চামড়ার বাজারে ধস

বঞ্চিত চামড়ার টাকার সুবিধাভোগীরা

দেশে অনেক কম দামে কোরবানির পশুর চামড়ার কেনাবেচা হয়েছে। এতে চামড়ার টাকার সুবিধাভোগীরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছেন। 

এবার দেশে পশু কোরবানির পরিমাণ অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। গত বছর যে পরিমাণ চামড়া কেনা হয়েছিল এবার তার ৭০ শতাংশ কম চামড়া কেনা হয়েছে। মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদেরও তেমন একটা দেখা মেলেনি। সবমিলিয়ে চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। একেবারে পানির দরে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। প্রকারভেদে প্রতিটি গরুর চামড়া ১০০ থেকে ৪০০ টাকা ও ছাগলের চামড়া ১০ টাকায় কেনা হয়েছে। তবে বড় গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় নেয়া হয়। মূল্য কম হওয়ায় অনেক কোরবানিদাতা চামড়া বিক্রি না করে মাদরাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন। তবে পশুর চামড়ার দাম কম হওয়ার দুস্থরা বঞ্চিত হয়েছেন। এতে দেশের আলেম সমাজ ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জলিল কোরবানির গরু কিনেছিলেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে। কোরবানির পর তার গরুর চামড়া কেনার জন্য কয়েকজন মৌসুমী ব্যবসায়ী এসে দাম বলেন ২০০ টাকা। একজন সর্বোচ্চ বলেন ৩০০ টাকা। পরে কারও কাছে চামড়া বিক্রি না করে এলাকার পার্শ্ববর্তী এতিমখানায় তা দান করে দেন।

আব্দুর জলিল বলেন, এক লাখ ২০ হাজার টাকার গরুর চামড়া যদি ৩০০ টাকা বলে তাহলে বিক্রি করা যায়? সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই অনুযায়ী এই চামড়ার দাম হয় সর্বনিম্ন এক হাজার ২০০ টাকা। তাহলে এত কম দামে কেন চামড়া বিক্রি করব? এই কারণে এতিমখানায় চামড়া দিয়ে দিয়েছি। ছাত্ররা এসে নিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, গতবার এত নৈরাজ্যের পরও সরকার চামড়ার বাণিজ্য বন্ধ করতে পারল না। চামড়ার টাকা গরিবের হক। এই টাকা যারা খাচ্ছে তারা গরিবের টাকা খাচ্ছে। প্রতিবছর কোরবানির সময় লাখ লাখ গরু-ছাগল জবাই হয় তাহলে সরকার কেন প্রস্তুতি নেয় না। মিডিয়ায় দেখা যায় কত সেল গঠন করে। আসলে বাস্তবে কিছুই না। এটি বলব কার কাছে।


জানা গেছে, রাজধানীতে বেলা ১১টার পর থেকে চামড়া কেনাবেচা শুরু হয়। গরুর চামড়া ১০০ টাকা (গাভী) থেকে ৪০০ টাকায় (ষাঁড়) বিক্রি হয়। তবে বড় সাইজের গরুর চামড়া (২৫-৩০ বর্গফুট) ৫০০ থেকে ৫৫০টাকায় কেনা হয়েছে। ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে, ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকায়। ভেড়ার চামড়ার দাম দেয়া হয়নি। বিক্রেতারা গরু বা ছাগলের চামড়ার সঙ্গে ফ্রি দিয়ে গেছেন।

রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস এলাকার ট্রপিকেল হাউজিংয়ের ২৮টি আবাসিক ফ্লাটের বাসিন্দারা গত বছরের ঈদুল আজহাতে ১৬টি গরু ও ৪টি ছাগল কোরবানি দিয়েছিলেন। এবার সেখানে মাত্র ৬টি গরু ও ২টি ছাগল কোরবানি দেয়া হয়েছে। ট্রপিকেল হাউজিংয়ের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, করোনার কারণে এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা যৌথভাবে কোরবানির আয়োজন করেছিলেন। করোনার কারণে অনেকের আয় কমেছে। আবার অনেকের চাকরি ও ব্যবসা নেই। ফলে এই আবাসিক ভবনে কোরবানির এই অবস্থা।

আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির  একজন বাসিন্দা জানান, গত বছর তাদের আবাসিক ভবনে ৬-৭টি পশু কোরবানি হয়েছিল। এবার সেখানে ৩টি কোরবানি হয়েছে।

রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে এবারের কোরবানিতে। রাজধানীর চামড়ার ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গতবারের চেয়ে এবার অর্ধেকরও কম পরিমাণ চামড়া তারা সংগ্রহ করছেন বেপারিদের কাছে বিক্রির জন্য। বেগুনবাড়ি এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম পিন্টু ও সাইফুদ্দিন। গত বছর তারা দুইজনে প্রায় এক হাজার গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এবার মাত্র ৪০০টি চামড়া সংগ্রহ করেছে।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান শনিবার বলেন, সারাদেশে গতবারের তুলনায় অর্ধেক কম পরিমাণ চামড়া কেনার লক্ষ্য রয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের।  যেকারণে  চামড়ার দাম এবার কম। গত বছর  যে চামড়া  কেনা হয়েছিলো দিয়েই  কাজ এবার কাজ করেত  চাই।

কোরবানির গরু-ছাগলের চামড়ার কেনাবেচা নিয়ে বিক্রেতা ফরিয়া ও বেপারি, তিনপক্ষই অসন্তুষ্ট। বিক্রেতারা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত মূল্য পাচ্ছেন না তারা। ফরিয়ারা বলছেন, যে দামে বিভিন্ন মহল্লা থেকে চামড়া কিনেছে, সেই দামে বেপারিদের কাছে বিক্রি করতে পারছেন না।

আর বেপারিরা বলছেন, যে দামে চামড়া কেনার কথা সে দামে পাচ্ছেন না তারা। চামড়ার বাজারের এই অবস্থার কারণে অনেকেই তাদের পশুর চামড়া বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশু কোরবানির যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে তাতেও উপরের কারণগুলোই স্পষ্ট। করোনা আর ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের বকেয়া।

মান্ডার জামিয়া ফতিউলুম মাদরাসার ছাত্র তোফাজ্জল বলেন, আমরা প্রতিবছরই কোরবানির চামড়া এতিমখানার জন্য সংগ্রহ করে থাকি। এবারও করছি। আগে অনেকে চামড়া বিক্রির টাকা এতিমখানায় দান করত। গতবছর অনেকে বিক্রি করতে পারেনি। এবার আবার চামড়া কেনার লোকজনও কম। তাই অনেকে মাদরাসায় চামড়া দিয়ে দিচ্ছে। আমরা চামড়া সংগ্রহ করে একজন আড়তদারকে দিয়ে দিচ্ছি। তিনি বিক্রি করে আমাদের টাকা দেবেন।


এদিকে অনেক চামড়া রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বাসার সামনে পড়ে থাকলেও কেনার কেউ ছিলো না। সরকার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারিত করে দিলেও তার ধারে কাছেও ছিলো না খুচরা বাজার। তাই নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।

শনিবার (১ আগস্ট) রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বাবলু কুমার সাহার নির্দেশনায় অভিযান পরিচালনা করেন অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক (উপ সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার, প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক, মো. মাসুম আরেফিন, বিকাশ চন্দ্র দাস, সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল, মাগফুর রহমান প্রমুখ।

অভিযান প্রসঙ্গে মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশনায় রাজধানী ঢাকায় দুইটি টিমসহ দেশের ৬১ জেলায় সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রয় হচ্ছে কিনা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা হয়।

এর আগে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা ‘জাতীয় সম্পদ চামড়া, রক্ষা করবো আমরা’ শ্লোগানে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ পদ্ধতি বিষয়ক লিফলেট বিলি করা হয়। সেই আলোকে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা হয়। এছাড়া সরকার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ৩৫-৪০ টাকা ঢাকার বাহিরে ২৫-২৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই মূল্যে চামড়া বিক্রি হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ন্যায্য মূল্যের চামড়া ক্রয় বিক্রয় ও সংরক্ষণের বিষয়ে যথা নিয়ম পরিপালনের সতর্ক করা হয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //