হুমায়ূন আহমেদের দুটি গল্প

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি লিখেছেন শতাধিক উপন্যাস, সাড়া জাগানো টেলিভিশন নাটক, ছোটগল্প, সায়েন্স ফিকশন, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, ছোটদের বই ও খুব দক্ষ নির্দেশক হিসেবে তার নিজের রচিত উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে নির্মাণ করেছেন কয়েকটি সিনেমা। সহজ ভাষায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, উইট হিউমার সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠককে ধরে রাখার অসম্ভব জাদু ছিল তার কলমে।

বাংলাদেশের পাঠকসমাজ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণী বইমেলায় লাইন ধরে কিনেছে তার বই। কী এক আশ্চর্য জাদুশক্তির প্রয়োগ করেছিলেন তিনি তার সাহিত্যকর্মে! তার সাহিত্যিক প্রতিশ্রুতি ও সামাজিক দায়ের সাথে আমরা অনেকেই একমত নই। আমাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন তিনি তার সাহিত্যকর্মে তুলে ধরে নতুন সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেননি। আমাদের সমাজের অবক্ষয় ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জনজীবনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনও তার লেখনীতে উঠে আসেনি। সরলভাবে আমরা এসব দায়দায়িত্ব তার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি।

এ ব্যাপারে তিনি নিজে নানা স্থানে আত্মস্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ফলে এটা সহজেই বোঝা যায়, তিনি এসব ব্যাপারে অসচেতন ছিলেন না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনজীবনে তার প্রভাবের ফলে যে নিদারুণ অর্থনৈতিক বৈষম্য সংখ্যাধিক্য মানুষের জীবনকে ওষ্ঠাগত করেছে, তিনি এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। উপন্যাস সমগ্র-১-এর শুরুতে ‘নিজের কিছু কথা’ থেকে তার একটা বক্তব্য তুলে ধরছি, ‘তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি, আহমদ ছফা, আনিস ভাই, (আনিস সাবেত) একসঙ্গে থাকি। আমাদের কত না স্বপ্ন! সাহিত্য সাধনায় জীবন উৎসর্গ করব, চিরকুমার থাকব, জীবনকে দেখার ও জানার জন্যে যা করণীয় সবই করব। তাঁরা দুজন তাঁদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন। আমি পরাজিত হলাম জীবনের মোহের কাছে।’

তার এ বক্তব্যের পর ওপরের অভিযোগ আর গুরুত্ব বহন করে না। তাছাড়া সাহিত্যের প্রধান দুটি ধারার একটি আর্টস ফর আর্টস সেক (Art for arts sake) শিল্পের জন্য শিল্প। আরেকটি ধারা হচ্ছে আর্টস ফর হিউম্যান’স সেক (Art for human’s sake) অর্থাৎ মানুষের জন্য শিল্প। এ দুই ধারার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ বেছে নিয়েছিলেন প্রথমটি। তিনি সমাজ সংস্কার কিংবা সমাজে বিপ্লবের উদ্দেশে সাহিত্য রচনা করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল পাঠক সৃষ্টির এবং সেক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফল।

গত চার দশক তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে বিচরণ করেছেন। সাহিত্যজগতে পদার্পণের কিছুদিন পর থেকে তিনি লক্ষাধিক টাকা অগ্রিম রয়্যালিটি নেয়ার পর প্রকাশককে বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রদান করতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বইপ্রতি সবচেয়ে বেশি রয়্যালিটি নেয়া লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বই লিখে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা যায়, সেটির অনন্য উদাহরণও তিনি। বাংলাদেশের প্রকাশনাজগতে লেখককে সম্মানী প্রদান না করে ঠকানোর যে প্রবণতা, সেটিও হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন প্রতিভাবানকে কমার্শিয়াল বা বাণিজ্যিক লেখক তৈরির জন্য অনেকাংশে দায়ী। প্রকাশনা জগতে কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যকারী নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ লেখকই প্রকাশক কর্তৃক প্রতারিত হন। হুমায়ূন আহমেদ এসব জেনে-বুঝেই একটা পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবক্ষয়েরই এটি একটি অংশ। তার অনেক শাখার সাহিত্যকর্মের মধ্যে আমরা এখানে দুটি গল্পের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

প্রথম গল্প “উনিশ শ’ একাত্তর” ও দ্বিতীয় গল্প ‘সৌরভ’। প্রথম গল্পের পটভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও দ্বিতীয় গল্পের পটভূমি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জীবন। “উনিশ শ’ একাত্তর” গল্পটিতে একজন সাধারণ স্কুলমাস্টারের ওপর পাকিস্তানি মেজরের মানসিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল সন্ধ্যায় নীলগঞ্জ গ্রামে উপস্থিত হয়। গ্রামের সবাই সেনাবাহিনী আসার খবর পেয়ে এদিক-ওদিক পালায়। কেবল আজিজ মাস্টার তার প্রসবসম্ভবা বোনকে নিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করেন। গ্রামের দু-একজন আজিজ মাস্টারকে সেনাবাহিনীর মেজরের কাছে গিয়ে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করে।

গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়, মেজরকে গিয়ে এটা বলা হোক যে, এ গ্রামে কোনো মুক্তিবাহিনী নেই এবং গ্রামের সবাই পাকিস্তানের প্রতি আস্থাশীল। আজিজ মাস্টার মেজরের সামনে উপস্থিত হলে মেজর তাকে কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে। সে ঘটনা জানায়। গ্রামে হিন্দু, মুক্তিবাহিনী নেই শুনে মেজর তার গালে থাপ্পড় মারার জন্য একজন সেনাসদস্যকে হুকুম করে। সেনাসদস্য তার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দেয়। ওই গ্রামের বদি পাগল আগেই মেজরের সামনে উপস্থিত হলে মেজর কয়েকজন সেনাসদস্যকে বদি পাগলকে গাছের সাথে বেঁধে রাখার হুকুম দেয় এবং তাকে তারা বেঁধে রাখে। থাপ্পড় দেয়ার পর আজিজ মাস্টারকে মেজর বিয়ে করেছে কিনা জিজ্ঞেস করে।

আজিজ মাস্টার অবিবাহিত একথা জানালে মেজর কয়েকজন সেনাসদস্যকে হুকুম করে তার পাজামা খুলে দেখার জন্য মেশিনপত্র ঠিক আছে কিনা। ৪০ বছর বয়সের আজিজ মাস্টারকে উলঙ্গ দেখে বদি পাগল বলে ওঠে, ‘ও মাস্টার কাপড় পিন্দ। তুমি নেংটা।’ এরপর মেজর তাকে আরও নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে একপর্যায়ে আজিজ মাস্টার মেজরের শার্টের ওপর থু থু দিয়ে প্রতিবাদ জানান। মেজর সৈন্যদের নির্দেশ দিলে তারা চলতে শুরু করে। নগ্ন আজিজ মাস্টার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।

একজন শিক্ষক এ অপমান নিতে না পেরে যতক্ষণ তার সুস্থতা ছিল, থু থু দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তারপর? আজিজ মাস্টার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। গল্পটিতে হত্যা, খুন কিছুই নেই, অথচ এমন একটি বেদনাদায়ক বিষয়কে হুমায়ূন আহমেদ হাজির করেন যে, ঘটনা পড়ার পর পাঠক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। গল্পের আবহে পরিস্থিতিকে তিনি এমনই জীবন্ত করে তুলেছেন, যা পাঠ করার পর দুচোখের অশ্রু সংবরণ করা সম্ভব হয় না। মুক্তিযুদ্ধে এ রকম ঘটনা ঘটেছে কিনা প্রশ্ন জাগার আগে পাঠকের সমস্ত ঘৃণা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি জেগে ওঠে।

দ্বিতীয় গল্প ‘সৌরভ’-এ হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা শহরের একটি মধ্যবিত্ত স্বল্প আয়ের পরিবারের চিত্র তুলে ধরেছেন। আজহার খাঁ একজন চাকরিজীবী। সামান্য বেতনে সংসার চালানোর পর মাস শেষে হাতে পয়সা থাকে না। তা সত্ত্বেও কৈশোর পেরোনো মেয়ে লিলি প্রতিদিনই বেরোনোর সময় বলে, ‘বাবা আজ কিন্তু মনে করে আনবে।’ আজহার খাঁর যে মনে থাকে না তা নয়। কয়েক মাস থেকেই তিনি এ মাসে নয়, সামনের মাসের কথা বলছেন। লিলিও এটা মন থেকে মোছে না। প্রতীক্ষা করে বাবা আনবে। সন্তানের একটা সামান্য চাওয়া পিতা হয়ে আজহার খাঁ যে পয়সার অভাবে মেটাতে পারছে না, এটা ভেবে প্রায়ই তার দুচোখ ভরে ওঠে। একদিন মেয়ে এক পয়সা-দু পয়সা করে জমানো ৩০টি টাকা বাবাকে দেয়।

তিনি যেন ‘ইভিনিং ইন প্যারিস সেন্ট’ নিয়ে আসেন। আজহার খাঁ খুব অপমানবোধ করেন এবং নানা দুঃখের কথা মনে করতে করতে দোকানে গিয়ে সেটা হাতে নেন। পয়সা দেয়ার সময় পকেটে হাত দিয়ে দেখেন টাকা নেই। বৃষ্টিতে ভিজে আত্মীয় রফিকের বাসায় গিয়ে ৩০টি টাকা ধার নিয়ে শিশিটা কিনে বাড়ি ফেরার জন্য রিকশায় ওঠেন। বাড়ির কাছে আসতেই দেখেন স্ত্রী ও মেয়ে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছে। আজহার খাঁ রিকশা থেকে নেমে লিলি বলে ডাক দিতেই বৃষ্টিতে জমে থাকা পানির গর্তে সে উল্টে পড়ে যায়।

মেয়ের জন্য আনা সেন্টের শিশিটা ভেঙে তার সৌরভ জানালা দিয়ে আসা বাতাসে অনুভব করে আজহার খাঁ। আজহার খাঁ বৃষ্টিতে ভিজে গভীর জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গল্পের সংক্ষিপ্ত কাহিনী এই। আজহার খাঁ ঢাকা শহরের সিংহভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঢাকা শহরের এ মধ্যবিত্ত পরিবারের যে হা-পিত্যেশ হুমায়ূন আহমেদ গল্পটিতে তুলে ধরেছেন, তা আমাদের মর্মাহত করে। আমরা কেউই এ জীবনের সাথে অপরিচিত নই, গল্পটি আমাদের সেই বোধ জাগ্রত করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //