কভিড-১৯ সংকটে ডুবছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি

বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নাকাল। দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, চার লাখ ছাড়িয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি খাত এখন এই দুর্যোগের আঁচ অনুভব করছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন ও পুরো অর্থনীতি। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সারিয়ে তুলতে এরই মধ্যে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

গত সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের এই বিলটি পাস হয়। আর্থিক ব্যবস্থা যাতে স্থবির হয়ে না পড়ে, সে জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) তিন ট্রিলিয়নের বেশি মূল্যমানের ঋণ ও সম্পদ ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। 

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রণোদনার এসব পদক্ষেপ বৃহত্তম হলেও তা খুব একটা কাজে আসবে না। কভিড-১৯ সৃষ্ট সংকটে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিটির জন্য ভয়াবহ দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। এরই মধ্যে সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। চীনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮২ হাজারের মতো। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও তা মোকাবেলার জন্য বিশ্বের এই প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ দুটির মধ্যে কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যখন পুরো বিশ্বের অর্থনীতিই মন্দায়, তখনো একে অন্যকে দোষারোপ করছে এবং সহযোগিতার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করছে। অথচ এক দশক আগে দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্কই বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দা থেকে টেনে তুলেছিল।

বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে গত দুই বছর চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দু’পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যার সুবাদে পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। তবে সেটিও হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। গত কয়েক সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও অন্য মার্কিন কর্মকর্তারা করোনাভাইরাসকে ‘চায়না ভাইরাস’ অথবা ‘উহান ভাইরাস’ নামে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, গত বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনারাই উহানে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। চীনের উহানে প্রথম কভিড-১৯ সংক্রমণ দেখা দেয়। দেশটিতে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের ধাক্কা কমে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত। দেশটির জনজীবন ও অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। স্যাটেলাইট থেকে নেয়া ছবিসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্তেও যুক্তরাষ্ট্রের এই স্থবির হয়ে পড়া জনজীবনের চিত্র দেখা গেছে। অব্যবহৃত রানওয়েতে উড়োজাহাজগুলো অলস পড়ে রয়েছে, ব্যস্ত সড়কপথে সুনসান নীরবতা, রিসোর্টগুলোয় ভুতুরে পরিবেশ, বন্দরে নেই কোলাহল। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন ও পর্যটন ব্যবসা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, এক সপ্তাহের মধ্যে ৩২ লাখ ৮০ হাজার জন বেকারভাতার আবেদন করেছেন। ১৯৮২ সাল থেকে দেশটিতে বেকারভাতার তথ্য হিসাব করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে এটি বেকারভাতা আবেদনের রেকর্ড। 

কমে গেছে ভোক্তা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের এক জরিপে দেখা গেছে, মার্চে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা আস্থা কমেছে ১১.৯ পয়েন্ট। ২০০৮ সালের অক্টোবরের পর এটি হচ্ছে এক মাসে ভোক্তা আস্থায় সর্বোচ্চ পতন। সে সময় পুরো বিশ্বে আর্থিক মন্দা চলছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গোর বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোক্তা আস্থা সূচকের পয়েন্ট অর্থনীতিতে আরেকটি ‘ধাক্কা’ আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘আমরা এখন এই সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। অর্থনৈতিক উপাত্তের মাধ্যমে আমরা এই প্রবল সংকটের সূচনা দেখতে পাচ্ছি মাত্র।’

গাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় বিমান সংস্থাগুলো সবচেয়ে সংকটে রয়েছে। এরই মধ্যে দেশটির বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোর জন্য পাঁচ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে মার্কিন সরকার। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি ইউনাইটেড এয়ারলাইনস হোল্ডিংস ও ডেল্টা এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, এই অর্থের ফলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মীদের চাকরি সুরক্ষিত রাখা যাবে; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আরো উদ্যোগ প্রয়োজন হবে। বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা প্যাকেজের সুবাদে সাময়িকভাবে এসব প্রতিষ্ঠান স্বস্তি পেলেও সামনের মাসগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে তারা। শীর্ষ বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিদ্রুত প্রণোদনার অর্থ ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছে। প্যাকেজের এই অর্থ ভাগ করার জন্য তারা একটি ফর্মুলাও সুপারিশ করেছে। তাদের এই প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ১ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয়েছে। আর্থিক প্রণোদনা না পেলে এই খাত থেকে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই শুরু হবে বলে হুমকি দিয়েছে বিমান সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষ।

কর্মীদের উদ্দেশে দেয়া এক নোটিশে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের শঙ্কা অনুযায়ী, পুনরুদ্ধারের গতি শ্লথ হলে আমাদের কার্যক্রম ও কর্মীসংখ্যাও আজকের তুলনার কমিয়ে ফেলতে হবে।’ 

ডয়েচে ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ টর্স্টেন স্লক জানান, মার্চে বিমান পরিবহনে দৈনিক যাত্রীসংখ্যা ২০ লাখ থেকে কমে দুই লাখ ৮০ হাজারে নেমেছে। অর্থাৎ চলতি মাসে আকাশপথে দৈনিক যাত্রী কমেছে ৮৬ শতাংশ। 

শুধু বিমান পরিবহনই নয়, গাড়ি নির্মাণকারী কোম্পানিগুলোও বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকটে রয়েছে। জেনারেল মোটরসের (জিএম) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ৬৯ হাজার কর্মীর বেতন সাময়িকভাবে ২০ শতাংশ কর্তন করা হবে। সংকটকালে নিজেদের হাতে নগদ অর্থ রাখার জন্যই এ পদক্ষেপ নেবে তারা। 

কোম্পানিটির পক্ষ থেকে দেয়া এক ই-মেইল বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার আগে জিএমের ব্যবসা ও ব্যালান্স শিট দুটিই শক্তিশালী ছিল। সংকট পরবর্তী সময়ে দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যই আজ আমরা এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলাম।’

এদিকে ফোর্ড মোটরসের শীর্ষ ৩০০ নির্বাহী কর্মকর্তা কমপক্ষে আগামী পাঁচ মাস বেতন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কম নেবেন বলে জানিয়েছেন। 

অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে ফিয়াট ক্রাইসলার। ইলেক্ট্রিক গাড়ি নির্মাতা টেসলা একটি কারখানায় কর্মীসংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমিয়েছে।

১৯২৯ সালে শেয়ার বাজার ধসের মাধ্যমে গ্রেট ডিপ্রেশন শুরু হয়। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ওই মহামন্দা অব্যাহত থাকে। এই চার বছরে বিপুল পরিমাণ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন ও অর্থনৈতিক উৎপাদনও কমে যায়। মূলত এই সংকট পুরো আমেরিকাকেই বদলে ফেলে। অভিবাসনের ধরনে পরিবর্তন আসে, গান, শিল্প ও সাহিত্য সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন টের পাওয়া যায়। এ সময়ই বেকারত্ব বীমা, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাদি ও ব্যাংক ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্সের মতো নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রোজভেল্ট। 

করোনাভাইরাসের অপ্রত্যাশিত ও নজিরবিহীন অবস্থায় অর্থনীতিতে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তার সাথে ওই মহামন্দার সাদৃশ্য রয়েছে। বিশেষ করে বেকারত্ব বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উৎপাদন কমে যাওয়ার যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে তা ১৯৩০ সালের পরিস্থিতির সাথে অনেকটাই মিলে যায়। 

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেও ধস নেমেছে। বিশেষ করে গত ২৭ মার্চ ওয়ালস্ট্রিটে ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ, নাসডাকসহ শেয়ারসূচকগুলো নিম্নমুখী ছিল। মহামন্দার সময়কালে তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছিল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি কর্মী ছাঁটাইয়ের যে হুমকি দিচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে দেশটিতে এবারো বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। 

যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউন পরিস্থিতি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অর্থনীতির বন্দিদশাও চলবে আরো লম্বা সময়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে মন্দার মুখে ঠেলে দেবে। ফেড চেয়ারম্যান জোরোম পাওয়েল বলেছেন, ‘সবার আগে ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে ও এরপর অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে।’

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানিয়ে দিয়েছেন, কভিড-১৯-এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এরই মধ্যে মন্দায় নিমজ্জিত। 

তিনি মনে করেন, শুধু বিশ্বনেতাদের সমন্বিত পদক্ষেপই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //