করোনাভাইরাসের ওষুধ নিয়ে ব্যবসার নতুন ফাঁদ

উৎপাদন খরচের আটগুণ খুচরা মূল্য

করোনাভাইরাসের ওষুধ রেমডেসিভির নিয়ে ব্যবসার নতুন ফাঁদ পেতেছে কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। উৎপাদন খরচের চেয়ে আটগুণ বেশি খুচরা দামে বিক্রির চেষ্টা করছে কোম্পানিগুলো। এ ওষুধটির উৎপাদন খরচ সব মিলিয়ে ৭৬৫ টাকার বেশি না হলেও; এর খুচরা মূল্য ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা। সচেতন মহল ও চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক জার্নাল থেকে রেমডেসিভিরের দাম বের করে বলেছেন, গলাকাটা ব্যবসার মতো রেমডেসিভিরের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। ওষুধটির দাম কমিয়ে সাধারণের নাগালে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। 

ইনজেকশন আকারের এ ওষুধটি বাজারে আসার আগেই সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়ে গেছে। একটি ওষুধ কোম্পানি তাদের মালিকানাধীন দুটি সংবাদমাধ্যমে ব্যানার হেডিং করে জানিয়েছে, তারা রেমডেসিভির নিয়ে বাজারে আসছে শিগগিরই। অপর দুটি কোম্পানি নিজেদের টেলিভিশনে চ্যানেলে প্রচার করেছে ব্যাপকভাবে। এর বাইরে আরও যে পাঁচটি ওষুধ কোম্পানি রেমডেসিভির বাজারে আনছে তাদেরটা তেমন প্রচার পায়নি। তবে এতেও কোনো সমস্যা নেই। তারাও চিকিৎসক অথবা মার্কেট অথবা সরকারি মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করার সামর্থ্য রাখে। এর আগে কোনো ওষুধ বাংলাদেশে এত প্রচার পায়নি বাজারে আসার আগেই। দাম নিয়ে রাখ-ঢাক করা হলেও এবার এ ওষুধটির দাম নিয়ে কৌশলে ব্যাপক প্রচারণাও চালিয়েছে। ওষুধটির এত দাম রাখা হচ্ছে যে, দরিদ্র মানুষের পক্ষে এ ওষুধটি কিনে চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে না, যদি না তারা সরকারি সহায়তা পান।

১০ দিনের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় রেমডেসিভির ইনজেকশন উৎপাদনের ন্যূনতম খরচ কত হতে পারে, এর একটি হিসাব করেছে জার্নাল অব ভাইরাস ইরাডিকেশন (জেভিই)। ন্যূনতম খরচ হিসাব করার ক্ষেত্রে অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টসের (এপিআই) দাম, এপিআইর সঙ্গে ব্যবহৃত ইনেক্টিভ উপাদানের (এক্সিপিয়েন্টস) দাম, প্রক্রিয়াকরণের (ফরমুলেশন) খরচ, প্যাকেটজাতকরণের খরচ এবং মুনাফা ধরে একটি দাম নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে জেভিআইর পক্ষ থেকে।

রেমডেসিভির হেপাটাইটিস সি, ইবোলাসহ অন্যান্য কিছু রোগের ওষুধ হিসেবে তৈরি হয়েছিল। করোনাভাইরাসের জন্য আলাদা কোনো গবেষণা করে বের করতে হয়নি ওষুধটি। তাই এ গবেষণার জন্য নতুন করে কোনো খরচ নেই, কেবল ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত ওষুধ পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে। সে কারণে রেমডেসিভির উৎপাদনের ন্যূনতম খরচে আলাদা করে গবেষণার খরচ ধরা হয়নি। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো মার্কিন কোম্পানি গিলিয়াডের তৈরি রেমডিসিভির ওষুধেরই কপি করছে। প্যাটেন্ট অধিকারের মধ্যেও বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো পড়ে না। স্বল্পোন্নত দেশ বলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্যাটেন্ট অধিকার রয়েছে, এমন সব ওষুধই কপি করে নিজেদের বাজারে এবং দেশের বাইরে বিক্রি করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গবেষণার খরচও প্রযোজ্য হচ্ছে না। 

জেভিআই রেমডেসিভির উৎপাদনের যে খরচ ধরেছে তা হলো- রেমডেসিভির ইনজেকশান প্রথম দিনে দিতে হবে ২০০ মিলিগ্রাম এবং দ্বিতীয় দিন থেকে দৈনিক ১০০ মিলিগ্রাম। ফলে ১০ দিনে রেমডেসিভির লাগবে এক হাজার ১০০ মিলিগ্রাম বা ১.১ গ্রাম বা ০.০০১১ কেজি। পণ্যের জাহাজীকরণ সম্পর্কিত অনলাইন ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ‘প্যানজিভা’ থেকে নেয়া তথ্য অনুসারে, রেমডেসিভিরের প্রতি কেজি এপিআইর দাম চার হাজার ডলার। প্যানজিভা এসব তথ্য পেয়ে থাকে মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কাস্টসম সার্ভিস থেকে। প্যানজিভার কাছে সাত লাখ কোম্পানির দুই কোটি শিপিং রেকর্ড রয়েছে। এটা নিউ ইয়র্ক শহরে বিশ্ব বাণিজ্য ডাটাভিত্তিক একটি কোম্পানি। আমদানি ও রফতানির সব তথ্য প্যানজিভার ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।

প্যানজিভার তথ্য অনুসারে, এক হাজার ১০০ মিলিগ্রাম বা ০.০০১১ কেজি এপিআইর দাম পড়ে ৪.৪ ডলার। প্রক্রিয়াজাত করার সময় ২০ শতাংশ ওষুধ নষ্ট হতে পারে। প্যানজিভা এর দাম ধরে রেমডেসিভিরের দাম নির্ধারণের চেষ্টা করেছে। উল্লিখিত খরচ যোগ করলে একটি ইনজেকশনের (এক ভায়াল) দাম পড়ে ৭.৪৮ ডলার। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ ১০ শতাংশ, মুনাফা ১০ শতাংশ এবং মুনাফার ওপর ২৭ শতাংশ ট্যাক্স ধরে জেভিই’র হিসাবে রেমডেসিভিরের উৎপাদন খরচ ৯ ডলার বা ৭৬৫ টাকা (১ ডলার=৮৫ টাকা ধরে)। অথচ বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতি ভায়াল ইনজেকশনের দাম পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পড়বে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। এসকেএফ তার নিজেদের মিডিয়ায় এবং বেক্সিমকো রয়টার্সের দিল্লি সংবাদদাতার মাধ্যমে ও নিজেদের টেলিভিশনে নিউজ করিয়ে রেমডেসিভিরের দামের এ ঘোষণাটি দিয়েছে।

রেমডেসিভির দেয়া হবে কেবল মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের করোনাভাইরাস আক্রান্তকে- পাঁচ থেকে ১০ ভায়াল ইনজেকশন দিতে হবে। সর্বোচ্চ ১০ ভায়াল ইনজেকশন লাগলে একজন রোগীর জন্য সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার ইনজেকশন লাগবে। আপাতত সরকারিভাবেই ওষুধটি ব্যবহার হতে পারে। কারণ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালেই দেয়া হচ্ছে। আর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯ খুব শিগগিরই নির্মূল হচ্ছে না। এটা সারা বছরের অসুখ হিসেবে থেকে যেতে পারে। ফলে এক সময় সরকারি হাসপাতালগুলো সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারবে না। বেসরকারি হাসপাতাল অথবা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবেই। তখন রোগীদের অবশ্যই রেমডেসিভিরের প্রয়োজন, যা তাদের ওই ৬০ হাজার টাকা দিয়েই কিনতে হবে। 

রেমডেসিভিরের দামের বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন জানিয়েছেন, এসব ওষুধের দাম বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন নির্ধারণ করে না। ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘বাজারে আসার আগেই দামের কথা দুটি ওষুধ কোম্পানি ঘোষণা দিয়েছে। সত্যিই এক ভায়াল রেমডেসিভিরের দাম পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পড়লে তা হবে গলাকাটা ব্যবসা। জার্নাল অব ভাইরাস ইরাডিকেশনের তথ্য সঠিক হলে এক ভায়াল রেমডেসিভিরের সর্বোচ্চ দাম ওষুধ কোম্পানিগুলো এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় নির্ধারণ করতে পারে। এর বেশি কিছুতেই দাম হওয়া উচিত না।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো রেমডেসিভির বাজারে আসেনি। আমি আশা করব, ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাম কমিয়ে তা জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনবে।’

রেমডেসিভিরের কার্যকারিতা সম্পর্কে অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘রেমডেসিভির কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য অব্যর্থ ওষুধ নয়। মেডিসিনের বিখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, এই ওষুধটি একজন করোনাভাইরাস আক্রান্তকে হাসপাতালে অবস্থানের সময় কমিয়ে দেয়। প্রচলিত অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ করলে একজন কভিড-১৯ রোগীকে ১৫ দিন হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। আর রেমডেসিভির প্রয়োগ করা হলে সে রোগীকে ১১ দিন অবস্থান করতে হবে। তাছাড়া রেমডেসিভির করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু রোধ করতে পারে না। ল্যানসেটের এসব তথ্য বিবেচনা করেই আমাদের ওষুধটি প্রয়োগ করতে হবে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //