কোন পথে লেবানন?

লেবাননে প্রায় দুই সপ্তাহ গণআন্দোলনের মুখে ২৯ অক্টোবর দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগ করেন। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে কল করার ওপর প্রতিদিন ২০ সেন্ট করে (মাসে ৬ ডলার) করারোপ করাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রবল জনরোষে রূপ নেয়। লেবাননের অর্থনৈতিক দীনতা এবং দুর্নীতির সঙ্গে এ সমস্যার মূলে থাকা ভূরাজনৈতিক দিকগুলোও দেখতে হবে। মারোনাইট খ্রিষ্টান, শিয়া মুসলিম, সুন্নী মুসলিম, আলাওয়াতি, দ্রুজ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত এই দেশের ওপরে অন্যান্য শক্তিশালী দেশের প্রভাব প্রবল। ১৯১৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অঞ্চল ফ্রান্সের অধীনে চলে যায়। লেবাননে ফরাসি প্রভাব তাই এখনো প্রবল। লেবাননের সমস্যার মাঝে তাই ফরাসিরাই সবচেয়ে বেশি সরব। আবার লেবাননের সুন্নী মুসলিম রাজনীতিবিদদের সমর্থন দেয় সৌদি আরব, আর শিয়াদের একাংশকে হিজবুল্লাহর মাধ্যমে সমর্থন দেয় ইরান।   

প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে বলে মত ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-ইভস লে ড্রিয়ানের। গত ২৯ অক্টোবর ফরাসি পার্লামেন্টে তিনি লেবাননের ক্ষমতাসীনদের দেশটির জাতীয় ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে দেশটির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটাকেও টিকিয়ে রাখারও আহ্বান জানান তিনি। লে ড্রিয়ান লেবাননের সমস্যা সমাধানে ফ্রান্সের সহায়তা দানের কথাও বলেন। ৩১ অক্টোবর তিনি আরেক বিবৃতিতে বলেন, লেবাননে খুব দ্রুত নতুন সরকার গঠন জরুরি, যাদের কাজ হওয়া উচিত সংস্কার। ফ্রান্স সেডার কনফারেন্সের কাঠামোর মাঝে লেবাননকে সহায়তা করতে চায়। অন্যদিকে, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস লে ড্রিয়ানের সুরেই বলেন যে, লেবাননের সমস্যা পুরো অঞ্চলের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানি চাইছে না যে, হারিরির পদত্যাগে কোনো রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হোক।

সেডার কনফারেন্সটা আসলে কি, যা নিয়ে লে ড্রিয়ান কথা বলছেন? ‘সিইডিআরই’ এর অর্থ হলো উন্নয়ন, সংস্কার এবং ব্যবসার জন্যে অর্থনৈতিক আলোচনা। ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল প্যারিসে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সের ফলাফল হিসেবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ লেবাননকে ১১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে দাতারা চাইছিলেন সংস্কার। মাখোঁ বলেন, এই সহায়তা লেবানিজ নেতাদের সামনে সংস্কার করার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার অভূতপূর্ব এক দায়িত্ব হাজির করেছে। সংস্কার চলাকালীন ফ্রান্স লেবাননের পাশে থাকবে। দাতাদের এই সহায়তার মাঝে ছিল বিশ্ব ব্যাংকের ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ১.৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং সৌদি আরবের আগে প্রতিশ্রুত ১ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন। ফরাসিদের সমর্থক মিডিয়াগুলোও ফ্রান্সের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে। প্যারিসকেন্দ্রিক আল হায়াত পত্রিকার পরিচালক রান্দা তাকিয়েদ্দিন কিছুটা শক্তভাবেই বলছেন, সেডার কনফারেন্সে যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন লেবাননের জন্য শেষ ভরসা। তার মতে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ লেবাননকে বাঁচাতে যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আইএমএফের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তিনি বলছেন, অব্যবস্থাপনার কারণে লেবানন এক অনারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত, যা জন্ম দিয়েছে ভীষণ রকমের দুর্নীতির।

গত ১১ অক্টোবর আল জমহুরিয়া পত্রিকা জানায় যে, ফরাসিরা সেডার কনফারেন্সের অর্থ ১১ বিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার করতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির উপদেষ্টা আম্মার হুরি বলেন, নিজেদের সংস্কার কাজ এগিয়ে না নিতে পারলে সেডারের দাতাদেরকে তারা প্রতিশ্রুতি রাখার কথা বলতে পারেন না। ফ্রান্সের এই হুমকির ছয় দিনের মাথায় লেবাননের রাস্তায় শুরু হয় বিক্ষোভ। 

২০১১ সাল থেকে লেবাননের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ থেকে ৩ শতাংশের বেশি পার হতে পারছে না। দেশটির অর্থনীতি ঋণে জর্জরিত। লেবাননের ৫৪ বিলিয়ন ডলার জিডিপির দেড়গুণ হলো ঋণ। অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির হিসাবে, লেবানন রফতানি করে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, অপরপক্ষে আমদানি করে ২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। প্রধান আমদানি করা পণ্য হলো- জ্বালানি তেল, গাড়ি, ঔষধ, যন্ত্রপাতি, খাদ্যদ্রব্য, পোশাক এবং লোহা। 

প্রায় ৬১ লাখ জনসংখ্যার এই দেশে মাথাপিছু আয় প্রায় ১৪ হাজার ডলার। তবে আয় বৈষম্য চরম। ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেজের হিসাবে, লেবাননের ১ শতাংশ বিত্তশালীই এক-চতুর্থাংশ আয়ের উৎস। নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১০ শতাংশ মাত্র। জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শহরে এই সংখ্যা কিছুটা কম হলেও গ্রামাঞ্চলে তা প্রায় ৩৬ শতাংশ। বেকারত্ব উঠে এসেছে প্রায় ৩০ শতাংশে। ফিন্যানশিয়াল টাইমস জানায়, লেবানন সরকারের ঋণের ওপর গড়ে উঠেছে সেখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যেখানে বিনিয়োগ করেছে অতিধনীরা। আর এখন ফ্রান্সের স্পন্সর করা সেডার কনফারেন্সের শর্তানুসারে, সরকারকে বাজেট ঘাটতি কমাতেই হবে। হোয়াটসঅ্যাপ কলের উপরে শুল্ক আরোপ সরকারের আয় বাড়ানোর চেষ্টারই একটা ফলাফল। 

পশ্চিমা ঋণের শর্তপূরণে হিমশিম খাওয়া লেবানিজ সরকারের সামনে আয় বাড়ানো ও খরচ কমানো ছাড়া গতি নেই। আর এর চাপ সহ্য করতে হবে জনগণকে। লেবাননের বিভাজিত সমাজের ওপর এ চাপ বাইরের শক্তিগুলোর জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে। ডয়েচে ভেলে মনে করিয়ে দিচ্ছে, লেবাননের ইরান-সমর্থিত গ্রুপ হিজবুল্লাহ প্রথমদিকে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিলেও সাদ হারিরির পদত্যাগ তারা পছন্দ করেনি। হারিরির পদত্যাগে একটা রাজনৈতিক শূন্যতার ভয় পেয়ে বসেছে হিজবুল্লাহকে। সৌদি আরব এর আগেও লেবাননকে সহায়তা দেওয়া স্থগিত করেছিল, যাতে হিযবুল্লাহ এর সুবিধা না নিতে পারে। সৌদিরা আবারও তা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কোঠাভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সংস্কার যেমন কঠিন হচ্ছে, তেমনি বিক্ষোভকারীরা কোটা ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাওয়ার পর থেকে তা অনেকের জন্যেই হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। আর বড় পরিসরে ইরাক এবং লেবাননের অস্থিরতা আঞ্চলিকভাবে ইরানকে যে চিন্তায় ফেলছে, তা হলফ করেই বলে দেওয়া যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //