মিয়ানমারে শান্তির দুরাশা

পাঁচ বছর পর আবারো একটি সাধারণ নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে মিয়ানমার। তবে প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। 

২০১৫ সালের নির্বাচনে জনগণের স্বপ্ন ছিল- জাতিগত সহিংসতা ও সামরিকতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এবার হয়তো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) নেতা শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচি। সে অনুযায়ী জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থনও তিনি পেয়েছিলেন। সুচি এখন ক্ষমতাসীন সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা, বা অঘোষিত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান। 

পাঁচ বছরের হিসাব কষলে দেখা যাবে, শুধু রোহিঙ্গা গণহত্যাই নয়; শান, চিন, কারেন, কাচিন, রাখাইন বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রেও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা তো বহু দূরের কথা; আজ সুচি নিজেই সামরিক ভাষায় আগ্রাসনের বার্তা শোনাচ্ছেন।

মানবাধিকার কর্মী ইয়ে মিন্ট উইন বলেন,‘এখন এনএলডি ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতিসত্তার পার্টিগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ২০১৫ সালের মতো নিরঙ্কুশ জয় পাবে না এনএলডি। তাদের ওপর এখন জনগণের কোনো ভরসা নেই। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এনএলডির কোনো সুস্পষ্ট নীতি বা আদর্শ নেই। এনএলডি শাসনে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি সহকারে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণনিপীড়নের মাত্রা আরো বেড়েছে।’ 

শান রাজ্যের অধিবাসী মউং স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমরা এজন্য অং সান সুচির এনএলডিকে সমর্থন দেইনি যে, পাঁচ বছরে আমরা সামনে না এগিয়ে, আবারো সেই কর্তৃত্ববাদী সামরিক শাসনে পতিত হব।’ 

কারাগারেও জাতিগত বৈষম্যের শিকার হন বন্দিরা। এ প্রসঙ্গে মউং তার কারাবন্দি বাবার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও জাতিগত কারণে আমার বাবা এখন কারাবন্দি। তিনি জানেন তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অনুরোধ করে আসছিলেন, তাকে যেন এমন কোনো কারাগারে রাখা হয়, যেখানে অন্তত লোকজন শান ভাষা বুঝবেন; কিন্তু সেই অনুরোধ আমলে নেয়া হয়নি।’ 

নয় বছর বন্দি থাকার পর কভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে গত এপ্রিলে তাকে মুক্তি দেয়া হয় বলে জানান মউং।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চালানোর মানসিকতা নতুন করে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিদ্রোহ দমনের নামে একের পর এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবিরাম সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড শুধু মিয়ানমার আর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীরই রয়েছে। যেখানে সচেতনভাবেই বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। 

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ‘তাতমাদাও’ নামে পরিচিত। আর এ বাহিনীর এ আগ্রাসী মনোভাব হঠাৎ করেই গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে ফ্যাসিবাদী চেতনা ধারণ করা জাপানি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এটি গড়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে এ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে তিন হাজার করা হয়। ওই বছরই ‘তাতমাদাও’ কমিউনিস্ট ও কারেন বিদ্রোহীদের দমনে নৃশংস অভিযান চালাতে শুরু করে।

রোহিঙ্গা গণহত্যার খবর সমসাময়িক এবং বহুল প্রচারিত বলে, এর মধ্য দিয়েই মিয়ানমার রাষ্ট্রের গণবিরোধী, অমানবিক রূপটা বেশি দেখা যায়। অথচ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতিও মিয়ানমার রাষ্ট্র ও সেখানকার সেনাবাহিনীর আগ্রাসন কোনো অংশে কম ছিল না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মিয়ানমার বাহিনীর সামরিক অভিযানের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয় কেন্দ্র থেকে সীমান্ত এলাকার পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলগুলোতে। সেখানে বসবাসকারী শান, কারেন, কাচিন ও রাখাইন জাতিসত্তার মানুষ যখন কেন্দ্রের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান, তখন মিয়ানমার বাহিনী চালাতে শুরু করে ভয়ংকর আগ্রাসন। 

এখানে কোনোকালেই মানবাধিকারের প্রশ্ন আমলে নেয়া হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান যেন একটি নিয়মিত ঘটনা!

২০১১ সাল থেকে দেশটির উত্তরাঞ্চলে জাতিগত সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার বাহিনীর অন্তত তিন হাজার সেনাসদস্য নিহত ও বহু সেনা আহত হন। অথচ তা দেশটির সরকার ও সেনা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে। ২০১৫ সালে শান রাজ্যের কোকাং অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হেলিকপ্টারের সাহায্যে সেনা সদস্যদের অভিযানে পাঠানো হয়। যেখানে তাদের ২০ শতাংশই নিহত হন। পরে একই রকম ঘটনা কাচিন রাজ্যে দেখা যায়। এসব হামলায় কয়েক হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। 

জাতিসংঘের হিসাবে, বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা অন্তত দুই লাখ ৪১ হাজার। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের দমনের নামে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূলীকরণ চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ এটিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করলেও বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। ওই গণহত্যায় ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রায় প্রতিদিনই অশান্ত রাখাইন ও চিন রাজ্যে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের মুখপাত্র রুপার্ট কলভিল জানান, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে ২৩ মার্চ থেকে অন্তত ৩২ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও ৭১ জন আহত হয়েছে। এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সেনাবাহিনী ওইসব এলাকার বাড়িঘর ও স্কুলও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রাখাইনে গত বছরের জুন থেকে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সেখানকার খবর সংগ্রহ বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেনা প্রশাসনের সাথে আপসের পথেই হেঁটেছেন; কিন্তু এতে সফলতা আসেনি। কারণ সাংবিধানিক পথে এগোতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া দেশটির রাজনৈতিক সংস্কার প্রায় অসম্ভব। সংবিধানের বর্তমান কাঠামোতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সবাই অর্থাৎ পার্লামেন্টের ৭৫ ভাগ সদস্য চাইলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়, যদি না সেনাবাহিনীর অনির্বাচিত এমপিরা তাতে সম্মতি দেন। সেনাবাহিনী পার্লামেন্টে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ ভাগ আসন নিয়ন্ত্রণে রাখছে। সেই সাথে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তাদের হাতেই থাকছে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার দাবি করলেও মিয়ানমারে কার্যত সেনাশাসন নিরঙ্কুশভাবেই চলছে। শুধু সুচির শরীরে সামরিক উর্দিটুকু নেই। 

এদিকে যেহেতু মিয়ানমারে সাংবিধানিক পথে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে; তাই শান, কারেন, কাচিন ও রাখাইনের সশস্ত্র সংগ্রাম আরো বেগবান হয়ে উঠছে। এখন অন্তত ১৮টি সংগঠন দেশটির বিভিন্ন স্থানে জাতিগত স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রামে চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১০টির সাথে সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি চলছে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে। অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে প্রায় নিয়মিতই। আর এসব সংঘর্ষ দেখিয়ে সেনা প্রশাসন কথিত জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার নামে জাতিগত নির্মূলীকরণকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও রাষ্ট্রীয় নীতি সংস্কারের দলবদ্ধ দাবিকে তারা ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখাচ্ছে। স্বাধীনতার পর প্রায় সাত দশক ধরে চলে আসা এ সেনা সংস্কৃতিকে পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক সংস্কার ও উদ্যোগ দরকার ছিল, তা বাস্তবায়নে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছেন সুচি। আপসের পতাকা উড়িয়ে তিনি জনগণের শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়েছেন।

বামার, শান, রাখাইন, বা কাচিন জাতিসত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে জাতিগত ভিন্নতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে ভয়াবহ সেনা আগ্রাসনের মুখে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিসত্তা স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। সরকারি হিসাবে, দেশটিতে রয়েছে ১৩৪টি জাতিসত্তা। এর মধ্যে অ-বামাররা মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। 

তবে ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে এনএলডি আবারো জয়ী হতে যাচ্ছে বলেই বিশ্লেষকদের মত। কারণ এখনো মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জাতিসত্তার ব্যাপক সমর্থন সুচি পাচ্ছেন। সেই সাথে সামরিক ও প্রশাসনিক সমর্থন তো রয়েছেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //