করোনায় বাড়তে পারে আত্মহত্যার প্রবণতা

প্রতি বছর বিশ্বে প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট অন্য যেকোনো কারণের তুলনায় বেশি মানুষ মারা যায় আত্মহত্যা করে। আত্মবিধ্বংসী এ প্রবণতা বিদ্যমান বাংলাদেশেও।

মনোবিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, দেশের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার এ প্রবণতা আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে কভিড-১৯ পরিস্থিতি।

সাধারণত পারিবারিক ও মানসিক অশান্তি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ নানা কারণে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, প্রতি বছর বিশ্বে আত্মহননে প্রাণ দেয় গড়ে ৮ লাখ মানুষ। সে হিসাবে বিশ্বব্যাপী প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ আত্মহত্যা করছে।

বিশ্বের যেকোনো দেশে আত্মহত্যার এ প্রবণতা অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বেড়ে যায়। আয় কমে যাওয়া, চাকরি হারানো, অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীতি এ সময় মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি করে। এ হতাশা থেকেই কারো কারো মধ্যে তৈরি হয় আত্মহত্যার প্রবণতা।

পুলিশের তথ্য বলছে, দেশে প্রতিদিন আত্মহত্যা করে গড়ে ৩০ জন মানুষ। অন্যদিকে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে গড়ে তোলা সামাজিক আন্দোলন অনিকের জন্য উদ্যোগ বলছে, প্রতি বছর দেশে আত্মহত্যাকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।

এ তথ্য স্বাভাবিক সময়ের। চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতি বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বকেই নিয়ে গিয়েছে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি। লকডাউন, শিল্প ও সেবা খাতের ধস এবং ব্যাপক কর্মহীনতার কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা এখন অবশ্যম্ভাবী।

এ পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক প্রতিষ্ঠান। অস্তিত্ব বাঁচাতে বড় ধরনের ছাঁটাইয়ের পথেও হাঁটতে পারে কেউ কেউ। এর ধারাবাহিকতায় বেকার হয়ে পড়তে পারেন অনেকেই।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ তথ্য প্রমাণিত। নানা সময়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে বারবার।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিএমজে জার্নাল অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট রিসেশন, আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড হেলথ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্দাকালে অর্থনীতিতে কর্মচ্যুতির সংখ্যা বাড়ে।

ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টি ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যে দৃশ্যমান ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারো কাছে তার চাকরি হারানোর অর্থ হলো দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক রুটিনে বিচ্যুতি। একই সঙ্গে তার কর্মক্ষেত্রসংশ্লিষ্ট সামাজিক সম্পর্কেরও ব্যাপক অবনমন ঘটে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ব্যক্তির আর্থিক সক্ষমতা হ্রাসের বিষয়টি। এর ফলে তার মানসিক পরিস্থিতিতেও এক ধরনের পরিবর্তন আসে। বেড়ে যায় বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার হার।

১৯৯৭-৯৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা গিয়েছিল। ওই সময়ে দেশগুলোয় আত্মহত্যার হারও বেড়ে যায়।

এ নিয়ে তাইওয়ান ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল, যার ফলাফল প্রকাশ হয়েছিল ‘ওয়াজ দি ইকোনমিক ক্রাইসিস ১৯৯৭-৯৮ রেসপনসিবল ফর রাইজিং সুইসাইড রেটস ইন ইস্ট/সাউথইস্ট এশিয়া?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, ১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের কালে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় আত্মহত্যার হার ভয়াবহ হারে বেড়ে যায়। বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায় বেশি।

১৯৯৮ সালে জাপানের পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেড়েছিল ৩৯ শতাংশ। হংকংয়ে এ বৃদ্ধির হার ছিল ৪৪ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৫ শতাংশ।

জাপানে এ সময় সব মিলিয়ে ১৯৯৭ সালের তুলনায় ১০ হাজার ৪০০ জন বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছিল, যার জন্য সম্পূর্ণ অংশে দায়ী অর্থনৈতিক মন্দা। তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোয়ও এ সময় একই কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে।

এ ধরনের এমন অনেক গবেষণা হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিরই বক্তব্য মোটামুটি এক, যাকে সারসংক্ষেপে বলা যায়, মন্দার সময়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান হ্রাসের হার বেড়ে যায়। সামাজিক জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়, যার ফলে বাড়ে আত্মহত্যার হার।

শুধু কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ নয়, পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও। সম্প্রতি জার্মানির হেস প্রদেশের অর্থমন্ত্রী থমাস শিফারের আত্মহত্যার ঘটনাটিও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।

বাংলাদেশের সামনেও এখন একই ধরনের শঙ্কা। সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আরোপের কারণে শিল্প খাতের সিংহভাগ কারখানায় উৎপাদন এখন বন্ধ। স্থবির হয়ে পড়েছে সেবা খাতও।

উৎপাদন ও সেবা খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সামনের দিনগুলোয় টিকে থেকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে আশঙ্কা রয়েছে, কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে পারে অনেক প্রতিষ্ঠান।

বন্ধও হয়ে পড়তে পারে কোনো কোনোটি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের হার কমে গিয়ে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়েছে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা রয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের নিয়ে। কারণ বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত।

তাদের বড় একটি অংশ কাজ করেন দৈনিক, চুক্তিভিত্তিক মজুরি ও নিয়োগপত্র ছাড়াই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক কাজ করছে মুদি কিংবা বিভিন্ন দোকানে। এর পাশাপাশি পরিবহন, বন্দর, নির্মাণ ও আবাসন, হাট-বাজার শ্রমিক রয়েছে।

সব মিলিয়ে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ বা দিনমজুরি করছেন প্রায় দুই কোটি শ্রমিক, যারা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের জীবনযাত্রা এরই মধ্যে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে সামনের দিনগুলোয় তাদের পক্ষে খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রেও এসব দিনমজুরের কেউ কেউ জীবনের চরম ও চূড়ান্ত পরিণতিকেই বেছে নিতে পারেন মুক্তির উপায় হিসেবে।

শুধু অর্থনীতি নয়, সামাজিক আচরণেও এখন বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে করোনা। কভিড-১৯-এ কেউ আক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ হলেই তাকে ও তার পরিবারকে সামাজিকভাবে নানা বাধাবিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে সন্দেহে স্থানীয়রা কোনো কোনো ব্যক্তির মরদেহ দাফন করতে দেয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

উপরন্তু সামান্য জ্বর হলেও চিকিৎসাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে। এ ধরনের পরিস্থিতিও অনেককে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও একধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। বিশেষ করে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিপালন তাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতি কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ঢাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হলো কৈশোর। বর্তমান পরিস্থিতিতে পারিবাহিক কলহ, পরিবারে অনটন, নতুন নতুন বিধিনিষেধ-এসবের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীরা কিন্তু সহজেই খাপ খাওয়াতে পারবে না।

এর মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। এজন্য এই সময়টিতে কিশোর-কিশোরীদের প্রতি অভিভাবকদের বাড়তি মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এরই মধ্যে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার কোদালধোয়া গ্রামের পিন্টু পান্ডে (১২) নামে এক কিশোর বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।

তবে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণেরও পথ রয়েছে। বিএমজের ‘দ্য গ্রেট রিসেশন, আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড হেলথ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচি যত শক্তিশালী হয়, অর্থাৎ যত বেশি অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা যায়, মন্দাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার প্রবণতাও ততটা হ্রাস পায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //