তিস্তার তীব্র ভাঙনে দিশাহারা মানুষ

তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে লালমনিরহাটের তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তিস্তার বামতীরের মানুষ। 

তিস্তা আর ধরলা নদীবেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে জুন থেকে থেমে থেমে বন্যা চলমান রয়েছে। টানা ৪/৫ দিন পানিবন্দি থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতে আবারো পানিবন্দি হচ্ছে মানুষ। গত সপ্তাহে টানা পাঁচদিন ডুবে থেকে মুক্তি মিলে জেলার প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের। খনন না করায় তিস্তা ও ধরলা নদীর তলদেশ পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে পড়েছে। ফলে উজানের পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টিতে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে নদীর দু’কুল ছাপিয়ে প্লাবিত হয় লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলা। 

প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে তিস্তা জেলার অর্থনীতিকে করেছে বাধাগ্রস্ত। প্রতি বছরেই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তা পাড়ের মানুষ। চোখের সামনে নদী গিলে খায় মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও স্থাপনা। 

নদীর কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে একবার দুইবার নয়, কারো কারো জীবনে ২০ থেকে ২৫ বার বসতভিটা সরাতে হয়েছে। সারা বছরের উপার্জনের সঞ্চিত অর্থে নতুন করেন বসতভিটা তৈরি করলেও তা এক বছরের মাথায় আবারো নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে। প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কেউ কেউ জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে কোনোরকম বসবাস করছেন। অনেকে রাস্তার পাশে বা বাঁধের ধারে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। 

ভাঙন কবলিতদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে সাত হাজার টাকা দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্থদের। 

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারী উপজেলার বাহাদুরপাড়া, চন্ডিমারী, কুটিরপাড়, কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জ, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ি, সির্ন্দুনা ও সানিয়াজান এলাকায় দিন দিন তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধগুলো। মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড়া ও বাহাদুরপাড়া গ্রামের বালুর বাঁধ। উপজেলার কুটিরপাড় গ্রামে গত এক রাতেই তিস্তায় বিলিন হয়েছে সাতটি বসতভিটা। গ্রামবাসী রাতেই ঘরবাড়ি সড়িয়ে পাশে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। জায়গার অভাবে তারা ঘর উঠাতে পারছেন না। 

সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতিবেশির উঠানে পলিথিনের নিচে বসবাস করছেন তাদের একজন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, গ্রামবাসীর হাতে-পায়ে ধরে ঘর দুইটা সরিয়ে রাস্তায় রেখেছি। স্বামী মরণব্যাধী ক্যান্সারে শয্যাশায়ী। ভাড়া জমিতে করা বসতভিটাও তিস্তার পেটে। এখন বাড়ি করার কোনো জায়গা নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় যাই? ভাই।

একই গ্রামের অজিয়ার রহমান (৮৫) ভেঙে যাওয়া বসতভিটার পাশে বসে ডুকড়ে কাঁদছেন। তার কান্না যেন হিংস্র তিস্তা শুনতেই পাচ্ছে না। কান্নাবিজড়িত কন্ঠে ওই বৃদ্ধ বলেন, জীবনে সব আয় তিস্তার পেটে। জীবনে ২২ থেকে ২৩ বার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে। ত্রাণ চাই না, আমরা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ চাই। যেন ঝুপরী ঘরে হলে নিরাপদে থাকতে পারি। 

ভাঙনের মুখে পড়া গ্রামটির আরেক বাসিন্দা হবিবুর রহমান, আসাদুল বলেন, কুটিরপাড় বালুর বাঁধ থেকে চন্ডিমারী স্প্যার বাঁধ পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাকি অংশটুকুতেও জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা দরকার। তা না হলে পুরো কুটিরপাড় গ্রাম ও বালুর বাঁধটি শিগগিরই তিস্তায় বিলিন হবে। আমরা তিস্তা নদী খনন করে দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি।

তারা বলেন, লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নির্বাচনের সময় তিস্তার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে দীর্ঘদিনের সেই দাবি পূরণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সুত্র জানায়, জেলায় ২৩৬ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। যাদের প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সাত হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, তিস্তা আর ধরলার ভাঙনের শিকার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি পরিবার।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রত্যেককে সাত হাজার করে টাকা ও ২০ কেজি চাল দেয়া হচ্ছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //