কভিড-১৯ মোকাবেলায় কোন পথে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে গত ৮ মার্চ। সেই হিসাবে বৈশ্বিক এই মহামারির মধ্যে ১৭তম সপ্তাহ পার করছে বাংলাদেশ। শুরু থেকেই করোনাভাইরাস মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড নিয়ে বরাবরই জনমনে অসন্তোষ ছিল লক্ষণীয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ তা এখনো পরিষ্কার নয়। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বের অধিকাংশ আক্রান্ত দেশ যেখানে টেস্ট-ট্রেস-ট্রিটমেন্টকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে বাংলাদেশ এই তিন খাতেই দিচ্ছে চরম অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনার পরিচয়। এই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপুল পরিমাণে পরীক্ষার মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত করে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং এসব রোগীর সংস্পর্শে আসাদের ট্রেস বা চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই করোনাভাইরাস মোকাবেলা সম্ভব হতে পারে।

এদিকে, টেস্ট বা শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়ানোর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা ও দাবি থাকলেও তা এই ১৭ সপ্তাহে দৈনিক ২০ হাজারে পৌঁছানো যায়নি। ফলে বহু মানুষ উপসর্গ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে সংক্রমণ বাড়াতে থাকলেও তারা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসার আওতায় আসছে না। জানা গেছে, শুরুর দিকে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট তৎপরতা দেখালেও সেই কার্যক্রম এখন আর পরিচালিত হয় না। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসারাও স্বাভাবিক চলাফেরার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বাড়িয়ে যাচ্ছেন বলে অভিমত চিকিৎসকদের।

পরীক্ষা ও রিপোর্ট বিড়ম্বনা

করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্ধারিত ল্যাব ও নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাড়িতে এসে নমুনা সংগ্রহের সিরিয়ালের শুরু থাকলেও শেষ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষারত অবস্থায় কয়েকজন রোগীর মৃত্যুও হয়েছে। অপেক্ষা শুধু এই পরীক্ষার লাইনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। পরীক্ষা করাতে পারলেও তার রিপোর্ট পেতে পেরিয়ে যাচ্ছে চার থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত সময়। কোনো কোনো রোগী যেমন ফল হাতে পাওয়ার আগেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন, তেমনি রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক রোগী। 

পরীক্ষার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে কভিড-১৯ পরীক্ষা হচ্ছে প্রায় ৭০টি ল্যাবে এবং এই ল্যাবগুলোতে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে। এ ছাড়া নমুনা সংগ্রহ করার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪০টি বুথ বসানো হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চাহিদার তুলনায় এই সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় এবং অধিকাংশ ব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিক হওয়ায়, চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ। আবার, দক্ষ জনবলের অভাবে যা পরীক্ষা হচ্ছে তার মধ্যেও প্রচুর রিপোর্ট ভুল আসছে। কারণ করোনাভাইরাসের নমুনা কীভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে, সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং পরীক্ষা করা হচ্ছে- সেটির ওপর নির্ভর করবে ফলাফল কতটা নির্ভুল আসবে। দক্ষ জনবল ছাড়া এই কাজটি নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

বাড়ছে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু

দেশে কভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে গত ৮ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত এক হাজার ২৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ (সিজিএস)। ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি এবং সিজিএস নিয়মিত কভিড-১৯ পরিস্থিতি মনিটরিং করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে সিজিএসের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার টেস্ট করা গেলে এভাবে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের এ মুহূর্তে উচিত সব বেসরকারি হাসপাতালকে ব্যাপক নজরদারিতে এনে কভিড ও নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা।’

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলার প্রতিটি মাপকাঠিতেই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। পর্যাপ্ত পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসাদের আলাদা করার বিষয়ে সঠিক পারদর্শিতা দেখা যাচ্ছে না।’ সমন্বয়হীনতা, অনিয়ম এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাবেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে।’

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘যে পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাস মোকবেলায় তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল, সে পরিমাণ তৎপরতা দেখাতে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ। পরীক্ষা, চিকিৎসা এবং আইসোলেশন নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে যেভাবে করোনাভাইরাস মোকাবেলা করা যেত, দুর্বল পদক্ষেপের ফলে তা সম্ভব হচ্ছে না।’

সরকারের বক্তব্য

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই এবং সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ আরো পরীক্ষা বাড়ানো, রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ এবং সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যাপক তৎপর রয়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //