বিভূতিভূষণের পরিবেশ ভাবনা প্রসঙ্গ: আরণ্যক

পরিবেশ ভাবনা একটি বিজ্ঞানসম্মত ধারণা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি বিজ্ঞানীদের অধিক ভাবিয়ে তোলে। এরই সূত্র ধরে ১৯৭২ সালের ১৬ জুন গৃহীত হয় স্টকহোম ঘোষণাপত্র। এতে ‘২৬টি নীতিমালা বর্ণনা করা হয়। যার মধ্যে- বায়ু, পানি, মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎসহ প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশে বিষাক্ত দ্রব্যাদি অবমুক্তকরণের ক্ষেত্রে সতর্কতা ইত্যাদি’ স্থান পায় (মুহম্মদ হুমায়ুন কবির, ২০০১ : ৪০৫)।

এ থেকে বোঝা যায় পরিবেশ ভাবনা বিষয়টি মূলত পরিবেশ বিনষ্টের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা থেকেই পরিবেশ ভাবনার জন্ম হয়েছে। ১৯৩৫ সালে আর্থার টেন্সলি প্রথম ইকোসিস্টেম বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন। ১৯৬৬ সালে ওডাম প্রথম উপস্থাপন করেন তার খাদ্য-শৃঙ্খলের ধারণা। যেহেতু ইকোসিস্টেম একটি সমন্বিত ব্যবস্থা তাই এর কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো প্রক্রিয়াটিতে নির্ভরশীল প্রাণিকুল মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। ক্রমেই পরিবেশ বিপর্যয়ের এই সমস্যা প্রভাবিত করেছে সাহিত্য সমালোচনার ধারাকে।

‘১৯৭৮-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে উইলিয়াম রাকার্ত প্রথম ইকোক্রিটিসিজম পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল-  Literature and Ecology : An Experiment in Ecocriticism’ (কবিতা নন্দী চক্রবর্তী, ২০১৭ : ৩৬)

১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ASLE- Association for the Study of Literature and Environment

এই সংস্থার হাত ধরে ২০০৯ সাল থেকে প্রকাশিত হয় সাহিত্য ও পরিবেশ বিষয়ক (ইকোক্রিটিসিজম) গবেষণা পত্রিকা ISLE: Interdisciplinary Studies in Literature and Environment। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় Graham Huggan I Helen Tiffin এর লেখা Postcolonial Ecocriticism বইটি। এভাবেই পাশ্চাত্য দেশে প্রথম ইকোক্রিটিসিজমের সূত্রপাত হয়।

Willam Howarth Zuvi Some Principles of Ecocriticism প্রবন্ধে ইকোক্রিটিসিজমকে বাস্তুতন্ত্রের থেকেও গভীর জ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ecology শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Okios ও Logos থেকে। যার অর্থ দাঁড়ায় বসতবাড়ি স্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান। অন্যদিকে William Howarth বলছেন Eco ও critic শব্দ দুটি গ্রিক শব্দ oikos  ও kritis শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ- ‘বসতির বিচারক’। তার মতে ইকোক্রিটিক ব্যাখ্যা করে কখন মানব সংস্কৃতি প্রকৃতি পরিবেশের জন্য শুভ আর কখন অশুভ। এমনকি রাজনৈতিক কারণ কখনো কখনো প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করে দেয়। 

আধুনিক সময়ে ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার উদ্যোগে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরই ফলে গঠিত হয় Intergovermental Panel on Climate Change (IPCC)। প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত এই প্যানেল প্রতিবেদনে জানায় যে, বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড-এর মতো গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব গ্যাস পৃথিবীর জন্য বৃহৎ ক্ষতি ডেকে আনবে, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পৃথিবীর নিম্নভূমি প্লাবিত হবে।

এরপর ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন। ১৭৯টি দেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। এই সম্মেলনে রিও ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয় এবং তাতে ২১টি এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়। গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনতে সকল সদস্য একমত পোষণ করে। এরই হাত ধরে প্রতি বছর সারা পৃথিবীজুড়ে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। 

দূষণমুক্ত সুস্থ পৃথিবীর চিন্তা থেকেই জন্ম হয়েছে এই বৃহৎ সম্মেলনের। মূলত ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের হাত ধরে আধুনিক সময়ে ব্যাপক হারে পরিবেশদূষণের সূত্রপাত হয়েছে। যন্ত্র ব্যবস্থার অধিক উন্নতি মানুষকে ক্রমেই পরিবেশের শত্রু করে তুলেছে। প্রকৃতি-পরিবেশের এই ধারাবাহিক বিপন্নতার কারণে সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে প্রকৃতিনির্ভর সাহিত্যগুলো। তারা সবুজ-পৃথিবী ও অকৃত্রিম প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে সূত্রপাত করেন পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনার। সাহিত্য ও প্রকৃতি-পরিবেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রকৃতি ভিন্ন সাহিত্য কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সব সাহিত্য পরিবেশবাদী পাঠ দাবি করে না। যেসব সাহিত্যে বিপন্ন পরিবেশ, প্রকৃতি-পরিবেশের স্তব-স্তুতি, পরিবেশের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়- সেসব সাহিত্য পরিবেশবাদী পাঠ দাবি করে।

বাংলা সাহিত্যে পরিবেশবিষয়ক সাহিত্যভাবনার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম স্মরণযোগ্য। যেসময় পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহ পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনেনি সেসময়ই ৩০ আষাঢ় ১৩৩৫ (১৪ জুলাই ১৯২৮)]  রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ-উৎসব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ বনবাণী (১৩৩৮) কাব্যের ভূমিকাংশেই পরিবেশ নিয়ে তাঁর মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন-

ওই গাছগুলো বিশ্ববাউলের একতারা, ওদের মজ্জায় মজ্জায় সরল সুরের কাঁপন, ওদের ডালে ডালে পাতায় পাতায় একতালা ছন্দের নাচন। যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি তা হলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে। মুক্তি সেই বিরাট প্রাণসমুদ্রের কূলে, যে-সমুদ্রের ওপরের তলায় সুন্দরের লীলা রঙে রঙে তরঙ্গিত, আর গভীরতলে ‘শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্’। ( রবীন্দ্র রচনাবলি, অষ্টম খণ্ড ১৪২১ : ৮৭)     

অনাদরে দূরে থাকা কুরচি ফুলকে রবীন্দ্রনাথ কবিতার মধ্য দিয়ে সম্মুখে এনেছেন। মধুমঞ্জরি, নীলমণিলতা ও বাগানবিলাসের বাংলা নাম দিয়ে আপন করে নিয়েছেন দেশের মাটিতে। রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ ও জসীম উদ্দীনের সাহিত্যধারাকে আমরা পরিবেশতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে পারি। তাঁদের রচিত সাহিত্যকর্ম পাঠককে বিপন্ন পৃথিবীর বিপর্যস্ত অবস্থাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইকোক্রিটিসিজম মূলত এমন একটি পাঠ যা সাহিত্য ও ভৌত পরিবেশের মধ্যে সম্পর্কসূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে। পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা মানুষের সঙ্গে মনুষ্যেতর প্রাণিকুল, পরিবেশ ও মানবিক সভ্যতার বিকাশের সম্পর্ক নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত গ্রেগ গ্যারাড তাঁর Ecocriticism গ্রন্থে বলেন- 

Indeed, the widest definition of the subject of ecocriticism is the study of the relationship of the human and the non-human, throughout human cultural history and entiling critical analysis of the term ‘human’ itself. (Greg Garrad, 2013 : 05)

Cheryll Glotfelty I Harold Fromm সম্পাদিত The Ecocriticism Reader নামক গ্রন্থে নিম্নোক্তভাবে ইকোক্রিটিসিজমের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে-

Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment. Just as feminist criticism examines language and literature from a gender-conscious perspectives, and Marxist criticism brings an awareness of modes of production and economic class to its reading of texts, ecocriticism takes an earth-centered approach to literary studies. (Cheryll Glotfelty and Harold Fromm, 1996 : xviii)


বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিখুঁত প্রকৃতির রূপকার হিসেবে অধিক পরিচিত। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুল, লতা-পাতা ও প্রতিদিনকার দেখা পথে-প্রান্তরের বৃক্ষাদির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে। পৃথিবী দেখে মুগ্ধ হওয়াকে যদি দার্শনিকতা বলা হয় তবে বিভূতিভূষণকে দার্শনিক বলতেই হবে। প্রকৃতি ও পৃথিবীর প্রতি বিমুগ্ধতাই মানুষকে তার বাসযোগ্য ভূমন্ডলের প্রতি কৃতজ্ঞ করে তোলে। পৃথিবী দেখে বিস্মিত হতে না শিখলে মানবিক মন হয়ে পড়ে যন্ত্রবৎ।

বসবাসের ভূমি থেকে আমরা যতটুকু গ্রহণ করি ঠিক ততটুকু সেই ভূমিকে ফিরিয়ে দিতে পারলে তবেই দায়বদ্ধতার পরিপূর্ণতা অর্জন সম্ভব। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রকৃতিনির্ভর রচনাগুলোতে সে কথাই জোর দিয়ে বলেছেন। বাংলা অঞ্চল থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত দেখা না দেখা, পরিচিত-অপরিচিত সবুজ পৃথিবীর পরিচয় মেলে বিভূতির সাহিত্যে। অনেক সমালোচকই একসময় বিভূতিভূষণকে নিছক পলায়নবাদী প্রকৃতির কথক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩১), আরণ্যক (১৯৩৯), ইছামতী (১৯৫০) উপন্যাসগুলো পড়তে পড়তে কখনো কখনো একথা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এক রোমান্টিক কল্পনাজগতে বিচরণ করেছেন। কিন্তু উপরিতলের এই চিন্তা বিভূতির ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।

শুধু উপন্যাস সাহিত্যে নয়, সাহিত্যের অন্যান্য অংশেও তিনি সচেতনভাবে সবুজ পৃথিবী, পরিবেশবাদী ভাবনা ও বিপন্ন পৃথিবীর সংকট তুলে ধরেছেন। অভিযাত্রিক (১৯৪১), তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩), ঊর্মিমুখর (১৯৪৪) ও হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮) নামক দিনলিপি ও স্মৃতিকথায় বিভূতিভূষণ পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষ, বন, অরণ্যানী ও প্রাণিকুলের জন্য অভয়ারণ্য সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই বিভূতির সাহিত্যে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বাঙ্ময় সত্তা। মানুষের মতো প্রাণসত্তায় কথা বলে ওঠে বিভূতির প্রকৃতি আর সে কারণেই তাঁর গ্রন্থের নাম হয়ে ওঠে- হে অরণ্য কথা কও। 

দিনলিপির পাতায় তিনি অক্লেশে নিউটন-কেপলার-গ্যালিলিওর কথা লিখেছেন, লিখেছেন অধুনালুপ্ত প্রাচীন পৃথিবীর জীবনের কথা, বহু ধাতুর কথা, এক্স-রে-বিদ্যুৎ- চৌম্বক শক্তি ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের কথা, নক্ষত্ররাজি ও Globular Cluster-এর কথা। তাঁর পঠিত বইয়ের বিষয়-বৈচিত্র্য বিশাল- নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল, বিজ্ঞান কিছুই বাদ পড়েনি, এমনকি ছুটে গেছেন- Indian Association for Cultivation of Science-এ James Jeans ev Eddington-এর বক্তৃতা শুনতে। Emerson-Thoreau- র পরিবেশ-চিন্তা পড়ছেন, আইনস্টাইনের Herbert Spencer Lecture অনুধাবন করছেন, উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম শিখছেন। (প্রসাদরঞ্জন রায়, ২০১৪ : ১১১)

উপন্যাসে কোনো কোনো সময় বিশেষ কোন আন্দোলন, সামাজিক সচেতনতা বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে রচিত হলেও এর মধ্যে কল্পনাপ্রসূত আখ্যান ও সাহিত্যিকের মৌলিক চিন্তা এবং আখ্যানকে পাঠক সমাজের মাঝে উপস্থাপনের ভঙ্গিই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তেমনি আরণ্যক উপন্যাসের পরিবেশ ভাবনা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রচলিত সাহিত্যচিন্তার বাইরে পরিবেশ ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক, শিল্পীর শুভবোধ ও আধুনিক মানুষের আগ্রাসী মনোবৃত্তি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘পরিবেশ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে। একজন আবহাওয়াবিদ বা জলবায়ুবিজ্ঞানীর কাছে যদি হয় তা বায়ুমন্ডল, তো একজন পরিবেশ প্রকৌশলীর কাছে কোন আবদ্ধ স্থান, আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য। প্রতিবেশ বিজ্ঞানীর কাছে পরিবেশ আর বসতি সমার্থক। উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান এই বসতি। সাধারণভাবে বলা যায়, আমাদের চারপাশে যা আছে তাই পরিবেশ। এটি সপ্রাণ প্রাণী ও নিস্প্রাণ বস্তুজগতের সমন্বয়ে গঠিত। উদ্ভিদ ও জীবজগতের পাশাপাশি বায়ু, মাটি ও জল বা জড় উপাদানগুলোও এর সমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’ (মুহম্মদ হুমায়ুন কবির, ২০০৮ : ২৩৭)

পরিবেশের প্রধান দুটি ভাগ বিদ্যমান- ভৌত পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। ভৌত পরিবেশই ইকোক্রিটিসিজমের মূল আলোচনার ক্ষেত্র। ভৌত পরিবেশ আবার দু’প্রকার- জৈব পরিবেশ ও অজৈব পরিবেশ। জৈব পরিবেশের মধ্যে- বৃক্ষ, লতা, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, কীটপতঙ্গ ও যে কোনো প্রাণী বিবেচ্য।

অন্যদিকে অজৈব পরিবেশের মধ্যে- মাঠ, তেপান্তর, মরু, মাটি, জল, সূর্যালোক, বায়ু, ভূ-গর্ভস্থ সম্পদ ইত্যাদি। উপর্যুক্ত সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী এটুকু বলা যায় যে- পরিবেশ ছাড়া, প্রকৃতি ছাড়া সাহিত্য অসম্ভব। সেই অর্থে সকল সাহিত্যেই থাকে প্রকৃতি। কিন্তু যেসব সাহিত্যকর্মে পরিবেশের গুরুত্ব, প্রকৃতির বিপন্নতা বিষয়ে সাহিত্যিকের শঙ্কা-উৎকণ্ঠা বিশেষ ভাবনার জায়গা দখল করে থাকে সেসব সাহিত্যকর্ম পরিবেশবাদী পাঠের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। বিভূতিভূষণের সমগ্র সাহিত্য বিচার করে তাঁকে আমরা শুধু সাহিত্যিকই নয়- একজন উদ্ভিদতত্ত্ববিদ, উদ্যানতত্ত্ববিদ, নিসর্গতাত্ত্বিক বলতে পারি। উপন্যাস সাহিত্যের মধ্যে আরণ্যক-এ বিভূতিভূষণের পরিবেশচিন্তার অধিক প্রতিফলন দেখা যায়। আরণ্যক-এ মানবচরিত্র যেমন গুরুত্ব পেয়েছে তেমনি গুরুত্ব পেয়েছে গাছগাছালি ও ভৌত পরিবেশ। এখানে বন-বনানী হয়ে উঠেছে প্রাণময় সত্তা। ‘আরণ্যক-ই বিভূতিভূষণের একমাত্র উপন্যাস যেখানে তিনি মানব-নিরপেক্ষ প্রকৃতিকে মানুষের চেয়ে বড় করে দেখিয়েছেন।’ (জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পরিশিষ্ট-খ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪২৪ : ১৫)

বর্তমান পৃথিবীর আগ্রাসী মানবসভ্যতা যেভাবে সবুজ বনভূমি ধ্বংস করে বসতবাড়ি, শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে বিভূতিভূষণের কাছে তা পাপেরই নামান্তর। ফলে আরণ্যক উপন্যাসের প্রস্তাবনায় তিনি সত্যচরণের মুখ দিয়ে নাঢ়া-বইহারের জঙ্গল উচ্ছেদকে আত্মস্বীকৃত পাপ বলে বর্ণনা করেছেন। সত্যচরণের অরণ্যভূমির স্মৃতি তাই সুখের নয় বরং দুঃখের। কারণ সত্যচরণকে ত্রিশ হাজার বিঘা জঙ্গল বিলি-বন্দোবস্তের মাধ্যমে চাষযোগ্য জমি বের করার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। মানুষের হাতেগড়া কৃত্রিম শহর ও মানুষের স্পর্শহীন বনপ্রান্তরের মধ্যকার পরিবেশগত পার্থক্য বিভূতিভূষণ উপন্যাসের প্রস্তাবনা অংশে উল্লেখ করেছেন।

নিকটেই একটা বাদাম গাছ, চুপ করিয়া খানিকটা বসিয়া বাদামগাছের সামনে ফোর্টের পরিখার ঢেউখেলানো জমিটা দেখিয়া হঠাৎ মনে হইল যেন লবটুলিয়ার উত্তর সীমানায় সরস্বতী কুণ্ডীর ধারে সন্ধ্যাবেলায় বসিয়া আছি। পরক্ষণেই পলাশী গেটের পথে মোটর-হর্নের আওয়াজে সে ভ্রম ঘুচিল। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খ- ১৪০৩ : ০৩)

কৃত্রিম শহর বন্যপ্রান্তরের সরস্বতী কুণ্ডী শান্তি দিতে পারেনি সত্যচরণকে। ইট-কাঠের শহরে মানুষের হাতে গড়া ফোয়ারা, পরিখার পাশে যখন যান্ত্রিক জীবন দৌড়ে বেড়ায় তখন তা আর নিবিড় রহস্যময় হয়ে উঠতে পারে না। ‘কেট সোপার তাঁর প্রবন্ধে প্রকৃতিকে তিনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-

১. অধিবিদ্যা সংক্রান্ত ধারণা 

২. বস্তুবাদী ধারণা

৩. স্থানগত ধারণা (সুমিতা নন্দী চক্রবর্তী, ২০১৭ : ৩৮) 

আরণ্যক উপন্যাসে উপর্যুক্ত তিনস্তরেরই সন্ধান পাওয়া যায়। তবে স্থানগত ধারণা উপন্যাসে অধিক উজ্জ্বল। কেননা স্থানগত ধারণার আলোচ্য বিষয় পরিবেশের ভৌত উপাদান সমূহ যেমন- বনভূমি, প্রাণী, মাটি, জল, উষ্ণতা ইত্যাদি। অধিবিদ্যা সংক্রান্ত ধারণা অনুসারে নাঢ়া-বইহার-লবটুলিয়া-আজমাবাদের জঙ্গল বহু বৈচিত্র্যময়। কখনো ছোট বনঝাউ, কাশবন আবার কখনো দিগন্তব্যাপী বনপ্রান্তর, কোথাওবা শীর্ণকায়া জলাশয়, কোনো কোনো স্থান উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। 

Ecocriticism -এর অন্যতম আলোচ্য অকর্ষিত ভূমি, গ্রামজীবনকেন্দ্রিক গল্পগাথা ও রহস্যময় প্রকৃতি। মানুষের পৃথিবীর পরিবেশ পরিপূর্ণতা পায় এসব বিষয়-ব্যবস্থা সমেত পরিবেশ টিকে থাকলে। অথচ প্রতিনিয়ত মানুষ ধ্বংস করে চলছে রহস্যময় প্রকৃতিকে। বুনো পরিবেশ, গ্রামজীবনকেন্দ্রিক গল্প-গাথা ও রহস্যময়ী প্রকৃতির বর্ণনা যে কোনো সাহিত্যকে পরিবেশ ভাবনায় সচেতন মর্যাদা দিতে পারে। আরণ্যক উপন্যাসে লেখক প্রকৃতিকে বহুবার রহস্যময় বলে বর্ণনা করেছেন। প্রথমদিকে এই বন্য পরিবেশ সত্যচরণের কাছে ভীতিকর বলেই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে Wild-animal এর বসবাসের জায়গায় মানুষ হিসেবে তার প্রবেশ উচিত হয়নি।

মনে কেমন যেন একটা উদাস বাঁধহীন মুক্ত ভাব- মন হু-হু করিয়া ওঠে, চারিধারে চাহিয়া সেই নীরব নিশীথরাত্রে জ্যোৎস্না ভরা আকাশতলে দাঁড়াইয়া মনে হইল এক অজানা পরীরাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি- মানুষের কোনো নিয়ম এখানে খাটিবে না। এই সব জনহীন স্থান গভীর রাত্রে জ্যোৎস্নালোকে পরীদের বিচরণভূমিতে পরিণত হয়, আমি অনধিকার প্রবেশ করিয়া ভালো করি নাই। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ১৫)

আরণ্যক উপন্যাসে সরস্বতী কুণ্ডীর এক বিশেষ ভূমিকায় উপস্থাপিত হয়েছে। অরণ্যের মধ্যে এ অন্য এক গভীর জীবনের ইঙ্গিত দেয়। একে একে যখন পুরো জঙ্গল বিলি করা শেষ তখন সত্যচরণ শেষপর্যন্ত সরস্বতী কুণ্ডীকেই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। জলের তেষ্টায় বিষাক্ত সাপ করাত, শঙ্খচিতি ও বুনো মহিষ সরস্বতী কুণ্ডীতে পাশপাশি জলে নামে। পরিবেশের পরিপূর্ণ উপাদান হিসেবে বন্যপ্রাণী ও তাদের সহাবস্থান চিহ্নিত করা যায় এর মধ্যদিয়ে। এই অবস্থাকে বর্তমান পরিবেশবিদদের পরিভাষায় বলা হয়-Eco-friendly-relation। পরিবেশের পরস্পর নির্ভরশীল উপাদানগুলো কোন প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক গতিতে ভারসাম্য ধরে রাখে এটা তার নিখুঁত উদাহরণ। শুধু তাই নয় অত্যধিক তাপদাহে বনে আগুন লেগে পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র আঁকতেও ভুল করেননি বিভূতিভূষণ। তাই আরণ্যকে যেমন প্রশান্তিময় স্নিগ্ধ প্রকৃতির উল্লেখ আছে তেমনি প্রকৃতির ক্রূর রূপের অবশ্যম্ভাবী ঘটনার বর্ণনাও আছে।

বর্তমান দুনিয়ার মানুষ ব্যক্তিগত সুখ ও অধিক সঞ্চয়ের জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে প্রকৃতি-পরিবেশ ভারসাম্যহীন হতে বাধ্য। কেননা অধিক সুখভোগের ভোগবাদী ধারণা মানুষকে সৌন্দর্যবোধ, শিল্পবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের দায়িত্ববোধ থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতীয় চিন্তাচেতনায় স্বল্প সঞ্চয়ের ধারণা, ব্যক্তির থেকে সমষ্টির মঙ্গলের ধারণা অধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। যখনই মানুষ ব্যক্তিগত চিন্তা বিসর্জন দিয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদের বাইরে সম্পদ কুক্ষিগত করার চিন্তা বাদ দেবে তখনই পরিবেশের বিপর্যস্ত অবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবেশ নিজেই সামলে উঠবে।

আরণ্যক উপন্যাসে মুনেশ্বর সিং-এর প্রত্যাশা অধিক কিছু নয়। মাত্র একখানা লোহার কড়াই। রান্নাবান্না ও ভাত খাওয়ার সুবিধার জন্য তার ঐ একমাত্র চাওয়া, এর অধিক কিছু মুনেশ্বর প্রত্যাশা করে না। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র রাজু পাঁড়ে। লেখক যাকে সত্যিকারের সাত্ত্বিক লোক বলেছেন। দু-বিঘা জমি রাজুকে সত্যচরণ দিয়েছিল চাষবাসের জন্য কিন্তু একবছরে রাজু তেমন জমি চাষাবাসের উপযোগী করতে পারে নাই। মূলত রাজু বিষয়-সম্পত্তিতে একেবারেই আকর্ষণ অনুভব করে না। জীবনে উন্নতি বলতে যা বোঝায় রাজু পাঁড়ে তাকে আমলেই নেয় না। শুধু তাই নয় রাজু বন-জঙ্গলকে দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। এই রাজু পাঁড়ে আবার মানুষের রোগ-শোকে নিজেকে উজার করে দেয়। শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরায় রাজু একমাত্র চিকিৎসক হয়ে ওঠে।

চিকিৎসা করাতে গিয়েও সে কারো কাছে কিছু গ্রহণ করে না। যে যতটুকু খুশি হয়ে দেয় ততটুকুই তার প্রাপ্য বলে সে মেনে নেয়। সারাদিন রাত পরিশ্রম করে রাজুর উপার্জন এক টাকা তিন আনা। রাজু তাতেই খুশি। এই নিবিড় ঘন বনে বসবাসরত মানুষগুলোর চরিত্রচিত্রণে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জটিল জীবনের সংকটকে গুরুত্ব দেননি বরং সবুজ বৃক্ষের মতো সহজ-সরল করে তৈরি করেছেন মানুষগুলোকে। রাজু সেই জীবনেরই প্রতিনিধি। যারা বৃক্ষ-লতার সঙ্গে সহাবস্থান তৈরি করেছে। যারা বৃক্ষের ফলে ক্ষুধা যেমন দেখতে পায়, তেমনি ফল-ফুলে সৌন্দর্যও দেখতে পায়। ফুল-পাখি-বাতাসকে তারা দেবতাজ্ঞান করে।

তারপর বলিল- জীবনের সময়টা বড় কম হুজুর। জঙ্গল কাটতে গিয়ে কত কথা মনে পড়ে, বসে বসে ভাবি। এই যে বন-জঙ্গল দেখছেন, বড় ভালো জায়গা। ফুলের দল কত কাল থেকে ফুটছে আর পাখি ডাকছে, বাতাসের সঙ্গে মিলে দেবতারা পৃথিবীর মাটিতে পা দেন এখানে। টাকার লোভ, পাওনাদেনার কাজ যেখানে চলে, সেখানকার বাতাস বিষিয়ে ওঠে। সেখানে ওঁরা থাকেন না। কাজেই এখানে দা-কুড়–ল হাতে করলেই দেবতারা এসে হাত থেকে কেড়ে নেন-কানে চুপি চুপি এমন কথা বলেন, যাতে বিষয়-সম্পত্তি থেকে মন অনেক দূরে চলে যায়। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৪৬)

বিভূতিভূষণ সচেতনভাবে ‘ওঁর’ শব্দটিতে ‘ ঁ’ (চন্দ্রবিন্দু) বসিয়ে দিচ্ছেন। বন-লতা-বৃক্ষ ও বনের পশু-পাখিকে বসিয়ে দিচ্ছেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসন। পরিবেশের প্রতি এই সমর্পণই পারে আজকের বিপন্ন পৃথিবীকে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। এই ভাবনা কোনো ব্রাত্য মানুষের পৌরাণিক বিশ্বাসের ভাবনা নয়, বরং এটি আধুনিক চিন্তা সম্পন্ন মানুষের দায়বদ্ধতার ভাবনা, শিল্পের ভাবনা, ভূ-দেবতার প্রতি বিনম্র ভাবনা।

ভারতীয় জীবনব্যবস্থাসহ পৃথিবীর সবপ্রান্তেই বন-জঙ্গল সম্পর্কে ভয়ার্ত গল্প, বিশ্বাস মানুষের সভ্যতার সঙ্গে মিশে আছে। গ্রামীণগাথা, গল্প, কবিতার এই ধারা বহুদিন রহস্যময় বন-বনানীকে ও বন্যপ্রাণীকে মানুষের করাল গ্রাস থেকে দূরে রেখেছে। এসব গল্প-গাথা রাখালিয়া কবিতা গ্রামীণ জনজীবনের ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আরণ্যক উপন্যাসে ‘ডামাবাণু’ ও ‘টাঁড়বারো’র ঘটনা তেমনি ভিন্ন দুটি বিশ্বাস। বোমাইবুরুর জঙ্গলে যারা বসবাস করতে আসে সকলেই রাতের বেলা কখনো সাদা কুকুর অথবা কখনো পরী দেখতে পায়। সত্যচরণ এই গোপন সত্যটি চেপে রেখে রামচন্দ্র আমীন ও তার পেয়াদা আস্রফি টিন্ডেলকে বোমাইবুরুতে চাষবাসের জন্য জমি দেয়। রাতে সাদা কুকুর দেখে রামচন্দ্র আমীন, আসরিফ দেখে যুবতী নারী। পাগল হয়ে যায় রামচন্দ্র আমীন। আরও পরে একবৃদ্ধ তার ছেলেকে নিয়ে বোমাইবুরুতে বসবাস শুরু করলে একই ঘটনা ঘটতে থাকে। বৃদ্ধের ছেলের ঘর থেকে সুন্দরী নারী আসে প্রতি রাতে। বৃদ্ধ দেখতে পেলেও তার ছেলে কিছুই জানে না। অঘোরে মরে যায় বৃদ্ধের ছেলে। আস্রফির ভাষায় ঔপন্যাসিক বলেন-

ঠাকুরদাদার মুখে শুনেছি, বোমাইবুরু পাহাড়ের ওপরেই ওই বটগাছটা দেখেছেন দূরে- একবার তিনি পূর্ণিয়া থেকে কলাই বিক্রির টাকা নিয়ে জ্যোৎস্না-রাতে ঘোড়ায় করে জঙ্গলের পথে ফিরছিলেন- ওই বটতলায় এসে দেখেন একদল অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে হাত-ধরাধরি করে জ্যোৎস্নার মধ্যে নাচছে। এদেশে বলে ওদের ‘ডামাবাণু’- এক ধরনের জীনপরী, নির্জন জঙ্গলের মধ্যে থাকে। মানুষকে বেঘোরে মেরে ফেলে। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৪১)

ডামাবাণুর এই বিশ্বাস অরণ্য সম্পর্কে এক ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলে মানুষের ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি থেকে প্রাকৃতিক নিয়মেই রক্ষা পায় বনজ বৃক্ষাদি। পৃথিবীর বহু স্থানই এসব লোকবিশ্বাসের ওপর ভর করে অকর্ষিত বনভূমি রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সত্যচরণ সেই মানুষেরই প্রতিনিধি যারা মনেকরে প্রকৃতিকে শাসন করে, প্রকৃতিকে জয় করে, প্রকৃতিকে কর্ষণ করেই পৃথিবীর সভ্যতা এগিয়ে যাবে। ফলে এসব সভ্যতাদর্পী মানুষের হাতে পরিবেশ বিনষ্ট অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।

বিভূতিভূষণ মনে করতেন জনমানবহীন অরণ্যে মানুষের বিচরণ মানেই অরণ্যভূমির অবধারিত সর্বনাশ। অথচ সত্যচরণকে এই বন উচ্ছেদ করে কৃষিজমি তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। অধিক জনসংখ্যা, অধিক উৎপাদন ও মানব সভ্যতার লোভাতুর চিন্তা বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ। এর বিপরীতে ভয়ার্ত গল্প, রাক্ষস-খোক্কসের লোককাহিনির মধ্যদিয়ে টিকে থাকে নির্লোভ অশিক্ষিত মানুষের আশপাশে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক বন। অন্যদিকে সভ্যতার মূলস্রোতে বসবাসকারী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে লোকবিশ্বাস গুরুত্ব পায় না বরং গুরুত্ব পেতে পারে মানুষের বোধ, জ্ঞান ও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের ভাবনা। পৃথিবী শুধু মানুষের বাসভূমি নয় বরং পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে সব প্রাণীর। প্রাণিকুলের শক্তির কেন্দ্রে যেহেতু অধিষ্ঠিত হয়েছে মানুষ তাই মহাবিশ্বের ভালো-মন্দ ও সকল জীবজগতের বাঁচার জন্য সুনিশ্চয়তা বিধান মানুষকেই করতে হবে।

নতুবা মানুষের মহত্ত্ব ভূ-লুণ্ঠিত হতে বাধ্য। সৃষ্টির সেরা হিসেবে আস্ফালন করার সুযোগ আমাদের মোটেও নেই। অথচ বনভূমি ধ্বংস, প্রাণিকুল ধ্বংস, আলো-বাতাস-মাটি ও আকাশ দূষণ মানুষই করছে। ফলে ইতোমধ্যে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে উঠেছে এক ভয়াবহতম শোষক প্রাণী। মানুষ শিকার করছে, মানুষ পাহাড় কাটছে, মানুষ নদীতে বাঁধ দিচ্ছে, যথেচ্ছ ভূ-গর্ভস্থ খনিজ আহরণ করছে, ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানুষ যেদিন থেকে নিজেকে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভু হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেদিন থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে। ইকোসিস্টেমের ধারণায় মানুষ প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার বাইরে আপন জগতের মধ্যে কৃত্রিম ইকোসিস্টেম তৈরি করে নিয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা ও পাহাড়-নদী-ভূমি এসকলের কাছে যে তার পরিবেশগত, বাস্তুসংস্থানগত দায় আছে মানুষ তা দম্ভের সঙ্গে অস্বীকার করেছে।

ফলে সভ্যতার সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষ পরিবেশের সংহারকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে প্রতিনিয়ত। শিকার বিষয়ে আরণ্যক উপন্যাসের ‘টাঁড়বারো’ দেবতার প্রতি বিশ্বাস মহিষের প্রজাতি রক্ষায় বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রাণিকুলের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থেকেছে শিকারীদের এই লোকবিশ্বাসের দরুণ। শিকারি নিকটবর্তী হলে মহিষের দেবতা ‘টাঁড়বারো’ বুনো মহিষের দলের সামনে হাত তুলে দাঁড়ায়। উপন্যাসে গনোরি তেওয়ারীর মুখে লেখক বর্ণনা করেছে ‘টাঁড়বারো’র আশ্চর্য কাহিনি।

হঠাৎ দেখি গর্তের ধারে, গর্তের দশ হাত দূরে এক দীর্ঘাকৃতি কালোমত পুরুষ নিঃশব্দে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এত লম্বা সে-মূর্তি, যেন মনে হল বাঁশঝাড়ের আগায় ঠেকেছে। বুনো মহিষের দল তাকে দেখে থম্কে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক পালাল, ফাঁদের ত্রিসীমানাতে এলো না একটাও। বিশ্বাস করুন আর না করুন, নিজের চোখে দেখা। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৭৮)

এই মহিষের গাড়ির অমানবিক বোঝা বহনের দৃশ্য কলকাতায় দেখে সত্যচরণ আক্ষেপ করেছে যে সেখানে ‘টাঁড়বারো’ নেই। এই আক্ষেপ মূলত সভ্যতাদর্পী মানুষের প্রাণী সহানুভূতিশীল বৈশিষ্ট্যের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। কলকাতায় অধিক পণ্য বোঝাই করা গাড়ি আর গাড়োয়ানের নির্মমভাবে মহিষের ওপর চামড়ার পাঁচন দিয়ে আঘাত করার দৃশ্য সত্যচরণের কাছে নির্মম বলে মনে হয়েছে। কলকাতা শহর কোনো অরণ্যভূমি নয়, এখানে মহিষের দেবতা ঠিক পরাজিত রাজা দোবরু পান্নার মতই অসহায়। আর আধুনিক সভ্যতার কাছে অসহায় এই পশুসমাজ, অত্যাচারিতও বটে। পরিবেশের সঙ্গে গৃহপালিত ও বন্যপশুর নিবিড় যোগাযোগের ব্যাপারটি এর মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পশুর ওপর মানুষের অমানবিক শ্রম চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি আধুনিক প্রাণী সংরক্ষণ আইনের ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

আরণ্যক উপন্যাসের জৈব পরিবেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান দুটি উপাদান বেশ বড়ো জায়গা দখল করে আছে তাহল- পাখি ও ফুল। লবটুলিয়ার হ্রদ সরস্বতী কু-ীর ধারে বাস করা পাখির একটি তালিকা বিভূতিভূষণের পাখিপ্রেম ও পরিচিতি বিষয়ে পাঠককে অবাক করে। শ্যামা, শালিক, হরটিট্, বনটিয়া, ফেজান্টক্রো, চড়াই, ছাতারে, ঘুঘু, হরিয়াল, বাজবৌরী, চিল, কুল্লো, বক, সিল্লি, রাঙাহাঁস, মানিকপাখি, ডাকসহ বহু জলচর ও স্থলচর পাখির বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। সরস্বতী কুণ্ডীকে আমরা অবশ্যই ডরষফবৎহবংং বলতে পারি। পরিবেশতাত্ত্বিকরা যখন Wilderness এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি তখনই বিভূতিভূষণ তাঁর ঊর্মিমুখর নামক স্মৃতিকথায় Vast Wilderness শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করছেন। ‘বিশাল নির্জনতা, যেন চারপাশের জঙ্গলে আকাশের নক্ষত্র-জগৎ তার রাজত্ব বিস্তার করছে- Vast Wilderness!’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ৫ম খ- ১৪০৩ : ২৪৯) আর পরিবেশগত ভারসাম্য রাখতে এই অভয়ারণ্যের ( Sanctuary) ভূমিকার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক।

অনেক সময় মানুষকে গ্রাহ্যই করে না, আমি শুইয়া আছি দেখিতেছে, আমার চারপাশে হাত- দেড়-দুই দূরে তারা ঝুলন্ত ডালপালায়-লতায় বসিয়া কিচ্ কিচ্ করিতেছে- আমার প্রতি ভ্রুক্ষেপও নাই।

পাখিদের এই অসংকোচ সঞ্চারণ আমার বড় ভালো লাগিত। উঠিয়া বসিয়াও দেখিয়াছি তাহারা ভয় পায় না, একটু উড়িয়া গেল, কিন্তু একেবারে দেশছাড়া হইয়া পলায় না। খানিক পরে নাচিতে নাচিতে বকিতে বকিতে আবার অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়ে। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৬৪)

এই পরিবেশকে আমরা বলতে পারি ঊপড়-Eco-friendly-relation। যেখানে বন্যহরিণ নির্ভয়ে মানুষের নিকটে ঘুরে বেড়ায়, পাখির দল নির্ভয়ে মানুষের ঘরে প্রবেশ করে। পাখি মানুষ দেখে ভীত হচ্ছে না, হরিণ ভীত হচ্ছে না বরং মানুষের নিকটে এরা চেঁচামেচি করতে থাকে। মানুষে-পাখিতে-পশুতে এই পারস্পারিক ভয়লেশহীন অসংকোচ সত্যচরণকে মুগ্ধ করেছিল। এই মুগ্ধতা বিভূতিভূষণেরই সচেতন প্রকৃতি-পরিবেশ ভাবনার ফসল। সরস্বতী কুণ্ডীর ফুলের সমাহারে শুধু সাধারণ পাঠকই নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন উদ্ভিদতত্ত্ববিদও আশ্চর্য হয়ে যাবে। পরিচিত-অপরিচিত মিলে বহু ফুল ও লতার সমাহার ঘটিয়েছিল যুগলপ্রসাদ ও সত্যচরণ।

শুধু নাম উল্লেখের জন্য হলেও এই তালিকা বেশ দীর্ঘ হবে। ভিঁয়োরা লতা, বনজুঁই, শিউলি, ময়না কাঁটা, ভুঁই কুমড়া, এরিস্টোলোকিয়া (হংস-লতা), হোয়াইট বিম, রেড ক্যাম্পিয়ন, স্টিচওয়াট, ফক্সগ্লাভ, উড অ্যানিমোন, ডগরোজ, বয়ড়া লতা, ওয়াটার ক্রোফট, দুধিয়া- এসমস্ত ফুলের সমাহার সম্ভব হয়েছিল যুগলপ্রসাদের ব্রাত্য মনের কারণে। সত্যচরণ ও যুগলপ্রসাদ এ বিষয়েও সচেতন ছিল যে দেশি ফুলের জায়গা যাতে বিদেশি আগ্রাসী ফুল দখল করে না নেয়। এ জন্য ওয়াটার ক্রোফ্ট ও বোগেনভিলিয়া রোপণে সাবধানতা অবলম্বন করেছে। একজন সচেতন নিসর্গবিদ ছাড়া এমন স্বচ্ছ পরিবেশ ভাবুকের দেখা পাওয়া সত্যিই মুশকিল।

 হ্রদের জলে ‘ওয়াটার ক্রোফ্ট’ বলিয়া এক প্রকার জলজ ফুলের গেঁড় পুঁতেছিলাম। সে গাছ হু-হু করিয়া এত বাড়িতে লাগিল যে, যুগলপ্রসাদের ভয় হইলে জলে পদ্মের স্থান বুঝি ইহারা বেদখল করিয়া ফেলে!

বোগেনভিলিয়া লতা লাগাইবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শহরের সৌখিন পার্ক বা উদ্যানের সঙ্গে এতই ওর সম্পর্কে জড়ানো যে আমার ভয় হইল, সরস্বতী কুণ্ডীর বনে ফুলেভরা বোগেনভিলিয়ার ঝোপ ইহার বন্য আকৃতি নষ্ট করিয়া ফেলিবে। যুগলপ্রসাদেরও এসব বিষয়ে মত আমার ধরনের। সেও বারণ করিল। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৬৮)

আরণ্যক উপন্যাসে ফুল-বৃক্ষ-লতা এবং পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর তালিকা করা হল। আগ্রহী পাঠক সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন বিভূতিভূষণের প্রকৃতিজ্ঞানের পরিধি।


নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে আরণ্যক উপন্যাসের উদ্ভিদরাজির এক বৃহৎ তালিকা উদ্ধৃত করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বলেন- 

প্রকৃতিপ্রেম ও মানবপ্রেম, বিশেষত দারিদ্র্যজনের প্রতি ভালোবাসা একটি অখণ্ড বাস্তবতা ও সেজন্য পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। ‘আরণ্যক’ গ্রন্থে এ দুয়ে মিলেমিশে এমন একটি আশ্চর্য যৌগ সৃষ্টি করেছে যা পাঠককে একাধারে আবিষ্ট ও উজ্জীবিত করে। বইটি বার বার পড়তে ইচ্ছে হয় এবং কিছুতেই ভোলা যায় না সেইসব প্রকৃতির সন্তান ও গাছগাছালিকে যারা শত শত বছর ধরে সহবাসের মধ্যে মিথোজীবিতা সৃষ্টি করেছে যা যন্ত্রসভ্যতা নির্মমভাবে বিনষ্ট করেছে। (দ্বিজেন শর্মা, ২০০৭ : ৭৯)

আধুনিক সময়ে আমরা উপযোগবাদ ও সৌন্দর্যের মধ্যে অন্ধভাবে শুধুই উপযোগকেই গ্রহণ করেছি। ফলে অরণ্যের পর অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মানুষের হাতে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সমষ্টির মঙ্গল সম্পৃক্ত না হয়ে ভোগবাদী পৃথিবী ধনতন্ত্রকে জাগ্রত করছে। ধনের শ্রীলক্ষ্মী বড়ো না হয়ে কুবের নামক শ্রীহীন ধনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। উন্নয়ন হয়ে পড়েছে সৌন্দর্যের সংহারকর্তা। সত্যচরণ যাকে ‘বিউটি স্পট’ বলেছে তা তারই হাতে ধ্বংস হওয়ার কষ্ট তাকে পীড়িত করছে। ওপরওয়ালার জমি প্রজাবিলি করার তাগিদ তাই সত্যচরণকে ভাবিয়ে তুলেছে।

কিন্তু এখানে প্রজা বসাইয়া প্রকৃতির এমন নিভৃত কুঞ্জবনকে নষ্ট করিতে মন সরে না। যাহারা জমি ইজারা লইবে, তাহারা তো জমিতে গাছপালা বনঝোপ সাজাইয়া রাখিবার জন্য কিনিবে না- কিনিয়িাই তাহারা জমি সাফ করিয়া ফেলিবে, ফসল রোপণ করিবে, ঘর-বাড়ি বাঁধিয়া বসবাস শুরু করিবে-এই নির্জন শোভাময় বন্য প্রান্তর, অরণ্য, কুণ্ডী, শৈলমালা জনপদে পরিণত হইবে, লোকের ভিড়ে ভয় পাইয়া বনলক্ষ্মীর ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাইবেন- মানুষ ঢুকিয়া এই মায়াকাননের মায়াও দূর করিবে, সৌন্দর্যও ঘুচাইয়া দিবে।

সে জনপদ আমি মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখিতে পাই। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৬৯)

পরিবেশ সংকটের দিক দিয়ে যে অনুন্নত দেশগুলো অধিক সংকটে ভুগছে বিভূতিভূষণ তা স্পষ্ট জানিয়ে দেন উপন্যাসে। উন্নত দেশ তাদের বনভূমি সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করে। শহুরে মানুষের ক্লান্তি ঘোচানোর স্থান হয় এই সংরক্ষিত প্রান্তর। কিন্তু আমাদের মতো অনুন্নত দেশে তা হবার যো নেই। কেননা বিশাল জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা আমাদের পরিবেশ ভাবনাকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসছে। ফলে আমরা মুমূর্ষু অর্থনীতির দুষ্টচক্রে পড়ে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য সবকিছুকেই ভোগ করে চলছি।

এমন বিশাল, বাধাবন্ধনহীন, উদ্দাম সৌন্দর্যময়ী আরণ্যভূমি দেশের একটা বড় সম্পদ- অন্য কোনো দেশ হইলে আইন করিয়া এখানে ন্যাশনাল পার্ক করিয়া রাখিত। কর্মক্লান্ত শহরের মানুষ মাঝে মাঝে এখানে আসিয়া প্রকৃতির সাহচর্যে নিজেদের অবসন্ন মনকে তাজা করিয়া লইয়া ফিরিত। তাহা হইবার জো নাই, যাহার জমি সে প্রজাবিলি না করিয়া জমি ফেলিয়া রাখিবে কেন? (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৭০)

ছুট সিং নামক রাজপুতকে হাজার বিঘা জমি প্রজাবিলি করতে গিয়ে সত্যচরণের বারবার মনেহয়েছে এই অঞ্চলের সুন্দর ঝোঁপঝাড়, লতাবিতান নির্মমভাবে নষ্ট হবে। নাঢ়া বইহারের যে বনকে সত্যচরণ ‘বিউটি স্পট’ বলেছিল সেই বন ধ্বংসের খেদ নিজেই করেছে- ‘এই বন একটা বিউটি স্পট-গেল নে বিউটি স্পট’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৭৩)।

সত্যচরণের এ এক অক্ষম আর্তনাদ। আধুনিক নগর রাষ্ট্রের শ্রীহীন চেহারার কথা নক্ছেদী ভকতের স্ত্রী মঞ্চীর কথায়। কলকাতার মতো নগরের সঙ্গে গাছের নিবিড় সম্পর্ক নেই। বসবাসে জন্য কেবল ইটকাঠ ও পাথর যেনো মানুষের গড়ে তোলা শহরকে প্রাণহীন করে তুলছে। মানুষের বসতস্থলের মধ্যে ফাঁকা স্থান, সবুজ বৃক্ষ ও প্রান্তর না থাকলে তা যে কতখানি ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে বড় বড় নগরগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক নগরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যান্ত্রিক জীবন, কালো ধোয়া, কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদি। ভোগবাদী জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য পৃথিবী শোষণ করে বিলাস-ব্যাসনের সামগ্রী উৎপাদনই এই শহরের মূলকথা। অথচ মঞ্চী গাছ ছাড়া বসবাসের পরিবেশ চিন্তাই করতে পারে না। 

‘মেয়েটি খুবই সপ্রতিভ। জিজ্ঞাসা করিল-কলকাতায় থাক বাবুজী?

- হ্যাঁ।

- কি রকম জায়গা? আচ্ছা, কলকাতায় নাকি গাছ নাই? ওখানকার সব গাছপালা কেটে ফেলেছে? (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৮১)

Eco-criticism এর অন্যতম আলোচ্য বিষয় বাস্তুনারীবাদ। প্রকৃতি মানুষ দ্বারা শোষিত আর পুরুষতন্ত্র দ্বারা শোষিত নারী। ফলে নারী ও প্রকৃতি উভয়ই শোষিতের কাতারে এসে দাঁড়ায়। নারী ও প্রকৃতিকে শোষণের ক্ষেত্রে একইসূত্রে গেঁথে দিয়ে বাস্তুনারীবাদী তাত্ত্বিকরা Eco-feminism  তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন। আরণ্যক উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলোকে অল্পবিস্তর হলেও Eco-feminism তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। যদিও নারী শোষণের দিকটি আরণ্যক উপন্যাসে অধিক স্পষ্ট নয়, এমনকি ঔপন্যাসিকের উদ্বিষ্ট বিষয়ও ছিল ভিন্ন। শোষণের অল্পবিস্তর ঘটনার মধ্যে মঞ্চ ও মেলা দোকানির মধ্যে কেনাকাটার ঘটনা উল্লেখ করার মতো। সতেরো সের সর্ষের বিনিময়ে মেলার দোকানী মঞ্চীকে বহুলাংশে ঠকায়। এই সতেরো সের সর্ষের বিনিময়ে বাজারে কয়েকখানা সাবান পাওয়া যাবে খুব সহজেই। অথচ একটি সাবান, কাঁকই, মাথার কাঁটা, পাথরের আংটি, চীনামাটির পুতুল, এনামেলের ছোট ডিশ আর হিংলাজের মালাতে সন্তুষ্ট থাকে মঞ্চী। বন্য মেয়েদের এই শোষণের ইতিহাস প্রকৃতি শাসনের মতই সহজ ও স্বাভাবিক।

সস্তা মনে করিতে পারিলাম কই? এমন একখানা বাজে সাবানের কলিকাতার বাজারে এক আনার বেশি নয়, পাঁচ সের সর্ষের দাম নয়ালির মুখেও অন্তত সাড়ে-সাত আনা। এই সরলা বন্য মেয়েরা জিনিসপত্রের দাম জানে না, খুবই সহজ এদের ঠকানো। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ৮৮)

আরণ্যক উপন্যাসে নির্মম পশু শিকারের কাহিনি নেই। যেটুকু আছে তাতেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশুপ্রেমী মনেরই সাক্ষাৎ মেলে। রাজু পাঁড়েসহ রাতের অন্ধকারে শূকর শিকার ভণ্ডুল হয়ে যায় অবাক করা নীলগাই দেখার মধ্য দিয়ে। শিকারী সভ্যতার হিংস্রতা লেখক সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। কলকাতার রাস্তার গাড়োয়ানের চাবুক যখন মহিষের ওপর পড়ছিল সেই খেদ আর নীলগাই শিকার না করার ইচ্ছা মূলত অনুভূতিপ্রবণ চিন্তারই ফসল। সুরতিয়াদের পাখি-ধরার বর্ণনা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। দুটি পোষা শিক্ষিত গুড়গুড়ি পাখির ডাকে ফাঁদে এসে পড়ে নতুন পাখি। সুরতিয়াদের ফাঁদে পড়ে পাখি ঝট্পট্ করতে থাকে। গুড়গুড়ি দু’পয়সা আর ডাহুক সাত পয়সায় রতনগঞ্জের হাটে বিক্রি করে এরা। সত্যচরণ গুড়গুড়ি পাখি কিনে নিলে ঔপন্যাসিক পাখির পরবর্তী দশা বর্ণনা না করলেও এটা স্পষ্ট হয় যে সত্যচরণ পাখিটিকে শূন্যে মুক্ত করে দিয়েছে।

উপন্যাসের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে এসে আমরা লবটুলিয়ার জঙ্গলকে বস্তিরূপে আবিস্কার করি। মানুষের বসবাসের গৃহব্যবস্থার ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি, বৃক্ষাদি, জলাশয়, খোলাপ্রান্তর না থাকে তবে তা প্রাণহীন হয়ে ওঠে। এখানে লবটুলিয়া তেমন এক বস্তিকে রূপান্তরিত হয়েছে। সত্যচরণের শঙ্কা নিষ্ঠুরভাবে পরিপূর্ণতার পেয়েছে। এতসব নির্মমতার মধ্যেও সত্যচরণ সরস্বতী কুণ্ডী বাঁচিয়ে রেখেছিল। তার মনে হয়েছে প্রকৃতি যেমন নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে দেয় তেমিন Eco-friendly-man যুগলপ্রসাদ প্রকৃতিকেও দিয়েছে নিঃস্বার্থভাবে। শুধু উন্নতি নয় বরং সৌন্দর্য মুগ্ধতা যে আমাদের বসবাসের পৃথিবীকে কতখানি স্নিগ্ধ করে তোলে, জীবনময় করে তোলে তার চাক্ষুষ প্রমাণ যুগলপ্রসাদ।

যুগলপ্রসাদ মরিয়া যাইবে, কিন্তু সরস্বতী হ্রদের জলে আজ হইকে শতবর্ষ পরেও হেমন্তে ফুটন্ত স্পাইডার-লিলি বাতাসে সুগন্ধ ছড়াইবে, কিংবা কোন-না-কোন বনঝোপে বন্য হংসলতার হংসাকৃতি নীলফুল দুলিবে, যুগলপ্রসাদই যে সেগুলি নাঢ়া বইহারের জঙ্গলে আমদানি করিয়াছিল একদিন- একথা না-ই বা কেহ বলিল! (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ১৪৯)

উপন্যাসের শেষাংশে গিয়ে দেখা যায় অনাগত বিপন্ন ভবিষ্যৎ ও নিভৃত অরণ্যের জন্য হাহাকার। যান্ত্রিক পৃথিবীর পরিবেশ সংকটের কথা ভেবে যেনো উৎকণ্ঠিত হচ্ছেন লেখক। তখনও পৃথিবীর সবুজায়ন, উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক হতশ্রী অবস্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করেননি কোনো বিজ্ঞানী।

এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে নাÑশুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেই সব অনাগত দিনের মানুষদের জন্য এ বন অক্ষুণ্ণ থাকুক। (বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খণ্ড ১৪০৩ : ১৪৯)

আরণ্যক উপন্যাসটি বন ধ্বংসের করুণ ইতিহাসকে বহন করে। এটি মানব সভ্যতা ও ভৌতপরিবেশের মুখোমুখি অবস্থান চিহ্নিত করে এবং এতে ভৌত পরিবেশ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। আধুনিক প্রগতির এক মর্মান্তিক করুণ গাথা এই আরণ্যক। ধ্বংসন্মুখ মানুষ স্বার্থপরের মতো পৃথিবীতে আপনিই আপনার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার মধ্য দিয়ে সকল প্রাণিকুলের বিনষ্টির বৈধতা নিয়েছে। কট্টর মানবকেন্দ্রিকতাবাদ তাই দিন দিন পৃথিবীর পরিবেশকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে। সত্যচরণ হতদরিদ্র মানুষগুলোকে ভালোবেসেছে আবার ভালোবেসেছে বনভূমি। সৌন্দর্য ও উন্নতির এই উভয়কূল রক্ষা করতে গিয়ে বন উজাড় ও বন সংরক্ষণের উভয় সংকটে পড়েছে সত্যচরণ। ফলে মানুষের উন্নতির সঙ্গে আনন্দ, আনন্দ-রসের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্কসূত্রের হাত ধরে আরণ্যক উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়ে যাই বনভূমি সংরক্ষণের টেকসই ব্যবস্থা।

বনধ্বংসের করুণ চিত্রটি ধরা পড়ে সত্যচরণের বিদায় মুহূর্তে। বিদায় বেলায় রাজু পাঁড়ে, গনোরি, যুগলপ্রসাদ, আস্রফি টিন্ডেল সকলেই পাল্কি ঘিরে থাকে। মটুকনাথ সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করে। কেঁদে আকূল হয় কুন্তা। সুরতিয়া ও ছনিয়া বিশ্বাস করতে পারে না সত্যচরণ চলে যাচ্ছে। নাঢ়া বইহারের জঙ্গল ততদিনে মানুষের কলহাস্যে পরিপূর্ণ। চারিদিকে ফসলের ক্ষেত, গবাদি পশুতে ভরে গেছে ঘরবাড়ি। ঘনবনে আজ মানুষের সমারহ। বস্তিতে ভরে উঠেছে একসময়কার নিবিড় সবুজ বন।

শেষ পর্যন্ত বনহত্যার মধ্যদিয়ে সত্যচরণের ট্র্যাজিক পরিণতি উপন্যাসকে বেদনাবিধূর করে তুলেছে। সত্যচরণ দূর থেকে মহালিখারূপ ও মোহনপুরা বনের উদ্দেশ্যে নমস্কার করেছে। অরণ্যের সবুজ বৃক্ষাদিকে আদিম দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। সত্যচরণের এই ভাবনা মূলত পরিবেশ বিনষ্টের পাপবোধ থেকেই উৎসারিত। সত্যচরণ বাধ্য হয়েছে বনধ্বংস করতে অথচ সত্যচরণ বনভূমিকে রক্ষা করতেই চেয়েছিল। আধুনিক সময়ে আমরা এমন চিন্তা না করেই বন ও বৃক্ষাদি ধ্বংস করে চলছি। বৃক্ষ কর্তনের পাশাপাশি আমরা প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণও করি না। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনভূমি থেকে শুরু করে বসতবাড়ির ক্ষুদ্রজঙ্গলও আমাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আরণ্যক উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের সেই দায়বদ্ধতার কথা, সেই বৃক্ষ-বন্দনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসটিতে পরিবেশ ভাবনা ও সাহিত্য-সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।


গ্রন্থপঞ্জি

কবিতা নন্দী চক্রবর্তী (২০১৭), বাংলা সাহিত্যে পরিবেশচেতনা, আশাদীপ, কলকতা

দেবলীনা মুখোপাধ্যায় (২০১২), পরিবেশ-ভাবনা ও প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ, গাঙচিল, কলকাতা

দ্বিজেন শর্মা (২০০৭), নিসর্গ, নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা (২০০৭), কুরচি তোমার লাগি, উৎস প্রকাশন, ঢাকা

ড. আলী আসগর (২০১৭), পরিবেশ ও বিজ্ঞান, বর্ণায়ন, ঢাকা

পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯২), উপন্যাস রাজনৈতিক : বিভূতিভূষণ, র‌্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা

প্রদীপ দত্ত (২০১৫), জলবায়ু বদলে যাচ্ছে পৃথিবী বিপন্ন, গাঙচিল, কলকাতা

প্রসাদরঞ্জন রায় (২০১৪), ‘প্রকৃতিপ্রেমিক বিভূতিভূষণ’, দিবারাত্রির কাব্য : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যা (সম্পাদনা : আফিফ ফুয়াদ) জুলাই-সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর-ডিসেম্বর, কলকাতা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৪০৩), বিভূতি রচনাবলি, ৫ম খ-, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা

(১৪২৪), আরণ্যক, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা

মুহম্মদ হুমায়ুন কবির (২০০৮), পরিবেশকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা

মোহিত রায় (সম্পা.) (২০১৫), পরিবেশ চর্চা : ইতিহাস ও বিবর্তন, অনুষ্টুপ, কলকাতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৪২১), রবীন্দ্র রচনাবলি, ৮ম খ-, বিশ্বভারতী সুলভ সংস্কার, কলকাতা

রুশতী সেন (সম্পা.) (২০১৪), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্ধানে, অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা

শুভেন্দু গুপ্ত (২০১৬), পরিবেশ নিয়ে ভাবতে শেখালেন যাঁরা, পত্রলেখা, কলকাতা

    (২০১২), প্রাচীন ভারতে পরিবেশ চিন্তা, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

Graham Huggan & Helen Tiffin (2015), Postcolonial Ecocriticism,  Routledge, Abingdon, Oxon

Greg Garrard (2012), Ecocriticism,  Routledge, London and New York

Rachel Carson (1962), Silent Spring, Fawcett Publications, Inc., Greenwich, Conn.

Willam Howarth (1996), `Some Principles of Ecocriticism’, The Ecocriticism Reader (Edit. Cheryll Glotfelty & Harold Fromm),  THE The University of Georgia Press, Athens and London 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //