আস্থার ব্যাংক নিজেই নড়বড়ে

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত দেশের মানবস্বাস্থ্য, জীবন ও জীবিকা। আর মানবজীবনকে রক্ষার জন্য গৃহীত পদক্ষেপে ধস নেমেছে অর্থনীতিতে। দেশের অর্থনীতির মূলশক্তি বেসরকারি খাত একেবারে ভেঙে পড়েছে। বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল সবদেশই করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে অর্থনীতিকে রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য। আর এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় এককভাবে আস্থা রাখা হয়েছে ব্যাংক খাতের ওপর; কিন্তু অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব পাওয়া ব্যাংক নিজেই এখন নড়বড়ে। নানা সংকটে পড়ে প্রণোদনা ঋণ দিতে অনীহা দেখাচ্ছে। আবার করোনাভাইরাসে মানুষের আয় কমে যাওয়া আমানত কমে যাচ্ছে। প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে তা সঠিকভাবে আদায় হচ্ছে না। ফলে আয় কমে গিয়ে মুনাফা ব্যাপকহারে কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। টিকে থাকতে এখন কর্মকর্তাদের বেতন কমানো শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চারটি ব্যাংক বেতন কমিয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংকগুলোও কমাবে বলে জানা গেছে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত টানা সাধারণ ছুটি ছিল। এখন সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করা হলেও উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। টানা ছুটিতে কাজ হারিয়ে বেকারত্ব বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। আয় কমে যাওয়ায় গরিব মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ, বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ বিভিন্ন দেশের লকডাউনের কারণে। এই অচলাবস্থার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। কারণ মানুষের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমানত রাখার পরিমাণ কমেছে এবং আগের আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বিতরণকৃত ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে তীব্র সংকটে পড়েছে ব্যাংক খাত। 

দেশে কার্যরত ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯টি। আরো তিনটি ব্যাংক বাজারে আসার অপেক্ষায়; কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাংক খাতকে এলোমেলো করে দিয়েছে। এপ্রিল শেষে আমানত প্রায় ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কমে গেছে। জানুয়ারিতে মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এরপর তিন মাসে উত্তোলনের পর দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। এপ্রিলে যে ঋণ বিতরণ হয়েছে, তা স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। আমানত কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহেল আহমেদ বলেন, ‘বাস্তব কারণে আমানত কমে গেছে। এই সময়ে আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মানুষের চলাচল সীমিত থাকার প্রভাবও আমানতের ওপর পড়েছে। তবে ব্যাংকগুলো চেষ্টা করছে এই সময়ে কীভাবে তারল্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যায়। তাই মুনাফা করার জন্য নয়, দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে ব্যাংক।’

ব্যাংক খাতের সংকট অন্য খাতের মতো এখনো তীব্র হয়নি। তবে সংকট আসন্ন। এ জন্য ব্যাংকের মালিকরা কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ শতাংশ কমানো, বোনাস, ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতি বন্ধসহ ১৩ দফা নির্দেশনা দিয়েছে ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে। এদিকে, এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বেতন কমানোর আগে খরচ কমানোর অন্যান্য সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের আগের বছরের মতো উচ্চ মুনাফার প্রত্যাশা পরিহার করা উচিত। এগুলো করার পর বেতন কমানো উচিত ছিল। তবে এরই মধ্যে আল আরাফাহ ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক বেতন কমিয়ে দিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলো কমানোর জন্য কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বেতন না কমানোরও ঘোষণা দিয়েছে।

বিএবি চেয়ারম্যান এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে আমানত কমে যাচ্ছে। ঋণের টাকা আদায় হচ্ছে না। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, সেটিও নিশ্চিত নয়। এই মুহূর্তে কোনো ব্যাংকারের চাকরি চলে যাক, এটি ঠিক হবে না। তাই খরচ কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ব্যাংকের শক্তিশালী অবস্থা ফিরে এলে সবকিছু স্বাভাবিক করা যাবে।’

করোনাভাইরাসের সংকট যেমন ব্যাংকগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে; অন্যদিকে সরকার ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে সরকার এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর বেশির ভাগ অর্থঋণ হিসেবে দেবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আগামী বছরে দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। এ জন্য নতুন বিনিয়োগ করতে হবে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বিনিয়োগের অর্থায়নের উৎস দেশের ব্যাংকগুলো।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকগুলো প্রবল চাপে রয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেট যেভাবে করা হয়েছে, সেজন্য চাপ আরো বাড়বে। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট রয়েছে। এই সংকটের মধ্যে ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে পারবে কি না, সেটিই শঙ্কার বিষয়।’

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির জানান, এপ্রিল পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। তবে ব্যাংক উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকের অবস্থা ভয়াবহ নড়বড়ে। টিকে থাকার জন্য বিদ্যমান খরচ কমানো হচ্ছে। ব্যাংকের সম্প্রসারণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন নতুন ঋণ দেয়া তো দূরের কথা, পুরনো ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা বেশি। বড় উদ্যোক্তারা ঋণ পেলেও বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো প্রণোদনার ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নানা অজুহাতে ঋণ বিতরণ থেকে নিজেদের দূরে রাখছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অর্থনীতির ক্ষতি সামলাতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে অনেক ব্যাংক অনীহা দেখাচ্ছে। তবে কিছু ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। যেসব ব্যাংক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, তাদের সরকারি আমানত বৃদ্ধি করার, আর যেসব ব্যাংক মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে না, তাদের সরকারি আমানত প্রত্যাহার করা যেতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং কুটির শিল্পের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন। এসব শিল্পের ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাত। তাদের ৯৯ ভাগ ব্যাংকগুলোর ঋণের শর্তের উপযোগী হবে না। ব্যাংকগুলো তাদের কোনোভাবেই ঋণ দিতে চাচ্ছে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেউ ঋণের টাকা ফেরত না দিলে তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া এপ্রিল ও মে মাসের সুদ কিছুটা স্থগিত এবং কিছুটা ছাড় দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করায় আগের তুলনায় কমে গেছে। এখন ক্রেটিড কার্ড, ভোক্তা ঋণ ও এসএমইসহ অন্যান্য ঋণের আদায় কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে ১০০ টাকা আয় করতে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ব্যয় হতো, এখন এই ব্যয় ৬৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ক্রমশ এই ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা অনেক খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি।’

এদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে কোনো ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আগে খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা থাকলেও এবার এমন কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আরো ৫৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ছাড় দিয়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাত নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। সুশাসনের অভাবে ঋণের টাকা প্রভাবশালীরা হাতিয়ে নিয়েছেন। বারবার সুযোগ দেয়ায় ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আগে থেকেই ব্যাংকের অবস্থা ভঙ্গুর। করোনাভাইরাস সেই অবস্থাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে এবং প্রণোদনা ঋণ দিতে সরকার যেভাবে ব্যাংকের ওপর আস্থা রেখেছে, ব্যাংকগুলোর সেই সক্ষমতা নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //