ভারত-চীন সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র কী পেল?

গত ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টুইটারে শুভেচ্ছা বার্তা জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর বিপরীতে মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট টুইটার বার্তায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভালোবাসে। 

ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেও ভারতীয় মিডিয়াতে তা ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার হয়। চীনের সাথে চলমান সীমান্ত দ্বন্দ্বে ভারত তার প্রতিবেশীদের কাছে না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই যেন কাছে টেনে নিতে চাইছে। 

দ্য হিন্দু পত্রিকা জানায়, ট্রাম্পের বার্তা দেয়ার মুহূর্তটি বলে দিচ্ছে যে, তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। যদিও ওই মুহূর্তটুকু ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দিবস। চীনের সাথে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দিল্লি ও বেইজিংয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনাকল্পনা। 

দুই পক্ষ যখন সীমান্তে নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে চাইছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই সবাই তাকিয়ে আছে। হিমালয়ের পাদদেশের এই বিবাদে ওয়াশিংটনের প্রভাব আসলে কতটুকু?

চীনারা সবসময়ই বলে আসছে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ৫ জুলাই চীনা রাষ্ট্রীয় মিডিয়া গ্লোবাল টাইমসের এক লেখায় বলা হয়, ওয়াশিংটন চাইছে ভারত ও চীনের সংঘাত থেকে নিজেরা লাভবান হতে। যতবারই ভারতের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব হয়েছে, প্রতিবারই মার্কিনিরা ভারতের পক্ষ নিয়েছে ও দ্বন্দ্বকে আরো উস্কে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, যার মাধ্যমে তারা ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে যে, তারা ভারতকে যথেষ্ট সমর্থন দেবে। 

চীনারা প্রকৃতপক্ষে ভারতের সাথে সংঘাতের বিরোধী। তবে চীনারা যে ভারতের সামরিক পদক্ষেপগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গ্লোবাল টাইমসের এক বিশ্লেষণে। সেখানে ইনস্টিটিউট অব চাইনিজ বর্ডারল্যান্ড স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ঝাং ইয়ংপ্যান বলেন, ‘গালওয়ান নদীর কাছে শায়ক নদীর তীরবর্তী স্থানে ভারত একটা বিমানবন্দর তৈরি করেছে; সাথে রাস্তা, সেতু ও মানুষের বসবাসের জন্য গ্রামও তৈরি করেছে। অনেক বছর ধরেই ভারত চীনা স্থলভাগের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার চিন্তা করছিল। ১৯৬২ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময় থেকে এই স্থান উভয় দেশের জন্যেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত খুব সম্ভবত লাদাখ ও কাশ্মীরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে ভৌগোলিক সুবিধা আদায় করতে চাইছে।’

কেউ কেউ অবশ্য চীনকে ভারতের সাথে সমঝোতা করার উপদেশ দিচ্ছেন। বাকনেল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝিকুন ঝু আল জাজিরাতে এক লেখায় বলছেন, ‘চীনারা তাদের চিন্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে কেন্দ্রীভূত করার ফলে এশিয়ার দেশগুলোতে চীনবিরোধী চিন্তা দানা বেঁধেছে। চীনের উচিত অনেক শত্রু তৈরি না করে বন্ধু তৈরিতে অগ্রসর হওয়া। ভারতের সাথে সংঘাত বাড়তে থাকলে ভারত আরো শক্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে। সীমান্তের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের নীতিনির্ধারকদের মাঝে হয়তো পূর্ণ সমঝোতা নেই। একটি চীনা প্রবাদ আছে- কাছের প্রতিবেশী দূরের আত্মীয় অপেক্ষা বেশি ঘনিষ্ঠ। এশিয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো ভারত।’

ভারতেও কেউ কেউ পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। দিল্লির সাংবাদিক ভারত ভূষণ দ্য কুইন্টে এক লেখায় বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুদের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়ন হলে তা নিঃসন্দেহে চীনকে চিন্তিত করবে; কিন্তু তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কৌশলগত চুক্তির অংশ হলেও, তার বন্ধুদের জন্য যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র এখন কতটা প্রস্তুত তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে কৌশলগত গ্রুপিং স্বপ্নের মতোই। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভারতের সীমানায় দখলীকৃত ভূমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করতে পারবে না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত চুক্তি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের কোনো কাজেই আসবে না।’

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে গত এক দশকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা দিয়েছে। যেমন- সীমান্তে দ্রুত সেনা মোতায়েনের সুবিধার্থে ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’ ও ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ পরিবহন বিমান; অতি উঁচু ভূমিতে যুদ্ধ করার সক্ষমতা সংবলিত ‘এএইচ-৬৪ এপাচি’ ও ‘সিএইচ-৪৭ শিনুক’ হেলিকপ্টার; এবং পাহাড়ের ওপর সহজে পরিবহনযোগ্য ‘এম-৭৭৭’ হালকা কামান। এই অস্ত্রগুলো বিক্রি করে একাধারে যুক্তরাষ্ট্র যেমন স্বল্প সময়ের মাঝে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারীর তালিকায় নাম লিখিয়েছে, তেমনি হিমালয়ের পাদদেশে ভারতকে স্থলযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সক্ষমতাও তৈরি করে দিয়েছে, যা গত পাঁচ দশকে ভারতের ছিল না।

হিমালয়ের পাদদেশে ভারতের যুদ্ধ করার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ভারত ও চীন উভয় দেশেই ভিন্ন-ভিন্ন মতের জন্ম দিয়েছে। চীনের হুমকি মোকাবেলায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সুর ধরেই অনেকে ওয়াশিংটনকে কাছে টেনে নিতে চাইছেন। তবে একইসাথে কেউ কেউ আবার ভারতের চিরাচরিত জোট নিরপেক্ষ চিন্তাকে তুলে আনতে চাইছেন এবং নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। 

অপরপক্ষে, বেইজিংয়ে অনেকেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে চাইলেও সীমান্তে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে পারছেন না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলেই বেইজিংয়ে অনেকের মাঝে ধারণা জন্ম নিয়েছে; যা থেকে বের হওয়া কঠিন। আর আঞ্চলিকভাবে এশিয়ার দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই বেইজিংয়ের পক্ষে এশিয়ার দেশগুলোকে কাছে টেনে নেয়া কঠিন হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকার নীতিটাই বেইজিংয়ে হালে পানি পাচ্ছে বেশি, যা বেইজিং এর জন্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা কঠিন করে দিচ্ছে। 

এই বাস্তবতায় দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেই বেইজিং ভারতের সাথে স্থলসীমানা নিয়ে সংঘাতে জড়িয়েছে; আর এটি বেইজিংয়ের কৌশলগত সক্ষমতাকে বিভাজিত করেছে ও যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে একটি বড় সাফল্য উপহার দিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //