মাতৃভাষার শত্রু-মিত্র

চিনুয়া আচেবে তার ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাসটি কোনো আফ্রিকান ভাষায় অনুবাদের অনুমতি দেননি; তার বিশ্বাস ছিলো ইংরেজি বা ফরাসির মতো ‘অগ্রসর’ ভাষাকেই হতে হবে আফ্রিকায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ১৯৮১ সালে তিনি জাপান গিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খেলেন, সেখানকার সবাই দিব্যি জাপানি ভাষায় দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা আর সব উচ্চতর বিদ্যাচর্চা করছে।

তার প্রশ্নের উত্তরে ওয়াজেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কিনিচিরো তোবা তাকে বললেন, কীভাবে বিষয়টা সম্ভব হলো- ‘আমার দাদা  টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮০ দশকের শুরুর দিককার স্নাতক। তার খেরোখাতা ভর্তি ছিলো ইংরেজিতে। আমার পিতা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২০-এর দশকের স্নাতক, আর তার খেরোখাতার আধাআধি ছিল ইংরেজিতে, বাকি আধখানা জাপানি ভাষায়।

এক প্রজন্ম পর আমি যখন স্নাতক হই, আমার সবটা টোকাটুকি হয়েছিল জাপানি ভাষায়। এভাবে আমাদের নিজেদের ভাষার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতাকে পুরোটা আত্মস্থ করতে লেগেছিল তিনটি প্রজন্ম।’

সেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে সত্যেন বোস- সকলেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেছেন, ভাষা যদি কেবল দৈনন্দিন জীবনের বাহন হয়, কিন্তু তাকে বিজ্ঞান-রাষ্ট্রনীতি-প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখা হয়, সেই ভাষা শক্তিশালী হয় না। তার স্বাভাবিক শক্তির বিকাশ ঘটে না।

যতো উৎকৃষ্টই হোক, শুধু সাহিত্য ভাষাকে রক্ষা করে না, ভাষার চাই রাষ্ট্রের যোগাযোগের মাধ্যম হবার ক্ষমতা, জ্ঞান আর গবেষণার মাধ্যম হবার সুযোগ। সত্যি বলতে কী, রাষ্ট্রনৈতিক এই বদল না ঘটলে, কিংবা তার আন্দোলন না হলে কোনো ভাষায় সাহিত্যও শক্তিশালী হয় না।

চিনুয়া আচেবে তার ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ উপন্যাসটি কোনো আফ্রিকান ভাষায় অনুবাদের অনুমতি দেননি; তার বিশ্বাস ছিল ইংরেজি বা ফরাসির মতো ‘অগ্রসর’ ভাষাকেই হতে হবে আফ্রিকায় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ১৯৮১ সালে তিনি জাপান গিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খেলেন, সেখানকার সবাই দিব্যি জাপানি ভাষায় দর্শন, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা আর সব উচ্চতর বিদ্যাচর্চা করছে।

তার প্রশ্নের উত্তরে ওয়াজেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক কিনিচিরো তোবা তাকে বললেন, কীভাবে বিষয়টা সম্ভব হলো- ‘আমার দাদা  টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৮০ দশকের শুরুর দিককার স্নাতক। তার খেরোখাতা ভর্তি ছিল ইংরেজিতে। আমার পিতা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২০-এর দশকের স্নাতক, আর তার খেরোখাতার আধাআধি ছিল ইংরেজিতে, বাকি আধখানা জাপানি ভাষায়। এক প্রজন্ম পর আমি যখন স্নাতক হই, আমার সবটা টোকাটুকি হয়েছিল জাপানি ভাষায়। এভাবে আমাদের নিজেদের ভাষার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতাকে পুরোটা আত্মস্থ করতে লেগেছিল তিনটি প্রজন্ম।’

আসলে এই সারসংকলনটুকুর মধ্যেই আছে সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কীভাবে নতুন নতুন ভাষায় জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ে তার মর্মবস্তুটুকু। শর্ত একটাই, উচ্চতর জ্ঞানে সেই রাষ্ট্রটি যারা পরিচালনা করেন, তাদের আগ্রহ আর প্রয়োজন থাকতে হবে। তাদের স্বার্থ যদি হয় লুণ্ঠন, বিদেশে টাকা পাচার, মাতৃভাষার উন্নয়নে তারা মায়াকান্না করবেন অনেক।

কিন্তু কাজের কাজ হবে না কিছুই। যারা দেশের ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত নেন, তাদের ছেলেমেয়েরা যদি বিদেশি ভাষায় সম্পূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করে, বিদেশই হয় তাদের অবসরের ঠিকানা, তাহলে কেন তারা দেশের শিক্ষার জন্য ভালোমন্দ কিছু করতে যাবেন? বরং অর্ধশিক্ষিত অজ্ঞ একটি জনগোষ্ঠীই তাদের কাম্য, সেটাই তারা দেশজুড়ে করছেন।

বিশ্বজ্ঞানকে মাতৃভাষায় রূপান্তরের মধ্য দিয়েই দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। এর ব্যতিক্রম যেখানেই ঘটেছে, সেখানেই উচ্চশিক্ষা পরিণত হয়েছে দেশীয় অভিজাতদের বৈশ্বিক অভিজাতের সঙ্গে গা ঘষাঘষির খাতির জমানো আর দেশের আমজনতার ওপর ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাবার মাধ্যমে।

সত্যেন বোস এই বিষয়টা খেয়াল করেছিলেন প্রথম চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের নিদারুণ পরাজয়ে, ভারত আর চীনের পার্থক্যের মধ্যে। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তিতে রূপান্তরে চীন সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন, এবং তার ধারণা হয়েছিল ভারত (একই যুক্তিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) পারবে না, কারণ তখনো অনগ্রসর চীন মাতৃভাষায় দুনিয়াটাকে নিয়ে এসেছে প্রাণপণ শক্তিতে, ভারত জাতিসমূহের মাতৃভাষাকে উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষা করেছে।

এর কারণ সমাজের মাঝে মৌলিক বদলটি চীনে ঘটেছে, ভারতে ঘটেনি। এই মৌলিক বদলটি নানান ভাবেই ঘটতে পারে, তা একভাবে ঘটেছে জাপানে, একভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায়, একভাবে ভিয়েতনামে, এমনকি হালের মালয়েশিয়াতেও। কিন্তু এটার যদি অভাব ঘটে, উপনিবেশিক আনুগত্যে নুইয়ে পড়া অভিজাতরা দেশকে কতভাবে ধ্বংস করে, বাংলাদেশ তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

যে গণমানুষের স্বার্থ গোটা দুনিয়ার জ্ঞানকে মাতৃভাষায় রূপান্তর, তারাই মাতৃভাষার পরম মিত্র। অন্যদিকে, দেশটাকে যারা নিছক সম্পদ কামাবার এবং বিদেশে পাচার করবার মৃগয়া ভাবেন, মাতৃভাষারও তারা চরমতম শত্রু।

লেখক : প্রবন্ধকার ও রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য গণসংহতি আন্দোলন

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //