বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবি

দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রাম অঞ্চলের গরীব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৩ সাল হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজ গুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কোর্স চালু করা হয় তা বাস্তবায়ন না হয়ে এখন কলেজ গুলোর ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত না করা।

শিক্ষকদের বেতনের নাম করে গরীব ছাত্রছাত্রীদের নিকট হতে মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বেতন নেয়া হলেও শিক্ষকদের বেতন বাবদ কলেজ ভেদে ২০০০ থেকে ১০০০০ টাকা করে দেয়া হয়। যা একজন শিক্ষকের বতর্মান বাজার দরে জীবন ধারণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। শুরুতে কলেজের সংখ্যা গুটি কয়েক হলেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত তা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়।

২০১৮ সালে বেসরকারি কলেজগুলো জাতীয়করণ করার পর বতর্মানে অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানরত কলেজের সংখ্যা ৩১৫ টি। দীর্ঘ আটাশ বৎসরের বঞ্চনার এই দাবি আদায়ে শিক্ষকেরা বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, মানবন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে। দীর্ঘ আটাশ বৎসরের বঞ্চনার দাবির পক্ষে বেশ কিছু যৌক্তিক বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির বিষয়ে দুটি নির্দেশনা (২০১৪\২০১৭) প্রদান করে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে শিক্ষকদের বঞ্চিত করে রেখেছে।

২. দশম জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১১ ও ১২ তম বৈঠকে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত বিষয়ে দুটি সুপারিশ প্রদান করে। কিন্তু এই সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন না করে উচ্চ শ্রেণির এই শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে।

৩. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক দুজন মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহমিদা খাতুন/২০১৫ ও প্রফেসর এস এম ওহিদুজামান/২০১৭ মহোদয়গণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশ সহ আর্থিক খরচ কত হবে তা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই চিঠিও আমলে না নিয়ে শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে।

৪. ১৯৯৩ সালের পরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে সরকারি একক আদেশে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার জিবিজি কলেজসহ দেশের বেশ কয়েকটি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করে কিন্তু জনবল কাঠামোতে অনার্স মাস্টার্স স্তর অন্তর্ভুক্ত না করার অন্য কলেজের অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকেরা যুগের পর যুগ ধরে বেতন বঞ্চিত হয়ে আসছে।

৫. অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের ন্যায় একই পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত জনবল কাঠামোর বাইরে থাকা ডিগ্রীর তৃতীয় শিক্ষকেরা ২০১০ সালের পূর্বে নিয়োগ প্রাপ্তরা এমপিওভুক্তি হতে পেরেছে এছাড়া ২০১০ সালের পরে নিয়োগকৃতদের এমপিও প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর্থিক হিসাব প্রদানসহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অথচ উচ্চশিক্ষা দানে নিয়োজিত অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের বারবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপেক্ষিত করেছে।

৬. একই সরকারি নিয়ম ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত সদ্য জাতীয়করণ কলেজের বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা জাতীয়করণে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পেয়েছে। অথচ বেসরকারি কলেজের অনার্স মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকেরা ন্যূনতম এমপিওভুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। যা সংবিধান পরিপন্থী।

৭. মাদ্রাসা পর্যায়ে বেসরকারি ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিও প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ একই সমমান পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকেরা দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে জনবল কাঠামো ও এমপিও হতে বঞ্চিত রয়েছে।

৮. কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সকল শিক্ষকেরাও বেতন বঞ্চিত। তাই মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার শিক্ষকতা পেশায় আসতে আকৃষ্ট করতে ও মান সম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও দেয়া সময়ের দাবি।

৯. একই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে যেখানে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রী শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত হতে পারেন তাহলে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা তাদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে কেন এমপিও বঞ্চিত থাকবে?

১০. সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করনে সরকার যেখানে সকল স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা ফ্রি করে দেয়া জন্য কাজ করছে সেখানে উচ্চ শিক্ষা স্তরে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের নিকট অধিক হারে বেতন আদায় কতটা যৌক্তিক হচ্ছে ?

১১. শিক্ষার্থীদের নিকট হইতে অধিক হারে বেতন আদায়ের পরেও শতভাগ বেতনের কথা উল্লেখ করে নিয়োগ দানের পর শিক্ষকদের মাসে ২০০০-১০০০০ টাকা বেতন দেয়া কতটা মানবিক ?

১২. একই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেখানে ডিগ্রী স্তরে ২১ বিষয় পাঠদানের জন্য শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারে ৩ জন। অন্যদিকে অনার্স স্তরে ৩০ টি বিষয় পাঠদান করেও একজনও এমপিওভুক্ত হতে পারে না। যা সবচেয়ে অমানবিক বিষয়।

১৩. বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৫০০-১৫০০ টাকা আর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ২৫ টাকা। এক দেশে দ্বৈত নীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন বৈষম্য থাকলে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করণ কিভাবে সম্ভব।

বঞ্চনার এই দাবি সমূহ বিশ্লেষণ করে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি একটি যৌক্তিক দাবি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //