করোনাভাইরাসের সুযোগ নিচ্ছেন মালিকরা

বাড়ছে কর্মঘণ্টা, মজুরি আগেরটাই

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দীর্ঘ সময় পেলেও তেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি দেশে। আর এ সুযোগে বিনা বাধায় ঢুকে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাসটি। প্রাণ কাড়ে অনেকের। এর পরই টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। শ্রমিক-দরিদ্রের পরিণতি কী হবে, সে চিন্তাকে তেমন আমলে না নিয়েই বন্ধ করে দেয়া হয় সব কলকারখানা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সঙ্গে যানবাহনও। বাঁচার তাগিদে নিদারুণ কষ্ট নিয়ে মানুষ ছুটে গ্রামে। কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার ডাক পড়ে; খুলে দেয়া হবে পোশাক কারখানা- চাকরি বাঁচাতে হলে আসতেই হবে।

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দীর্ঘপথ হেঁটে, ভ্যান কিংবা অটোরিকশা ও খোলা ট্রাকে ঠাসাঠাসি করে ঢাকায় ফেরেন শ্রমিকরা। শুরু হয় পুঁজিপতিদের ছলচাতুরি। এই তো সুযোগ, কৌশলে কাজ হাসিলের! লকডাউনের এ সময়ে কম শ্রমিক ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয় কর্মঘণ্টা। শ্রমিকরাও তেমন প্রতিবাদ করছেন না, দেশে কাজের যে বড্ড অভাব! অথচ যুগ যুগ ধরে মুনাফাবাজদের শোষণ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মেহনতি মানুষ। রক্ত ঢেলে প্রাণ দিয়ে সে অত্যাচারের মোকাবেলা করেই একদিন তারা অর্জন করেছিলেন আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করার অধিকার। 

অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের শ্রম আইনেও দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। তবে এর মধ্যে এক ঘণ্টা টিফিন বিরতি থাকবে, সপ্তাহে ছুটি থাকবে এক দিন। সে হিসাবে একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা কাজ করার কথা থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনে তার সম্মতিতে বাড়তি ভাতা দিয়ে আরও দুই ঘণ্টা কাজ করানোর বিধান রয়েছে আইনে। তবে পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে দুই ঘণ্টার পর আরও চার ঘণ্টা ওভারটাইমের সুযোগ দেয় শ্রম মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য শ্রমিকদের স্বাধীনতার কথা বলা থাকলেও বেশিরভাগ কারখানা তা বাধ্যতামূলক হিসেবেই দেখছে। এখন তো ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র সুযোগ নিয়ে কম মজুরিতে ১২ ঘণ্টা কাজ করানোর ফন্দি আঁটছেন মালিকরা। 

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এত বছর পরও আট ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরির অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কোনো মতে টিকে থাকতেও শুধু আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই হয় না, শিশুসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে কাজে যোগ দিতে হয়। সাধ্যের অতিরিক্ত করতে হয় ওভারটাইম।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের মানুষ করোনাভাইরাসের আগেই নিরাপত্তাহীন ছিল, রাষ্ট্র তাদের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। আর আমাদের দেশে কোনো বিষয়েরই কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেই। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, সরকার নিজেদের নিয়ে সবসময়ই অনেক বেশি সন্তুষ্ট। করোনাভাইরাস সংক্রমণে অবস্থা এতটা খারাপ হতো না, যদি জানুয়ারি মাস থেকে সরকার প্রস্তুতি নিত। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), এমনকি দেশের বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সতর্ক করেছিল। এখন ভাইরাসটি থেকে রক্ষায় যখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা, সেখানে মানুষকে প্রাণে বাঁচার জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ করতে হচ্ছে। বকেয়া মজুরির জন্য, ত্রাণের জন্য, খাদ্যের জন্য, অনিয়মের বিরুদ্ধে মিছিল করতে হচ্ছে।’ 

শ্রমিক সংগঠনগুলো মনে করছে, শ্রমিকদের অসংগঠিত থাকার সুযোগ নিয়ে এবারও তাদের মাথায় পা রেখে অর্থনীতির ডুবতে বসা নৌকা ভাসিয়ে রাখতে চাইছে সরকার ও মালিকরা। এটা অনেক বড় পরিকল্পনার ছক। এটা মোটেই করোনাভাইরাস সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কম মজুরি দিয়ে কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়ার ছক। এতে শ্রমিক মরলে মরুক, মালিকের মুনাফার থলি তো আরও ভরিয়ে তোলার বন্দোবস্ত করা গেল! অথচ ইউরোপসহ বহু দেশেই পাঁচ দিনের সপ্তাহ এবং দৈনিক ছয় ঘণ্টা কাজের দাবিই এখন শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান ইস্যু।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) অন্যতম শীর্ষ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘পুরো ব্যবস্থাটা যদি দেখি তাহলে তার একটা চিত্র পাব, আর শ্রমিকদের দিক থেকে দেখলে আরেকটা চিত্র পাওয়া যায়। শ্রমিকরা অসহায়, কাজ হারানোর ভয়ে আছে। তাই ঝুঁকি জেনেও জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসেছেন। আর করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগকে দুর্ভোগে রূপান্তর করেছে একদল ব্যবসায়ী। মূলত এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন কারখানা মালিকরা। শিপমেন্টের অজুহাতে বাড়তি কোনো মজুরি ছাড়াই ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করিয়ে নিচ্ছেন তারা। এর মধ্যে আবার প্রায় প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে কিছু না কিছু করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাদের ছুটি দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু যে জায়গাটা খালি হচ্ছে, সেটি নতুন শ্রমিক দিয়ে পূরণ না করে, যারা আছে তাদের দিয়েই কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি সময়ে। এতে দুই লাভ। প্রথমত, চাকরি হারানোর আশঙ্কায় শ্রমিকরা এর প্রতিবাদ করবে না। ফলে একই বেতনে তিন জনের কাজ দু’জনকে দিয়ে উঠিয়ে নেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, মালিকরা বলছেন, অর্ডার পাচ্ছি না। নতুন কাজ নেই। দ্রুত কাজগুলো না সারলে পরবর্তীতে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। বেতন-ভাতা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এভাবে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে শ্রমিকদের ওপর। এতে করে কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে ঘণ্টাপ্রতি মজুরি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর মালিকদের মাসিক মুনাফা বাড়ছে। যে কোনো দুর্যোগেই এ সুযোগটা নেওয়া হয়। এবারও তা-ই হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যে নজরদারি করা দরকার, তা না করায় শ্রমিকের দুর্ভোগটা আরও বেড়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘মালিকদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতেই নাকি কাজের সময় বাড়ানো হচ্ছে! তাহলে খোদ রাজধানীর বস্তিগুলোতে গা-ঘেঁষাঘেষি করে শ্রমিকদের থাকতে হচ্ছে কোন স্বাস্থ্যবিধি মেনে? এ ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে থাকার জায়গাটা পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করে তাদের সুরক্ষিত রাখা যায়।’

করোনাভাইরাসের এই সময়ে কম মজুরিতে অতিরিক্ত সময় খাটানোর উদ্যোগ ভারত সরকারও নিয়েছে উল্লেখ করে এই শ্রমিক নেতা আরও বলেন, ‘মালিকদের পক্ষে যায়, শ্রম আইনের এমন কিছু ধারা তারা পরিবর্তন করছে। যদিও আমাদের দেশে সেটা অনেক আগেই করে রাখা হয়েছে। প্রায় সময়ই মিথ্যা অজুহাতে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়ার মতলব আঁটা হয়। শ্রমঘণ্টা বাড়ানো, বোনাস কমানো এবং ঝুঁকি ভাতা না দিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো মালিকরা করিয়ে নিচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই একটা জুজুর ভয়- আমাদের মার্কেট শেষ হয়ে যাবে, কারখানাই টিকবে না। ফলে এই কল্পিত ভয়ে শ্রমিকদের আতঙ্কিত করে তাদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।’

কষ্টের গায়ে লাল জামা, বেদনার গায়ে নীল

করোনাযুদ্ধে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশের মতোই সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন সাংবাদিক। এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমের অর্ধশত কর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণও হারিয়েছেন কয়েকজন। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, বেশ কয়েকটি পত্রিকা তাদের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দিয়েছে। মাসের পর মাস বেতন আটকে রেখেছে। ঈদ বোনাস তো দূরের কথা, সংকট দেখিয়ে টোকেন মানি কিংবা অর্ধেক বেতন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে।

বহুল প্রচারিত জাতীয় একটি দৈনিকে কাজ করেন লোকমান ফেরদৌস। আক্ষেপ নিয়ে এই সাংবাদিক বললেন, ‘জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে যথাযথ করোনাভাইরাস সুরক্ষা ছাড়াই যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অনেক সহকর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়ায় আমাদের কর্মঘণ্টাও বেড়েছে দ্বিগুণ। বাড়তি কাজের জন্য যে ভাতা দেওয়া হতো, সেটাও এখন বন্ধ করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে। আয় নেই বলে এপ্রিলের বেতন কেটে নেওয়া হয়েছে অর্ধেক। ঈদ বোনাস পাব বলেও মনে হচ্ছে না। বুকে চাপা কষ্ট থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস নেই। যদি চাকরিটাই চলে যায় তখন কী হবে? এই বাজারে নতুন চাকরি যে প্রায় অসম্ভব।’ 

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য বলেন, ‘আসলে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে অনিশ্চিত। রাষ্ট্র সংবাদ শিল্পের মালিকদের যতটা স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসে, ততটা সাংবাদিকদের জন্য নয়। দৈনিক পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ এবং বিদ্যমান শ্রম আইন কার্যকর থাকলেও নানা অজুহাতে অনৈতিক কৌশলে মালিকপক্ষ কর্মরতদের বঞ্চিত করে। এ অপকর্মে অনেক সময় তারা উচ্চ পদবির সাংবাদিক ও কতিপয় সাংবাদিক নেতার সাহায্য নেন। অন্যদিকে, বিকাশমান ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরতদের জন্য কোনো ধরনের চাকরি বিধিই নেই। জেলাপর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থা তো আরও খারাপ। পেশাগত অধিকারের কথা বললেই বিনাবাক্যে চাকরি চলে যায়। আত্মসমালোচনা করেই বলতে চাই, সাংবাদিক নেতা হিসেবে এ দায় অনেকটা আমার ওপরেও বর্তায়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //