মেল ও একটা উঁচা মাথা

আধকানি জমির ওপর দোচালা ঘর। নতুন লাগানো টিনের চাল ঝকঝক করে। আধভাঙা টিনের চালা আর শোলার বেড়ার পাকের ঘরটা বাড়ির পশ্চিম কোণার। ঘর থেকে দূরত্ব তিন চার কদম। পাকের ঘরের চালার ওপর নুয়ে আছে বাঁশের ঝাড়। পেছন দিকের সীমানায় বেড়া নেই। দুটা আম আর নতুন মাথা উঁচু করা একটা কাঁঠাল গাছ। দক্ষিণের দরজা বরাবর টানা শুয়ে আছে উঠানটা।

উঠানের শেষ সীমানায় একটা আম, একটা গাব আর একটা মেডডা গাছ। একপাশে জংলার মতো করে লাগানো কিছু লেবু, কাচা মরিচ, বেগুন গাছ। বাকি উঠান খালি। দুপুরের রোদে টনটনে হয়ে যায় মাটি। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় ফকফক করে, মনে হয় কে যেন মোম ঢেলে রখেছে। বেশির ভাগ অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাড়িতেই দু-ভিটায় ঘর। কারও কারও তিন-ভিটায়। এ বাড়িতে এক-ভিটায় একটা ঘর বলে উঠানটা জমিনের মতো বড় দেখায়। বড় উঠানে ধান মরিচ শুকাতে ভালো। করিম মিয়ার এই উঠানটায় তাই আশপাশের দু’চার বাড়ির মানুষও রোদে ধান মরিচ শুকাতে দেয়। 

ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছাড়ে হুরবানু। মুরগির খোয়ারের খিল খুলে দেয়। হুরহুর করে বের হয়ে আসে তিনটা মুরগি, দুইটা রাতা। একটা মুরগির বাচ্চা দিয়েছে সে একটু পরে মহারাণীর মতো বাচ্চা নিয়ে বের হয়। বাচ্চাগুলোকে পল দিয়ে আটকে রেখে কিছু খুদ ছেড়ে দেয় পলের ভেতর। তারপর কালি দিয়ে দাঁত মাজে কলপাড়ে ডাক্কুর ডাক্কুর আওয়াজ তুলে চাপকলটা চেপে মুখ ধোয়। কলপাড়ের বদনায় পানি ভরে। ঘরের সিঁড়ির ওপর রাখা অজুর বদনায় পানি ভরে। তারপর ঘরের পীড়ার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা শলার ঝাড়–টা হতে নিয়ে উঠানের শেষ মাথা থেকে ঝাডু– দেওয়া শুরু করে। ঝাড়ুর শনশন আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠে আসমা বেগম। কলপাড়ে রাখা ভরা বদনা নিয়ে পায়খানায় যায়।

তারপর সিঁড়ির কাছে রাখা অজুর বদনা দিয়ে অজু করে জায়নামাজে বসে। হুরবানুর ঝাড়ুর আওয়াজ তখনও চলে। দুইবেলা উঠান ঝাট দেয় হুরবানু। এমন পাটপাট করে ঝাড়ু দেয় যে একটা সুই পড়লেও দেখা যাবে। আসমা বেগম সকালে জায়নামাজে একটু বেশি সময় থাকে, দোয়া-দুরুদ পড়ে। শাশুড়ি জায়নামাজে থাকতে থাকতেই রান্না ঘরের কলশিতে নদী থেকে পানি নিয়ে আসে হুরবানু। হুরবানুর বাপের বাড়ি নদীর পাড়ে না, টানের দিকে। ওখানে নদী থেকে পানি আনার কোনো বিষয় ছিল না। নতুন নতুন হুরবানু পানি আনতে শরম পেত। তখন ননদ নাজমা কলসী ভরে আনতো; কিন্তু এখন হুরবানুই আনে। ননদ এখন পড়াশোনা করে। ঘরের কাজ করলে ননদের পড়ার ক্ষতি হয়। নদীর পানি আনতেই হয় কারণকলের পানিতে রান্না করা যায় না। তরকারি কালো হয়ে যায়। পানি আনা হলে চুলায় আগুন দেয়। ভাত বসায়। তরকারি রাধে।

এর মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পরী। আড়াই বছরের পরী এখনো কোনে কোনো রাতে বিছানায় পেশাব করে দেয়। হুজুরের কাছ থেকে পানি পড়া খাইয়েছে, গলায় বেঁধে রেখেছে একটা তাবিজ তাতেও কোনো কাজ হয়নি। পরী উঠলে ওরে হাগান মুতান লাগে। মুখ ধোয়াইয়্যা কিছু হাতে দিয়ে বসিয়ে রাখতে হয়। নাইলে আবার ভ্যানভ্যান করে, হাঁটাহাঁটি করে উঠানের দিকে যায়। মুতের খেতা থাকলে ধুয়ে রোদে মেলে দিতে হয়। খোদার ত্রিশদিন সকালবেলা হুরবানুর এই রুটিন। যেদিন রাতে শরীফ মিয়া বাড়িতে থাকে। সেদিন সকালে উঠে নাপাক শরীর ধুয়ে আসতে হয় মেঘনা থেকে। তারপর উঠান ঝাড়ু দিতে হয়। আসমা বেগম বলে দিয়েছে- ‘মাইয়্যা মানুষের নাপাক শরীরের পাড়া বাইর ঘরের উঠানে পরলে কোনে কামে শাইধ হয় না’ তাই কড়া নির্দেশ আগে নাপাক শরীর পাক করতে হবে, তারপর অন্য কাজ। 

কাজের কথা বলতে হয় না হুরবানুকে। সে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করে। এখন ঘরে ঘরেই মহিলারা অভাবী মেয়েমানুষদের দিয়ে ফুট ফরমায়েস করায়। নদী থেকে পানি আনার লোক রাখে উঠান ঝাড়– দেয়ায়। হুরবানুর লোক লাগে না। বাড়ির উঠানের একটা শুকনা পাতাও কেউ নিতে পারে না। শুকনা পাতা জমিয়ে চুলায় দেয়, লাকড়ি বাঁচায়। কাজ না থাকলে ওর মন খারাপ করে। পুরা সংসারের কাজ, রান্নার কাজ করে সময় পেলে আবার সেলাই করে। ভালো নকশী তুলে পাখা বানাতে পারে সে। তার হাতের পাখা ননদ- ননাসরা নিয়ে যায় শ্বশুর বাড়ি।

স্কুুলে কিছু পড়াশোনা করেছে সে। রুমালে ফুল তুলে ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভোলে না মোরে’, ‘সংসার সুখের হয় রমনীন গুণে’ এই সব দামী কথা সুন্দর করে সেলাই করে ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছে। করিম মিয়ার এই এতো বড় সুন্দর উঠানে আগে নিজের ফসল শুকানোর মতো অবস্থা ছিল না। জমি কিছু আছে কিন্তু তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছে জমি কট দিয়ে। ছেলে শরীফের মাথায় গোবর। পড়ালেখা করতে পারেনি। মেয়েদের বিয়ের পর অভাবে উপায় না দেখে শরীফকে লাগিয়েছিল মানুষের জমিতে গতর খাটাতে। অভাব সংসারটাকে চিবিয়ে খাচ্ছিল। অভাবী মানুষকে পরামর্শ দেবার মানুষের অভাব নেই।

গ্রামের পাঁচজনের পরামর্শে শেষ জমিটা কট দিয়ে শরীফকে সৌদি আরব পাঠায় করিম। কিন্তু কপালে তখনও ফের ছিল অনেক। দালালের হাতে পড়ে ভালো আকামা পায়নি। অবৈধ হিসেবে বিদেশ থেকে ছয় মাস পর বাড়িতে ফিরে এসেছে শূন্য হাতে। ফিরে এসে ঘরে বসা দিলে আবার সবার পরামর্শে ছেলেকে বিয়ে করায় করিম। হুরবানুর সঙ্গে সমন্ধটা এনেছিল পুবপাড়ার হানিফ। বলেছিল- ‘মাইয়্যার বাড়ির অবস্থা ভালা। ভাগন্তী মাইয়্যা। ঘরে লইয়া আও। দেখবা সংসারের চেহারা ফিরব।’ সংসারের চেহারা পয়মন্ত হুরবানুর জন্য ফিরেছে কতটুকু তা বোঝে না করিম। তবে হুরবানুর বাপের কাছ থেকে যৌতুকের টাকা দিয়েই গ্রামের সড়কের মুখে তার ছোট্ট পান বিড়ি সিগারেট দোকান। হুরবানুর এক ভাই বিদেশে থাকে। ওই ভাইয়ের পাঠানো টাকা দিয়েই শরীফ আর ছোট ছেলে সাজাহান মেকানিকের কাজ শিখেছে। 

হুরবানুর রঙ কালো, লম্বা, ঢেঙ্গা শরীর। বড় কপাল। ছোট ছোট দুটো চোখ। চোখের ওপরের ভ্রুর অংশটা একটু ফেলা ফোলা। নাকটা সামান্য বোচার দিকে। লম্বা চেহারায় বেক্কলভাব সাটা। না চেহারা, না রঙ, কোনোটাই সুবিধার না। করিম মিয়া মেয়ে দেখে কিছুদিন গুম হয়ে ছিল। কি করবে ভেবে পায় না, তখন হানিফ আবার বলেছে -‘মাইয়্যার সব বালা শুধু মাইয়্যা কালা। এইড্যা কোনো ব্যাপার না। খুব কামের মইয়্যা। ঘরে আইন্যা দেহো সব কাম কইর‌্যা কেমুন গুছাইয়া রাহে’ হানিফ মিয়া সমন্ধ এনেছে এসব কথা বলে মন ভেজাবেই। তবে আশপাশের দু’একজন মুরুব্বিও বলে ’মাইয়্যা কালা এটা ঠিক কিন্তু তোমার পুতের সুরত কি? আর বেকার পোলা, হুদা হাত, ঘরের চাল ভাঙা এমুন জায়গায় হাইদ্দা তোমারে কেডা মাইয়্যা দিব।’

কথাটা পুরাই খাঁটি। কারণ শরীফও একটা বদসুরত ছেলে। মাথাটা শরীরের তুলনায় বেঢপ বড়। কপালের হাড় উঁচু তাই চোখ দুটি একবারে কোটরের ভেতর। পুরু কালো ঠোট, থুতনিতা নিচের দিকে সরু হয়ে ঝুলানো। গাট্টাগোট্টা খাটো দেহ, গায়ের রঙ মাশাল্লাহ্ কালো। 

এসব চিন্তা করে সমন্ধটা করিম মিয়াকে ভাবায় তারপরও বলে- ‘মেয়ের রঙ কালা ঠিক আছে; কিন্তু মাইয়্যার মাথা যে পোলার মাথা ছাড়াইয়্যা দেহা যাইব।’ শরীফ বেটে খাটো, বউয়ের মাথা শরীফের মাথার ওপর দিয়ে দেখা যাবে কথাটা ঠিক কিন্তু এটাও হানিফ মিয়া উড়িয়ে দেয়- এইডাই তো বালা হইছে। বাল বাচ্চারা লম্ফা হইব। বউটা বানিয়ে রেখেছে বেহেস্ত খানা। এমন পরিপাটি এমন পরিষ্কার গ্রামের কোন বাড়িটা? 

আজও ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গেই বিছানা ছাড়ে হুরবানু। সব সেরে উঠান ঝাট দেওয়া শুরু করে। উঠান ঝাটের শব্দ শুনে প্রতিদিনের মতোই আসমা ওঠে; কিন্তু আজ আর অজুর বদনার দিকে না যেয়ে উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে- আজগা আর উঠান ঝাড়ু দেওনের কাম কি? 

হুরবানু কোনো উত্তর করে না। আসমা কিছুক্ষণ কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বউয়ের উঠান ঝাট দেওয়া দেখে তারপর ধীরে ধীরে পিছদোরের দিকে হাঁটা দেয়। উঠান ঝাট সেরে নিয়মমাফিক সব কাজ শেষ করে পিছদোরের সিঁড়িতে মাথায় আধা ঘোমটা টেনে বাঁশঝাড়ের দিকে মুখ করে গলা একটু উঁচু করে ওপরের দিকে চেয়ে বসে থাকে হুরবানু। শ্বশুর মিয়া সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে দোকানে যায়। গরম ভাত শ্বশুরের পাতে প্রতিদিন হুরবানুই বেড়ে দেয়, ভাত বেড়ে দেওয়ার সংকেত হলো নামাজ সেরে পিছদোরে এসে শ্বশুরের গলা খাকারি দেওয়া।

আজ শ্বশুরের কোনো গলা খাকারি শুনে না হুরবানু। দরজার সিঁড়িতে বসে মিটসেফ থেকে শাশড়ির ভাতের পাতিল নামানোর শব্দ শুনে। ভাত বাড়ার শব্দ শুনে। শ^শুর পাটিতে বসে খাচ্ছেন সেটাও সে পেছন ফিরেই বুঝতে পারে। কোনোরকম কথা আর শব্দ ছাড়াই ভাত খাওয়া শেষ করে সম্মুখ দরজা দিয়ে শ্বশুরের বাইরে যাবার শব্দও পায় সে। বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে। হুরবানু এমনিতেই কথা বলে খুব কম। একবারে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া তার কোনো রা নেই। কেউ কিছু জানতে চাইলে বলে।

সারাদিন যন্ত্রের মতো কাজ করে। তবে মুখ ভার করে রাখে না। ভালোমন্দ কেউ বললে বা কাজের কোনো কথা বললে সেটা করে দিয়ে আসে। কোনো চাহিদা তার আছে কি না তাও বোঝা যায় না। শখ করে কোনো কিছু কেনা বা চাওয়া কোনোটাই তার নেই। যা এনে দেয় তাই পরে। সবার খাওয়া হলে যা থাকে তাই দিয়ে ভাত খায়। বাপের বাড়ি যাবারও বায়না নেই। বাপ মাঝে সাঝে বেয়াই বাড়ি এটা সেটা নিয়ে আসে। গাছের ফলফাকারি, গাইয়ের দুধ, পিঠা, ক্ষেতের মাসকলাই, সরিষা, তিল, কাউনের চাল এইসব। বাপেই বায়না ধরে বছরে দুবার নাইওর নিয়ে যায়। আসমা বেগম চায় না বউ বেশি বাপের বাড়ি যাক। বউ ঘরে বাইরের সব কাজ করে। শরীরে আরাম আর অলসতা এসে গেছে আসমার। হাতে এখন আর কাজ উঠাতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বউ বাপের বাড়ি গেলে সংসারটা তো চালাতে হয়। তবে বউয়ের বাপ নিতে আসলে না করে না আসমা। বউয়ের সঙ্গে আসমার সম্পর্ক পুকুরের পানির মতো স্থির। আদরের কোনো উচ্ছাস নেই, আবার অপছন্দের কোনো ঝগড়া নেই।

আর ঝগড়া হবার কোনো সুযোগই তো নেই। কোনো কিছু বলবার আগেই বউ সব কাজ করে রাখে। মুখ দিয়ে কোনো কথা নেই। আসমা নিজেও মুখ চালানো মানুষ নয়। বউয়ের কাজে বাগড়াও দেয় না সে। তবে বউ তেমন কোনো কথা বলে না বলে আসমারও বউয়ের সঙ্গে কথা খুব সীমিত। তো বোবা থামের সঙ্গে কি আর ঝগড়া করা যায়! আর। বউকে কি আসমা পছন্দ করে? কি জানি বুঝে না আসমা, বউয়ের সঙ্গে কি তার মনের সম্পর্ক হয়েছে? ওই ঢেঙ্গা শরীর আর কালা বেক্কল চেহারা কেমন জানি মনের ভেতর মায়া লাগায় না। কেমন বেঢপ লাগে মনে হয়, যেন মানুডা এই বাড়ির না। এক গাছের ছাল আরেক গাছে আইন্যা লাগাইছে। সবার মাথার উপর দিয়ে একটা কলাগাছ বাড়ির ভেতর নড়ে চড়ে। আল্লায় বানাইছে মাইনশে কি করবো!

কিন্তু কাম কাইজ দেখলে ভেতরটা ঠান্ডা হইয়া যায়। ননদ-ননাসরা আসলে সারাদিন নিঃশব্দে কাম করে। আসমা বেগমের সব কথা নীরবে হুনে। কোনো কথার রা নাই, কোনো কামে না নাই। কোনো মানুষের লগে কোনো কথা লাগানো নাই। হাতের কাজের নকশী চোখটা জুড়াইয়া দেয়। সারাদিন এমুন খাটে যে মাঝে মইধ্যে খুব মায়া লাগে। বউ কথা কম কয় এইড্যা নিয়া আসমা বেগমের আফসোস নাই মাইয়্যা মানুষের এতো মুখ লারনের কি কাম! এইসব ভাবলে বউরে আবার অপছন্দ হয় কেমনে! তবে বউ আর দুই চাইরডা কথা কইলে ভালো হত। বউ শাশুড়ি মনের দুই একটা কথা বলে হালকা হওয়া যেত। 

আসমার সংসার তো আর আগের মতো নাই। ছেলে শরীফ মেকানিকের কাম শিখে ঢাকায় তিন বছর ধরে কোন গাড়ির দোকানে কাজ করে বেতন ভালোই পায়, আবার বখশিসও পায়। ছোট ছেলেটাও একই কাজ করে, তবে দুজন দু’জায়গায়। দুইভাই একসঙ্গেই কাজ শিখেছিল। দুজনে পয়সা আনে। করিম মিয়া সড়কের মুখে দোকান চালায় ওখানেও লাভ হয় মন্দ না। গেল বছরের আগের বছর একটা জমির কট ছুটিয়েছে। গত বছর আরেকটার। এখন ঘরে কিছু ফসল ওঠে। দোচালা ঘরটা ভাইঙ্গা চাইরচালা করার ইচ্ছা বাপ-পুতের। আরো ভালো হইলে শরীফের আবার বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা। এখন আর কাজ ছাড়া থাকতে হবে না। মেকানিকের কাজ জানে। সব মিলিয়ে সংসারটা এখন উজানের দিকে পাল তুলেছে। সংসার যেন তরতর করে চলছে।

শরীফ মিয়ার হাত বড়। হাতে টাকা থাকলে মনটাও ফুরফুরা থাকে। গেছে মাসেই মার জন্য নতুন একটা শাড়ি এনেছে। মেয়ের জন্য হাত ভরা খেলনা এনেছে। ঢাকার মজার মজার খাওনের জিনিস প্রায়ই হাতে করে আনে। সব ঠিক আছে কিন্তু ছেলের এখন মনে শান্তি নেই। সংসারের গতি তো সেই ফিরলো। অথচ তার বিয়ে করতে হলো কালা মাইয়্যা। এইটা বুকের ভেতর আফসোসের আগুন জ্বেলে রাখে। বুকের ভেতরটা ইটের ভাটার মতো জ¦লতে থাকে। আসমার আফসোস আর পুড়ানিও কম হয় না। মাইনসের ঘরের বউগুলো কি সুন্দর! কি সুন্দর তাদের গরন গাড়ন। কত সুন্দর লাগে মনে হয় বাড়িটা ভইরা রইছে। তার তার কপালে কই থেকে এই একটা উটা মাইয়্যা আল্লায় লেইখ্যা দিলো। ভিতরে ভিতরে করিম মিয়ারও অশান্তি কম লাগে না। অবস্থা ভালোর দিকে দেইখ্যা এখন গ্রামের নানা কিছুতে তার ডাক পড়ে। বিভিন্ন কমিটিতে কেউ কেউ তার নামও প্রস্তাব করে। দশপাঁচজন ভালো লোকের সঙ্গে তার এখন উঠা-বসা হয়। গ্রামের মুরব্বিরা তার দোকানে বইস্যা পান সিগারেট খায়। কিন্তু এমন একটা কালা ছেলের বউ ঘরে থাকুনে কি সে বুক উচা কইর‌্যা দাড়াইডা কথা কইতে পারে! না পারে না। সবাই জানে কালা বউ কেন সে আনছে। ভেতরটা খচখচ করে। 

ছেলেও মাঝে মাঝেই বলে- ‘আমার কালা বউ বালা লাগে না।’ 

করিম মিয়া আর আসমা বেগম তেমন কিছু বলে না। মেয়ের বাড়ির অবস্থা ভালো। বউয়ের বাপের থেকে সে টাকা নিয়েছে। 

আসমা একটু নাকি সুরে কয়- কি করবি আল্লায় লেখছে।

আল্লায় লেখছে না তোমরা আনসো। 

এই কথার জবাব দেয় না করিম। কালা মাইয়্যা আনছে কি আর সাধে! কোন অকূলে পইর‌্যা এই মাইয়্যা আনছে আর কোন কারণে আজ সংসারে অবস্থা ফিরা আইছে এইডা আর নতুন কইর‌্যা কি কইবো! গাছের পাতারাও জানে হেই কিচ্ছা !

আসমাও আর কিছু বলে না ছেলেরা চোখ রাঙানিও দেয় না আবার উস্কানিও দেয় না। ‘কালা বউ আর বালা লাগে না’ এ কথা উঠান ছাড়িয়ে দু চার পাঁচ কান হতে হতে এখন গ্রামের সবাই জানে। শরীফ মিয়া এই বউ লইয়্যা আর খাইতে চায় না। বউ তালাক দিতে চায়। এটাও এখন কথায় কথায় ঘুরে ফিরে। গত তিন মাস ধরে শরীফ মিয়া বেশি উত্থাল পাতাল শুরু করেছে। বউয়ের সঙ্গে কথা আগেও খুব একটা বলতো না এখন পুরাই বন্ধ, এক বিছানায় এখন শোয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কথা বাতাসের আগেই ছড়িয়ে যায়। গ্রামের বাতাস খবর নিয়ে যায় বউয়ের বাপের বাড়ির গ্রামে। বউয়ের বাড়ি থেকে বাপ আসে বড় ভাই আসে। কিন্তু হুরবানুর মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয় না। দুপক্ষের লোকজনও কথা বলে। আসমা বেগম আর করিম মিয়ার সঙ্গে কথা বলে তারা বলে - আমরা তো পুতেরে বুঝাই। বালেগ পোলা আমরার কথা কি শুনে!

বউ তালাক দিমু, বউ তালাক দিমু বললেই তো আর বউ তালাক দিয়ে দেয়া যায় না। গ্রামে পাচজন আছে, সমাজ আছে, সমাজে আবার পাঁচজন আছে। দু পক্ষের আত্মীয়-স্বজন আছে সব মিলিয়ে সবার তো একটা কথা আছে। সেই কথারই দিন আজ। আজ সালিশ বসবে। শরীফ মিয়া আর বউ নিয়ে খেতে চায় না। বউ তালাক দিবে। এখন কেন দিব, কেমনে দিব এ নিয়েই আজ ‘মেল’ বসবে। বিকালে ‘মেল’ বসবে। ‘মেলে’র সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে হুরবানুর এই বাড়িতে থাকা না থাকা।

আজকের দিনেও বউ কাম করবে বিষয়টা বুকের ভেতরে কেমন একটু ধাক্কা দেয়। বউটার জন্য বুকের ভিতরটা কেমন একটু কাঁপেও আসমার- এই যৌবন বয়েস, রুপ নাই। কেডা নিব এই কালা মাইয়্যা। বাপের বাড়িতে গিয়ে বোঝা হইতে হইবো। আর যদি কেউ নেয়ও দোজবর ছাড়া কি আর বিয়া বইতে পারবো। কোলের মাইড্যা রাইখ্যা যাইতে হইবো। মাইয়্যা মানুর জীবনডাই জানি কেমুন, বেবিচাইর‌্যা বানাইছে আল্লায়। বউটার বুকের ভেতর কেমন হুহু করতাছে কে জানে। কান পেতে শুনতে ইচ্ছা হয় আসমার। কিন্তু বউয়ের মুখে কোনো কথা নেই। এই যে আজ তিন মাস ধরে এতো কথা এতো উত্থাল পাথাল বউ একদিন একটা কথাও বলে নাই। আসমা বার দুই সন্মুখদোর আর পিছদোর করে। তারপর ভাবে- এইড্যা কি মানু না অন্য কিছু। এতে কিছুর মইধ্যেও যন্ত্রের লাহান কাম কইরা যাইতাছে। আর হেই যে পিছদোরে বসা দিছে অহনও বইয়াই আছে। ভিতরটা মনে লয় চৈইত মাসের রোদের লাহান খা খা করতাছে। মুহে নি তার কোনো চিন আছে! 

পরীরে ভাত মেখে খাওয়ায় হুরবানু। তারপর রান্না ঘর গুছিয়ে শ^শুরের খেয়ে যাওয়া এটো বাসন পেয়ালা ধুয়ে আবার সিঁড়িতে বসে থাকে। বেলা চরা হচ্ছে। রান্না বসাতে হবে। কি রান্না করতে হবে তা প্রতিদিন আসমা বেগম ঠিক করে দেয় । আসমা বেগমের নির্দেশ মতো রান্না করে হুরবানু। বিকেলে শরীফ মিয়া, সজীব মিয়া দু’জনেই আসবে। দুই ননাসেরও আসার কথা। হুরবানুদের বাড়ি থেকে হুরবানুর বাপ আর ভাই আসবে। রান্নার আয়োজন তাই অন্যদিনের তুলনায় বেশি।

বিকেলের আগে আগেই শরীফ মিয়া ঢাকা থেকে আসে। শরীফ মিয়ার পর আসে সজীব মিয়া। বাড়িতে এসেই মেঘনা থেকে গোছল সেরে আসে শরীফ মিয়া। আসমা বেগম ভাত বেড়ে দেয়। দুই ভাই পাশাপাশি বসে ভাত খায়। বিকেলে লোক জমায়েত হবে। তাই বিকেল হবার আগেই উঠানটা আবার ঝাট দেয়া শুরু করেছে হুরবানু। আসমা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বলে- আবার উঠান ঝাড়– দিতাছো কেরে? খাইয়া এনা লাইবা দুইডা। 

হুরবানু উঠান ঝাড়ু দিয়ে পরীকে দেখে। মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটা হুরবানুর মতোই শান্ত হয়েছে। সারাদিন তেমন কোনো কান্নাকাটি করে না। শুধু সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঝেসাঝে ঘ্যানঘ্যান করে। দুপুরে খেয়ে ভালো ঘুম দেয়, উঠে সন্ধ্যা নাগাদ। মেঘনা থেকে যখন হুরবানু গোছল সেরে আসে তখন সূর্য হেলে গেছে হুরবানুর বাপ বসে আছে সামনের ঘরে। পিচদোরে বসে ভাত খায় হুরবানু। ভেজা চুল গড়িয়ে পানি পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে আসমা বলে- এমুন মাদানে চুলডি ভিজাইল্যা ক্যান? 

এই কথা বলে আসমা বেগম নিজে নিজেই অংক করে। বউ এই বাড়িতে থাকবো কি থাকবো না আজ এই মেলে ঠিক হইবো। হেই বউয়ের লাইগ্যা মায়া দেখাইয়্যা কি লাভ!

উঠানে দু’তিনটা পাটি পাতা হয়ে গেছে। লোকজন কিছু কিছু আসা শুরু করেছে। গণ্যমান্যদের জন্য বেশ কিছু চেয়ারও পাতা আছে। হুরবানুর দুই ননাস এসছে। ওদের কাছাকাছি গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। তারা কি রাতে থাকবে নাকি চলে যাবে রাতের জন্য কি কিছু রাধতে হবে কি না সে বিয়য়ে কোনো নির্দেশনা পায়নি হুরবানু সে কি এই বাড়িতে থাকবে নাকি তার বাপের সঙ্গে চলে যাবে সে বিষয়েও কোনো নিদের্শনা নাই। ভাত খয়ে পিছদোরের সিঁড়িতেই আবার বসে থাকে হুরবানু। ননাস, শাশুড়ি আশপাশের আরও পাঁচ ছয়জন মহিলাও এসে পিচদোরে বসে। কেউ হুরবানুর সঙ্গে কোনো কথা বলে না। এখান থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে মেলের মানুষ দেখা যায়। কিন্তু মেলের লোকজন তাদের দেখতে পাবে না। সবাই চলে এসেছে। মেম্বার, চেয়ারম্যান, মসজিদের হুজুরও এসেছে। তারা চেয়ারে বসেছে। পাটিতে বসেছে সাধারণ মানুষ। শরীফ মিয়া দাঁড়িয়ে আছে পাশে।

খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে চেয়ারম্যান বলে- হ্যাঁ সবুর মেম্বার তুমি শুরু করে। 

সবুর মেম্বারও ছোট একটা কাশ দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে- আপনার তো হুনছেন করিম মিয়ার ছেলে শরীফ মিয়া তার বউ লইয়্যা আর খাইতে চায় না। কি হুনছেন না?

জনতা বলে- হ হুনছি, হুনছি। 

এইহানে কি বউয়ের বাড়ির কেউ আছেন? 

করিম মিয়া উত্তর দেয়- হ আছে। বউয়ের বাপ আছে, ভাই আছে। 

তাইলে তো সব ঠিকই আছে। হুনেন আপনেরা একটা সংসার ভাইঙ্গা যাক এইডা আমরা কেউ চাই না। তাই বউ লইয়্যা খাইতে চাই না কইলেই তো হইল না। এদিকে আইও শরীফ মিয়া কি তুমি কি বউ লইয়্যা খাইতে চাও না? 

না, চাই না। 

কেন চাও না ? কেন বউয়ের কি স্বভাব চরিত্র খারাপ? 

না, হেউডা না।

বউ কি সংসারের কাম পারে না?

না, হেইডা না। 

বউ কি তোমার বাপ-মারে মানে না?

না, হেইডা না।

তোমার লগে বেয়াদদপি করে? 

না, হেইডা না।

বউ কি অ্যারা? কাম কাইজ পারে না?

না, হেইডা না।

তাইলে বউ লইয়্যা খাইবা না ক্যা? 

তাইলে বেঢক। তাইলে আমার মনে ধরে না। 

চারপাশে একটা হালকা গুঞ্জন ওঠে- মাইয়্যাডা কালা। বেডার লাহান শরীর।

চেয়ারম্যানের গলার কাশের শব্দে গুঞ্জনটা থামে। মাথা দুই দিকে ঘুরিয়ে সবার দিকে চেয়ে একটু শক্ত কণ্ঠে চেয়ারম্যান বলে- বেঢক তো বিয়া করছিলা ক্যান?

বাপ-মায়ে করাইছে। 

বাপ-মায়ে করাইছে কি জোর কইর‌্যা। তোমার মুহের কথা তহন কই আছিল? বেঢপ বড় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শরীফ। কপালের উঁচু হাড়টা আরো উঁচু দেখায়।

জনতা এবার আবার একটু গুনগুন করে- মাইয়্যা কালা তো পোলা কি? মাইয়্যা বেঢক তো পোলা কি?

কথাটা একমুখ দু’মুখ গুঞ্জরিত হতেই ধমকের সুরে চেয়ারম্যান বলে- থামেন আপনারা। পোলা মাইনসের আবার কালা সাফাই কি? পোলা আবার ডক-বেঢক কি। স্বর্ণের আংটি ব্যাকাও ভালো জানেন না আপনারা ।

জনতা সমস্বরে বলে -হ সোনার আংটি বেহাও বালা।

চমৎকার একটা কথা বলার পর তৃপ্তির হাসি নিয়ে চেয়ারম্যান এবার বলে- বিয়া করনের সময় কোন লেনদেন করছিলা ?

মেয়ের বাপের দিকে ফিরে বলে- কিভাই কোন লেনদেন আছিল?

হ, আছিল

কত?

এক লাখ নগদ দিছি। আর মেয়েরে তিন ভরি স্বর্ণার গয়না। জামাইরে আটিং আর চেন। 

কি করিম মিয় যা কইরো সব হাচা?

হ, হাচা। 

কি শরীফ মিয়া সব হাচা? 

চাচা আমি একলাখ টাহা দিয়া দিমু। গয়না লইয়্যা যাইবো। চেন আংটিও ফেরৎ দিমু। মেলের মধ্যে সবার সামনেই সব দিয়া দিমু। 

গেরামের নিয়ম তো আপনেরা জানেন। কেউ যদি বউ ফালাইয়া দেয় তাইলে যা যা নিছিল সব ফেরৎ দেওন লাগবো। শরীফ মিয়ায় তো দিতে রাজি। মেলের সামনেই দিতে রাজি। আপনেরা কি কন?

আমরা কি কমু চেয়ারম্যান সাব আপনে যা কন। 

চেয়ারম্যান এবার মেয়ের বাপের দিকে ফিরে বলে-আপনার মাইয়্যা বেডক। শরীফের মন জোগাইতে পারে নাই। এহন এইডার আর কি করন? মাইনষের মনের ওফর তো আর জোর খাডান যায় না। আপনের টাকা আপনেরে ফেরৎ দিব কইছে বেইনসাইফা কাম তো হয় নাই। আপনে কি কন?

হের তো একটা মাইয়্যা আছে। ছুইকাডারও তো একটা ভবিষ্যত আছে। 

শরীফ মিয়া তোমার মাইয়ার বয়স কত?

মাইয়্যার বয়স আড়াই বছর। আমার মাইয়্যা আমি দেহুম। 

মাইয়্যা যদি শরীফে দেহে তাইলো আপনার আর কোনো ঝামেলা থাকে না। কি কন?

আমি আর কি কমু একটাই মাইয়্যা আমার। লক্ষীর লাহান মাইয়্যা আমার। আমার মাইয়্যার খাওনের অবাব হইবো না। কিন্তু মাইয়্যার মনডার কতা তো আপনেরা ভাবলেন না। 

চেয়ারম্যান এবার হুজুরের দিকে ফিরে বলে- আমরা তো চাই হেরা সংসার করুক। এহন স্বামীর মনে স্ত্রীরে না ধরলে কি করন? আপনে কিছু কন। 

হুজুর দুই হাতের তালু এক সঙ্গে ঘষা দিয়ে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলে- বিয়া শাদী ইইলো মিয়া আর বিবি মনের মিল আর মহব্বতের বিষয়। স্বামী-স্ত্রী দুইজনের প্রয়োজনের লাইগ্যা আল্লাহ দুইজনকে সৃষ্টি করেছেন। স্বামী-স্ত্রীর মিলন হইলো দুনিয়াতে বেহেস্তেতের সুখের একটা নজীর। এখন এইখানে যদি মন না বসে যদি এইখানে মনের সুখ না থাকে তাহলে ওইডা দোজখ হইয়া যায়। ইসলামে কারণবশত তালাক জায়েজ আছে। আল্লাহ জুলুম পছন্দ করেন না। করো মনের ওফর জুলুমের কোনো বিধান নাই। এখন যদি স্ত্রীর প্রতি শরীফ মিয়ার মন কোনোভাবেই না বসে তাইলে ধর্মমতে তালাক দিতে পারবো। তবে তারে কাবিনের টাহা দেওন লাগবো।

জনতা এবার মৃদূ গুঞ্জন করে- হ কাবিনের টেহাও ফেরৎ দেওন লাগবো।

চেয়ারম্যান আবার গলা খাকারি দিয়ে বলে- কাবিন কত দিছিলা।

করিম মিয়া বলে- কাবিন আছিল একলাখ টাকা উসুল দিছি পচাঁত্তর হাজার। 

তাইলে আর কি নগদে পচিঁশ দিবা। 

শরীফ মিয়া মাথা নিচু করেই বলে- হ দিমু। 

চেয়ারম্যান এবার আবার দুইদিকে মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলে- সবুর মেম্বর সবার কথাই হুনলাম। শরীফের কথা হুনলাম। এইবার বউডার কথা তো একটু হুনোন লাগে। 

করিম মিয়া বলে- বউয়ের কথা আবার কি হুনবেন। এতগুলা মুরব্বির উফরে তাইর আবার কি কথা?

না, এহন আর আগের দিন নাই। মাইয়্যালোকের কথারও দাম আছে এহন। ডাক দাও তোমার বউরে।

করিম মিয়া পিচদোরের সামনে গিয়ে আসমা বেগমকে ডেকে বলে- কই বউরে মেলে নিয় আইও। 

আসমা বেগমের পিছনে পিছনে আসে হুরবানু। ওর লম্বা ডেঙ্গা শরীর আর মাথাটা আসমা বেগমের মাথার আধ হাত ওপর দিয়ে জেগে থাকে।

মেলের কাছে সে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে হুরবানু। 

চেয়ারম্যান গলাটা একটু নরম করে বলে- তোমরে নিয়া আর ভাত খাইতে চায় না শরীফ। তোমার কোনো বদনাম করে নাই। মাইয়্যাও ওরাই দেখবো, তোমার বাপের থেইক্যা যেই টেহা নিছে হেইডা ফেরৎ দিয়া দিবো। উসুল বাদে কাবিনের টেহাও দিবো, গয়নাও তোমারডা তোমারেই দিয়া দিবো। এখন তোমার কি মত?

হুরবানু দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা বলে না। শুনশান নীরবতা। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান আবার বলে- তোমরার টেহা তোমরারে দিয়া দিব। ওরা মাইয়্যা ও দেখবো এইহানে ভাবনের কি আছে। এইহানে তো ভাবনের কিছু নাই।

এক উঠান মানুষের দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান আবার বলে- এই হানে আর কওনের কি আছে কি কন আপনেরা। 

জনতা সমস্বরে রোল তুলে- না কওনের কিছু নাই। 

সূর্য একবারে পশিচমে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যার শেষ চাপা আলো। আবছা অন্ধকারে মাথায় ঘোমটা দেয়া হুরবানু খাড়া একটা থামের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চেহারাটা আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। শুধু কলা গাছের মতো ঢেঙ্গা শরীরের মাথাটা দেখা যায়। 

জনতা নীবর। চেয়ারম্যান সাহেব বলে- তোমরার সব জিনিস তোমরারে ফেরৎ দিয়া দিব। আর কওনের কি আছে। তাইলে আর কওনের কিছু নাই। 

নিচু করা মাথাটা একটু সোজা করে হুরবানু বলে- আমার একটা কথা কওনের আছে।

জনতা তাকায় হুরবানুর দিকে। চেয়ারম্যান মাথাটাকে ঘুরিয়ে ঘাড় কাত করে । সন্ধ্যার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দেখে এক নারীর উঁচু মাথা। সে দিকে তাকিয়ে থাকে চেয়ারম্যান দিকে তাকায়-

গাছের পাতা গুলোয় শনশন শব্দ তুলে একটা বাতাস বয়ে যায় মেলের ওপর দিয়ে। বাতাসে লেবুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বাতাস ভেদ করে হুরবানুর কন্ঠ শোনা যায়- আমারে আপনারা আবিআইত্তা বানাইয়া দেন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //