শীতের নৈশব্দ্য নেমে আসে

পৃথিবীর সব প্রান্তেরই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক ঋতুর নাম শীত। শীত প্রাণ-বৈচিত্র্যের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। শীত কেবল প্রাণী ও প্রকৃতির ওপরই প্রভাব ফেলে না; শীত মানুষের মতো প্রকৃতির চেহারা ও খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটায়। শীত বদলে দেয় সুন্দর সময়কে।

গ্রিক মিথে শীত এসেছে দেবী দেমিতার কন্যা হারানোর শোক থেকে। আমাদের এই বাঙালি সমাজেও শীত নিয়ে অনেক লোক-মিথ ও প্রবাদ-প্রবচন আছে। শীতে বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির সাজসাজ রব ও শস্য এদেশের মানুষকে উৎসবে অনুপ্রাণিত করে।

বাংলা সাহিত্যেও শীত এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিহার্যভাবে- নানা আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে। শীতের মিঠেরোদ, শীতের পাটালিগুড়ের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বাংলা কাব্যসম্ভারে। সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গে।

আমাদের এই দেশে শীত চলে আসে শিশিরের শব্দের মতো। ফোঁটায় ফোঁটায় টুপটাপ করে। অথবা একটা ক্লেদাক্ত-কুসুম, একটা পূর্ণতার ভেতর দিয়ে শীত চলে আসে আমাদের এই দেশে। পৃথিবীর পূর্ব-গোলার্ধে বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ আমাদের দেশের উপর দিয়ে চলে গেছে কর্কটক্রান্তি রেখা। যার ফলে পুরোপুরী আমরা শীতের দেখা পাই না।

তবে কখনো কখনো শীতের নখদন্তহীন তীব্র কামড় টের পাই। শীতের অধিকাংশ ধার, তীব্র ঠান্ডা পড়ে থাকে মকরকান্তিতে। প্রচন্ড শীতের তাড়া খেয়ে এদেশে ছুটে আসে শীতের অতিথি পাখিরা। আশ্রয় খোঁজে বাংলাদেশের খাল-বিল-হ্রদে। ওরা আমাদের এই ভাটি অঞ্চলের দেশে পরম আনন্দে সাঁতার কাটে- ঘুরে বেড়ায়।

সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত এইসব পাখিরাই প্রমাণ করে বাংলাদেশে তেমন শীত নেই। থাকলেও তা গা-সওয়া। বাংলাদেশে শীত আপদ নয়- অনেকটা আশীর্বাদ। শীত মানুষকে কবি করে তোলে। সাহিত্যে শীতের অবদান চির স্মরণীয়। গরিব-দুঃখীদের শীত কখনো কখনো কষ্টের হলেও তারা যোদ্ধা নয়- পরম আয়েশী।

শুয়ে-বসে, গল্প করে জীবন কাটাতে ভালোবাসে আমাদের এই ভাটি অঞ্চলের মানুষ। শীতে আমাদের এই দেশে, এই উপমহাদেশে  বিভিন্ন পিঠা বানানো, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, শীতের ফল, শীতের নানা সবজি, শীতের পোশাক অনেক কিছুই আমাদের আনন্দ দিয়ে থাকে।

শীতের সকালে আয়েশ করে রোদ বা আগুন পোহানো একটি দুর্লভ বিষয়। খেজুরের সুমিষ্ট রস ও পাটালিগুড়ের নানা রকম পিঠা-পায়েশে ভরে ওঠে আবহমান আমাদের গ্রামবাংলা। ওঠে মৌমাছির গুঞ্জন এবং নানা ফুলের সমাহার। শীতের সকাল মানেই নতুন কোনো পিঠার স্বাদ নেয়া। 

এখনকার দিনে মানুষের শহরমুখিতার জন্য গ্রামগুলোও দিনে দিনে এসব আনন্দ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর শহরের যান্ত্রিক জীবনে এসব শীতের আনন্দ একেবারে কল্পনাই করা যায় না। কুয়াশায় ঢেকে থাকে গ্রাম, ফসলের ক্ষেত, ছোট্ট নদী, কুয়াশার কোমল স্পর্শ আমাদের সর্বাঙ্গ ভরিয়ে দিতে থাকে, হৃদয়ের গভীর প্রদেশে শীতকে আমরা জায়গা করে দিই।

কোনো কোনো রাতে কুয়াশা গাঢ় হলে বেশি দূর দেখা যাবে না। কিন্তু যেটুকু দেখা যাবে, তার বর্ণনাই বা কে দিতে পারবে! মনে হতে থাকবে, সমস্ত গ্রাম-প্রকৃতি প্রেয়সীর মতো ধরা দিয়েছে সেই রূপের মোহনীয়তার কাছে। আমাদের কাছে। শীত অবিরাম, সারারাত মিশতে থাকবে- শীতের নৈঃশব্দ্য ছড়িয়ে ছড়িয়ে বাতাসে ভাসবে দুগ্ধধোয়া আলো-অন্ধকার। জোছনার ফুল। 

আমাদের এই দেশে, আধুনিক বাংলা কবিতায় শীত এসেছে পশ্চিমা সাহিত্য থেকে। বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্য থেকে। তাই বাংলা সাহিত্যে শীতের ব্যবহার সবসময় এক রকম ছিল না। বিশেষ করে গত শতকের তিরিশের আগে বাংলা কবিতায় শীত ছিল- উৎসব।আমেরিকান-ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্ট শীতের ভাবকল্প এঁকেছেন- ‘স্টপিং বাই উডস অন এ স্নোয়ি ইভিনিং।’

অনেকেই শীতকে দেখেছেন, দুরন্ত হতাশা ও আশাহীনতার কাল হিসেবে। সি এস লুইস তার দ্য লায়ন, দ্য উইচ এন্ড দ্য ওয়ারড্রোব গ্রন্থের বিষয় করেছেন শীত। আরসুলা কে জেন্সের, দ্য লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস এবং আলেক্স রেমন্ডের ফ্লাস গর্ডন উপন্যাসে শীতকে বিশেষ প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

পশ্চিমা কবিদের কেউ কেউ শীতকে শয়তানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সিডোন গাব্রিয়েল বলেছেন, ‘জানুয়ারি মানথ অফ এমটি পকেটস! লেট আস এনডিউর দিস এভিল মানথ।’ মানুষ কেবল সমুদ্র ও আকাশ জয় করেনি- তাকে শীতও জয় করতে হয়েছে।

পিবি শেলি শীত নিয়ে বলেন অন্য কথা- ‘ও, উইন্ড, ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড।’ শেলির মতো বাঙালির বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামেরও শীতের কবিতা আছে। ‘শীতের সিন্ধু’ কবিতায় তিনিও শীতকে জীবনের একটি পর্যায় হিসেবে দেখেছেন। লীলাখেলা হিসেবে দেখেছেন- ‘ওগো মোর লীলা সাথী অতীত বর্ষার/আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার।’ শীতের কবলে পড়ে মহাপরাক্রমশালী সম্রাট নেপোলিয়ানও ধরাশায়ী হয়েছিলেন।

তবে কবিরা শীতকে যেভাবেই দেখুক না কেন, আন্তভ চেখভের কথাই সত্য-সুন্দর- ‘সুখী কোনো মানুষই জানতে চায় না- এটি শীত না বসন্ত।’

রাধাকৃষ্ণের প্রেম থেকে বর্ষা, শীত ও বসন্তকে বাদ দেয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের শীত নিয়ে অসংখ্য গল্প-কবিতা আছে। তিনি লেখেন- ‘শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলো/গানের হাওয়া শেষ না হতে/মনে কথা ছড়িয়ে এলোমেলো/ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।’

পল্লী কবি জসীমউদ্দীন তার বিখ্যাত রাখাল ছেলে কবিতায় বলেছেন- ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোগে হাসে। কিংবা সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই কিংবা চলতে পথে মটরশুটি জড়িয়ে দুখান পা,/বলছে ডেকে গায়ের রাখাল একটু খেলে যা!’

কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতায় শীত- এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা। শামসুর রাহমানের কবিতায় শীত- ‘দুটুকরো রুটি/না পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক গাঁ ঘুমেই বিবর্ণ হই। কিংবা শান্ত রূপালী স্বর্গ শিশিরে স্নান করি আমি।’

কবি আল মাহমুদের কবিতায় প্রকৃতি বর্ণনায় শীত তেমন তীব্র নয়। তার কবিতার বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শীত। যেমন লোকলোকান্তর অথবা প্রত্যাবর্তনের লজ্জায় তিনি বলেন, ‘সাত মাইল হেঁটে এসে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে/এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।/কুয়াশার সাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।/শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়/শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ।/... কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেনু মেখে পায়/সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে।’

আবদুল মান্নান সৈয়দ শীত নিয়ে তার কবিতায় বলেন, ‘শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের/আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎ করে।’ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতাতেও শীত এসেছে নানাভাবে- আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতে- শীতার্দ্র হয়েছিলাম।

ভাস্কর চক্রবর্তী কবিতায় শীত- ‘ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলেই/ বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি,/ঘড়ির কাঁটা আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন-আমার ভালো লাগে না/ শীতকালকবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব।’

প্রকৃতপক্ষে শীতকে কখনো কবিরা উপেক্ষা করতে পারেননি, সর্বকালে কবিতায় শীত কিংবা শীতের রূপ উঠে এসেছে। শীতকে উদযাপনের মধ্যে দিয়ে আমরা মিশে যাই নতুন দিনের স্বপ্নে, সে স্বপ্ন যেন দীর্ঘায়িত হয় নতুন শস্যের মতোন- সে প্রত্যাশা প্রকৃতির শীতের কাছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //