা ঘটে না। যাহাদের কার্য দেশ ও কালের উপযোগী নহে, বরং তাহারা অগ্রগামী, তাহাদের ভাগ্যে ঘটে না। যাহারা লোকরঞ্জন অপেক্ষা জনহিতকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তাহাদের ভাগ্যেও ঘটেনা। যাহাদের প্রতিভার এক অংশ উজ্জ্বল, অপর অংশ ম্লান, কখনো ভস্মাচ্ছন্ন, কখনো প্রদীপ্ত- তাহাদের ভাগ্যেও ঘটে না।...’

কিন্তু এটাও ঠিক যে, পালামৌ- বাংলা সাহিত্যের একটি কিংবদন্তী গ্রন্থ, যে গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করা যায় নতুনভাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //