সক্রিয় সিন্ডিকেটে ৭ বছরে চামড়ার দাম অর্ধেক

প্রতি বছর নানা অজুহাতে মূল্য বাড়ে এমন পণ্যের শেষ নেই; কিন্তু দাম কমে এমন পণ্য হয়ত শুধু কোরবানির পশুর চামড়া। তবে কাঁচা চামড়ার দাম কমলেও জুতা, সান্ডেল, বেল্ট, ব্যাগ ইত্যাদি চামড়াজাত পণ্যের দাম ঠিকই বাড়ে। গত সাত বছরে আগের তুলনায় চামড়ার দাম কমে হয়েছে অর্ধেক। সরকার নিজেই দাম কমিয়ে দেয়। আবার সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, তদারকির অভাবে সেই অতি অল্পদামেও চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয় না। মূলত কোটিপতি ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে চামড়া নিয়ে অরাজকতা তৈরি করে। যদিও কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির পুরো টাকাই পায় গরিব অসহায়রা। আর এই গরিব অসহায়দের হক আত্মসাতে লিপ্ত ওই অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সূত্র জানায়, চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এ ছাড়া সেল গঠন, কাঁচামাল সরবরাহ লাইনে নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। দিয়েছে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ। এত কিছুর পরও, গত বছরগুলোর মতো এবারও নৈরাজ্য ঠেকানো যায়নি। মূলত আড়তদাররা একজোট হয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। যদিও তারা দোষ চাপাচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ওপর। আড়তদাররা এবারও ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করছেন। অন্যদিকে, ট্যানারি মালিকরা দুষছেন আড়তদার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের।


সরকারই কমাচ্ছে চামড়ার দাম

২০১৩ সালে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। ওই সময়ে লবণযুক্ত ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার দাম মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় এবং প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়া হয়। গত সাত বছরে গরুর চামড়ার দাম কমেছে ৫৮.৮২ শতাংশ। একই সময়ে ছাগলের চামড়ার দাম কমেছে ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৩ সালে ছাগলের চামড়া যে দামে পাওয়া যেত, ২০২০ সালে এসে গরুর চামড়া তার চেয়েও কম দামে পাওয়া যাচ্ছে।

কোরবানির পশুর দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ সালে কমিয়ে গরুর চামড়া ৭০ থেকে ৭৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অন্যদিকে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পরপর দুই বছর প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ২৫ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়া ছিল। তবে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে টানা তিন বছর প্রতি বর্গফুট গরু চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। তবে ২০১৭ সালে ছাগলের প্রতি বর্গফুট চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকায় নির্ধারণ করা হলেও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তা আরও কমিয়ে ১৮ থেকে ২০ টাকা করা হয়। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই কোরবানি ঈদের জন্য প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ছাগলের ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা আর আগের মতো নেই। পাশাপাশি ট্যানারিগুলোতে আগের বছরের চামড়া বিশাল অংশ অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব কারণেও চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে।’

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চামড়ার দাম কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার মূল্য এবং সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমে নির্ধারণ করা হয়েছে। চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার দর, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা, কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চাহিদা, বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান, স্থানীয় চাহিদা ও মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবার চামড়ার দাম কমানো হয়েছে।’


বাড়ছে চামড়াজাত পণ্যের দাম

গত পাঁচ বছর ধরেই কমছে কাঁচা চামড়ার দাম। অথচ চামড়াজাত পণ্য জুতা, স্যান্ডেল, বেল্ট, ব্যাগ ও জ্যাকেটের দাম কমছে না, বরং বছর বছর বাড়ছে। চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারকরা বলছেন, ফিনিশড লেদার (পাকা চামড়া) বা চূড়ান্ত ব্যবহারযোগ্য চামড়ার দাম প্রতি বছরই বাড়ছে। চক্র তৈরি করে পাকা চামড়ার দাম বাড়াচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। বেশি দামে পাকা চামড়া কিনতে হয় বলে তৈরি পণ্যের দামও বেশি পড়ছে। অন্যদিকে, পাকা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রতি বছর রাসায়নিকসহ অন্যান্য খরচ বাড়ে, সে কারণে দামও বাড়ে।

প্রতি বর্গফুট ফিনিশড বা পাকা চামড়ার দাম বেড়ে হয়েছে ১৬০ টাকা পর্যন্ত। মানভেদে এই দাম কমবেশিও হয়। এক জোড়া জুতা তৈরি করতে তিন থেকে পাঁচ বর্গফুট চামড়া প্রয়োজন। চামড়ার পাশাপাশি আরও কয়েকটি উপাদান প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, ২২ বর্গফুটের একটি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে আনুমানিক ব্যয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সেই হিসাবে এই পরিমাণ পাকা চামড়ায় অন্তত চার থেকে পাঁচ জোড়া জুতা তৈরি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রতি জোড়া জুতায় চামড়া বাবদ ব্যয় প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। জুতার সোল ও ভেতরে রেক্সিন বাবদও খরচ রয়েছে।

রাজধানীর পান্থপথ ও ধানমন্ডির বিভিন্ন দোকানে এক জোড়া জুতা বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে ছয় হাজার টাকায়। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের জুতার দাম আরও বেশি। রাজশাহীর কালুহাতি পাদুকা শিল্প মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেড সব ধরনের চামড়ার স্যান্ডেল, ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, চাবির রিং ইত্যাদি পণ্য তৈরি করে। এই সংগঠনটির উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, ‘মূলত ফিনিশড চামড়া কিনে জুতা তৈরির কাজ করা হয়। এই চামড়ার দাম কমেনি। বরং বছর বছর বাড়ছে। চামড়া ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কম দামে কাঁচা চামড়া কিনলেও, পাকা চামড়ার দাম বাড়াচ্ছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়তি দাম নেয়া হচ্ছে। প্রতি বর্গমিটার পাকা চামড়া কিনতে হয় ১২০ থেকে ১৬০ টাকায়। মূলত সিন্ডিকেটের কারণে কাঁচা চামড়ার দাম কম হলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না।’

এ দিকে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভাইপার লেদারের কর্ণধার এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বায়েজীদ বলেন, ‘কাঁচা চামড়া ট্যানারি মালিকের হাত হয়ে জুতা প্রস্তুতকারকদের হাতে আসে। লবণ দেয়া চামড়া গুদামে পড়ে থাকে। চূড়ান্ত ব্যবহারযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত চামড়ায় ব্যয় হয়। প্রক্রিয়াকরণে রাসায়নিকের দাম কমেনি, বরং বাড়ছে। কাঁচা চামড়ার দাম কম হলেও প্রক্রিয়াকরণে ব্যয় বেশি। বেশি দামের জুতার ক্ষেত্রে সোল ভালো হয়। অন্যান্য খরচ যোগ করে বেশি দাম পড়ে যায়। কাজেই চামড়ার দাম কম হলেই জুতার দাম কমবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। কারণ জুতা তৈরিতে অন্যান্য খরচ রয়েছে।’


কীভাবে চলছে কারসাজি

দেশের একমাত্র নিম্নমুখী দামের পণ্য কাঁচা চামড়া নিয়ে প্রতি বছর চলে কারসাজি। যার শুরু হয় সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে। প্রথমেই সরকার দাম কম নির্ধারণ করে দেয়। এটাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর চাহিদা নেই এমন অজুহাতে চামড়া কেনাই বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত দামের ২০ ভাগের এক ভাগ দামও পাননা কোরবানিদাতারা। আবার কখনোই কোরবানির পশুর চামড়ার বিক্রি বাজার মনিটর করে না সরকার। এ জন্য ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

জানা যায়, প্রতি বছর দুই কোটি ২৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে কোরবানির সময় পাওয়া যায় এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ২৫ লাখ চামড়া। এ বছর ৮০ লাখ থেকে ৯০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে সংগ্রহ করা গেছে ৭০-৮০ লাখ পিস চামড়া। ফড়িয়া ও আড়তদারসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে দেশের চামড়াশিল্প জিম্মি হয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিবারের মতো এ বছরও গরিব আর এতিমের হক কাঁচা চামড়া ময়লার ভাগাড়ে গেছে।

ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চামড়া কেনার জন্য সরকার ৬০০ কোটি টাকা তহবিল দিলেও তারা ব্যাংক থেকে পেয়েছেন মাত্র ১২০ কোটি টাকা। ব্যাংকের এমন অসহযোগিতার ফলে বাজারে নগদ টাকার ঘাটতি হয়েছে। ফলে দেশের মূল্যবান চামড়া এবারও নষ্ট হয়েছে। আড়তদারদের সূত্রে জানা গেছে, এবার গত বছরের তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। গরম, পুঁজির অভাব ও অতি মুনাফার লোভে নষ্ট হয়েছে ১৫ শতাংশ গরুর চামড়া; আর খাসি বা ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়েছে ৯০ শতাংশ। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, গড়ে ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।

সারাদেশ থেকে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী রাজধানীর পোস্তার আড়তে চামড়া নিয়ে আসেন; কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানান, আড়তদাররা একজোট হয়ে দাম কমিয়েছেন। কালক্ষেপণের মাধ্যমে চামড়া পচিয়েছেন। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, ‘ট্যানারি মালিকদের কাছে ১৫৩ কোটি টাকা পান আড়তদাররা। দিয়েছেন মাত্র ১০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা। অর্থ সংকটে চামড়ার বাজারে এমন ধস নেমেছে।’

কাঁচা চামড়ার দামে ধস ঠেকাতে সরকার শেষ সময়ে কাঁচা চামড়া বা ওয়েট ব্লু রফতানির সুযোগ দিয়েছে। তবে রফতানি হবে কি না, তা নিয় সংশয় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ মুহূর্তে রফতানির বাজার বন্ধ। গত বছরের তিন হাজার কোটি টাকার চামড়াও পড়ে আছে। এ বছর দাম কমাতে করোনাভাইরাসকে নতুন অজুহাত হিসেবে পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চামড়ার প্রধান বাজার চীন। করোনাভাইরাসের শুরুতে তারা চামড়া নেয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর ইতালি, জাপান ও কোরিয়াতেও রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এখন চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের চামড়াজাত পণ্য নিচ্ছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘চামড়া খাতে রফতানি ২৮ শতাংশ মধ্যে। এরপরও সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে একেবারে শেষ সময়ে এসে ওয়েট ব্লু রফতানির সুযোগ দিয়েছে। ঘোষণাটি আরও আগে দেয়া হলে দেশের ভেতর কাঁচা চামড়ার চাহিদা আরও বাড়ত। আগামীতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে কাঁচা চামড়া রফতানির বিষয়ে আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে যোগাযোগসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’ কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে চামড়ার দাম না কমিয়ে আগের মূল্য রাখলেই ভালো হতো।’

সরকার এবার এমনিতেই চামড়ার দাম কম ধরেছে। অন্যবারের চেয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ২০ থেকে ২৯ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে। কৃষকদের ধান ও পাটের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে যেমন সরকারের উদ্যোগ আছে, একইভাবে চামড়ার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের মূল্যবান এই সম্পদ রক্ষায় সুশাসন, নজরদারি ও যথাযথ আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //