ভাষা আন্দোলন কি ব্যর্থ হয়েছে?

ভাষা আন্দোলনের সূচনা মূলত পাকিস্তান জন্মের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছিলো। কিন্তু এ প্রক্রিয়া চলছিলো পাকিস্তান হওয়ার আগে থেকেই। এ প্রসঙ্গে আমি বরাবরই বলি, বাঙালি মুসলমান পশ্চাদপদ থাকার কারণে তারা ১৯৪৬ সালে চোখ বন্ধ করে মুসলিম লীগের বাক্সে পাকিস্তান হওয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলো- প্রকৃত পক্ষে এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই হলো অখন্ড ভারত দ্বিখন্ডিত করা, বঙ্গভাগ এগুলোর জন্য দায়ী।

মুসলিম লীগ মুসলমানদের জন্য একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান হলেও এর কেন্দ্রীয় দলগত প্রাধান্য ছিল উর্দুভাষীদের হাতে। এমনকি প্রভাবশালী বাঙালি মুসলমান এ কে ফজলুল হক সাহেব চেষ্টা করেও মুসলিম লীগের হাই কমান্ডে ঢুকতে পারেননি, পরে জিন্নাহ কর্তৃক তিনি বহিষ্কৃতও হন সদস্য পদ থেকে। এমন অবস্থায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, সহিংসতা এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই দেশভাগ নিশ্চিত হয়। তখন ১৭ মে ১৯৪৭, উত্তর প্রদেশের একজন খ্যাতনামা মুসলিম লীগ নেতা খালেকুজ্জামান বলেন- পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, আর যার রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

ওই সময়ে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান নিয়ে এতটাই আচ্ছন্ন ছিলো যে, কেউ কোনো কথা বলেননি। সেই সময়ে ইত্তেহাদ সংবাদপত্রে যারা কাজ করতেন, তারা ছিলেন প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান- তাদের কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। সামান্য নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর বলা চলে- আবদুল হক সাহেব, মাহমুদুল হক মুজাহিদী তারা কয়েকজন আজাদ এবং ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করলেন। তাদের মূল দাবি ছিল উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।

আবার ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছিলেন- ভারত চিন্তা করছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য, সে হিসেবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রবন্ধ লিখলেন। এই সময়কেই অনেকে বলেন ভাষা আন্দোলন, কিন্তু আমি বলি না, আমি বলি- এটা ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পর্যায়।

কারণ এ সময়ে বাঙালিরা মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করেছেন, লিখে প্রতিবাদ করেছেন- কিন্তু আন্দোলন করেননি, রাজপথে নামেননি, স্লোগান দেননি। এর ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই সেপ্টেম্বর মাসে তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে- ‘পাস্তিানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা’। সেখানে ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ, ড. আবুল কাশেম প্রবন্ধ লিখলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘কৃষ্টি’ নামে আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, অধ্যাপক ড. এনামুল হক ওই পত্রিকায় বাংলা ভাষার পক্ষে প্রবন্ধ লিখেছিলেন- এই ব্যাপারগুলোও আমার কাছে ওই তাত্ত্বিক পর্যায়েরই।

ভাষা আন্দোলন সাংগঠনিকভাবে শুরু হলো ১৯৪৮ সালে। ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে যে আন্দোলন রাজপথে সংগঠিত হয় তা ছিল মূলত ছাত্রদের। সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের গণপরিষদের। প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন- গণপরিষদে মাতৃভাষায় বক্তৃতা করবেন আর ব্যবহারিক ভাষা উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা গ্রহণ করা হোক।

এটা একটা বাস্তব সত্য যে, কয়েকজন উচ্চ শ্রেণির বাঙালি মুসলমান উর্দু বা ইংরেজিতে সড়গড় করে বক্তব্য দেওয়া ব্যতিত ওই ভাষা সাধারণের মধ্যে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলেন না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ছিল অত্যন্ত বাস্তব। কিন্তু তার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে তখনকার পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনসহ মুসলিম লীগের সবাই। বিরোধিতা এমন অবস্থায় পৌঁছায়- প্রস্তাবটিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হলো।

৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেই খবরটি ঢাকায় প্রকাশের পর ছাত্রসমাজ। স্বতস্ফূর্তভাবে মুসলিম লীগের এই বিরোধিতার প্রতিবাদে রাজপথে নামে। সভা সমিতি মিছিল শুরু হয় চারদিকে, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন, তমদ্দুন মজলিস পুরোপুরি ইসলামপন্থী একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিলো- তাই তাদের প্রাধান্যও ছিল। তারা ওই ইসলামপন্থী রাজনীতির কারণেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রচার করেছে, কাজ করেছে। সংগ্রাম কমিটিতেও ছিল তাদের প্রাধান্য।

তখনকার সময়ে মুসলিম লীগের প্রভাব ছিল বাঙালি মুসলিম সমাজে এবং ছাত্র সমাজেও। অন্যদিকে, তখন ছাত্রলীগ বিভাজিত ছিল। মূল ছাত্রলীগের পাশাপাশি পূর্ব বঙ্গ ছাত্রলীগ শুরু হয়- যেটাকে নইমুদ্দিন ছাত্রলীগ বলতো সকলে- নইমুদ্দিন সাহেব, শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে অনেকেই এর মধ্যে ছিলেন।

এ সময় ছোট ছোট দল, যেমন- কামরুদ্দীন সাহেবের নেতৃত্বে গণ আজাদী লীগের মতো এরকম দু’চারটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া, প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠান খুব একটা ছিল না। কাজেই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনটি মূলত সামান্য কয়েকজন রাজনৈতিক লোকসহ ছাত্র সমাজেরই আন্দোলন। যদিও ১১ মার্চের আন্দোলন ডাকা হয়েছিল সারা দেশব্যাপী। ঢাকায় পিকেটিং অর্থাৎ সচিবালয় ঘেরাও, প্রধান অফিসগুলো- পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ অফিস, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ঘেরাও করার মতো পরিকল্পনা করা হয়েছিলো।

কিন্তু সরকারের পুলিশ বাহিনী বেধড়ক লাঠিচার্জ করে, চেষ্টা করে আন্দোলন দমন করার। সেই সময় অনেকেই গ্রেফতার হয়। সেদিন মুহাম্মদ তোহাসহ বেশ কয়েকজন নেতা আহত হয়েছিলেন, আর শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাকিরা ছিলেন জেলে। তখন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। পাকিস্তান হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রথম ঢাকা সফর করার কথা, স্বভাবতই নাজিম উদ্দিন সাহেব চাননি হট্টগোল আর প্রতিবাদের মাঝে- জিন্নাহ সাহেব আসুক এখানে।

এই অবস্থায় তিনি সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ৮ দফা চুক্তি করলেন। যার প্রধান দুটি দফা ছিল- বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এবং রাজ বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। ৮ দফা চুক্তি করা হয় এবং ১৫ মার্চ থেকে আন্দোলন স্থগিত, সঙ্গে সঙ্গে রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়- কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ চুক্তি মানতে চায়নি। অনেক কষ্টে তাদের বুঝিয়ে রাজি করানো হলো- তমদ্দুন মজলিসের প্রাধান্যের কারণে একক সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ১৯ তারিখে জিন্নাহ সাহেব আসেন, ২৩ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখলেন-পাকিস্তানে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা সে সময়, এমনকী পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজেও বিশেষত ঢাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।

কিন্তু তিনি সেই জনসভাতেই রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বললেন, ‘রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আমার বক্তব্য হলো- উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে অন্য কোনো ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যারা বিরোধিতা করেন, তারা পাকিস্তানের দুশমন।’ এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে যে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছিলো, সেখানেও তিনি অনেক কথার মাঝখানে ভাষার প্রশ্নে ওই একই কথা বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে কিছুসংখ্যক ছাত্র নো, নো, বলে প্রতিবাদ করেছিলেন- এটা ছিলো খুব সামান্য সংখ্যার ছাত্র, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। তিনি তা গ্রাহ্য করলেন না।

এর পরে তিনি যখন ঢাকা ছেড়ে যান বলে গেলেন যে- ‘৮ দফা দাবি জোর করে নেয়া হয়েছে, ওটা আমি বাতিল করে গেলাম।’ এই বিষয়ে আমার মত, চুক্তির মাধ্যমে সেই সময় আন্দোলন বন্ধ করাটা সঠিক ছিল না। কারণ দেখা গেল যে জিন্নাহ সাহেবের প্রভাব, তমদ্দুন মজলিসের পিছুটান, ছাত্রলীগের কিছুটা নীরবতা, বিশেষত, জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার পর তারা যে জোর করে প্রতিবাদ করবেন, তা করেননি, তার প্রমাণটা হলো- ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের দিনটিকে ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য কেউ কোনো চেষ্টা করেননি। ছাত্রলীগ তখন বড় সংগঠন, একটা মিছিল বা প্রতিবাদ সভা করতে পারতো খুব সহজেই, কিংবা তমদ্দুন মজলিসও- সেটা করেনি। সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ছাত্র ফেডারেশন।

তখনকার দিনে ছাত্র ফেডারেশন কোনো কাজ করতে পারতো না, রাস্তায় নামলেই পুলিশ বেধড়ক পেটাতো। নেত্রী নাদেরা বেগম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নাসির আহম্মদ, সৈয়দ আফজাল হোসেন, আবদুস সালামসহ ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন মিলে সেদিন ছোটখাটো একটা মিছিল বের করেছিলেন। তাতে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়, গ্রেফতার করে, শেষে আন্দোলন বন্ধ করে দেয়। কেননা, জনসাধারণের ওপর জিন্নাহ সাহেবের প্রভাব ছিলো।

প্রায় সাড়ে ৩-৪ বছর লেগে গেল নতুন করে আন্দোলন শুরু করতে। এর মধ্যে ১৯৫০ সালে যে দুটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলো আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে। আমাদের বন্ধু মানুষ, যিনি পরে ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এই সংগঠনটি নিয়ে, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন- ‘মিটিং ডাকি, কেউ আসে না, ফলে আমি একাই যা করার করি।’

১৯৫০ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বেসিক প্রিন্সিপালস কমিটি বা মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট। ওই কমিটির সুপারিশেও বলা হলো, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। মূলনীতি কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিকদের স্পর্শ করেছিলো, ১৯৫০ সাল তখন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান এবং গণ আজাদী লীগের কামরুদ্দিন সাহেবরা মিলে একটা প্রতিবাদের ব্যবস্থা করলেন। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। নবাবপুরের ওই মিছিলে আতাউর রহমানের পেছনে পেছনে হেঁটেছি, এটা আমার স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট। আতাউর রহমান সাহেবের গায়ে ছিল কালো শেরওয়ানি, পরনে চুড়িদার পাজামা, হাঁটছেন মিছিলে- বিকেলে পুরনো ঢাকায় বার লাইব্রেরিতে সভা, সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমি কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে।

এই আন্দোলনের কারণ একটাই, মুসলিম লীগের প্রচন্ড দমন নীতি। ১৯৪৮ সালের পরে ধীরে ধীরে সাংগঠনিক কাজগুলো হচ্ছিলো, ছাত্রসমাজের মধ্যে সচেতনতাও বাড়ছে। এই পরিবেশে একটা বিষয় আমি বরাবরই বলি। এই আন্দোলনটি যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়েছে নিজেদের গরজে, তার চেয়ে বেশি উস্কানি ছিল সরকার পক্ষের। যেমন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব ছিলো, সাধারণভাবেই আমি আমার নিজের ভাষায় বক্তৃতা করবো, এটা মেনে নিলেই হয়ে যেত। তাহলে এই আন্দোলন আর হতো না। তেমনি সাড়ে তিন বছর পর তখন প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন সাহেব আর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমিন সাহেব।

তখন মুসলিম লীগের কার্য উপলক্ষে ঢাকায় এসে বক্তৃতা দিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে।’  যথারীতি বললেন যে, ‘কায়েদে আজম অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলে গেছেন, যারা এর বিরোধিতা করেন, তারা পাকিস্তানের দুশমন, এটা আমার কথা না কায়েদে আজমের কথা।’

সময়টা ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। এটা বুঝতে তাদের ভুল হয়েছিলো, রাজনীতিক পরিস্থিতি বিচারেও হিসাব-নিকাশটা সঠিক ছিলো না। ছাত্র সমাজে যেন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তৃতার পরেই মৌচাকে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা হলো! মেডিকেল কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ এমনকি এই বাংলাবাজারের কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল- অর্থাৎ ঢাকার যতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সর্বত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। বলা বাহুল্য ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ হলে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো। ছাত্রদের উদ্যোগে ধর্মঘট, সভা মিছিল শুরু হলো।

এর মধ্যে ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সুষ্ঠুভাবে আন্দোলন পরিচালনার জন্য কর্মিসভার আহ্বান করা হলো। সেখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। আহ্বায়ক হলেন ছাত্রলীগের নেতা কাজী গোলাম মাহবুব। এই কমিটিতে সব দল এবং হলগুলো থেকে ছাত্র প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি এবং রাজনীতিক প্রতিনিধি নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো। ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে গেল, ৪ ফেব্রুয়ারির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি- আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গনে, এখন যেটা ঢাকার ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স, ওখানে বেলতলায় মিটিং হলো। ছাত্রদের এই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- আন্দোলন সক্রিয় করতে, বেগবান করতে, গতিশীল করতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে, সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান ইত্যাদির মাধ্যমে। এটা সংগ্রাম কমিটিও সমর্থন করল। মওলানা ভাসানী আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়েও এর সমর্থন করলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবাদের সিদ্ধান্তের কারণ হলো- ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন সভার প্রথম বাজেট অধিবেশনের দিন। উদ্দেশ্য ছিল বাজেট অধিবেশন ঘেরাও। এখন যেটা জগন্নাথ হল, সেটা ছিল পরিষদ ভবন। এখানে পরিষদ সদস্যদেরকে ঘেরাও করে ওই প্রস্তাব যেন নেয় এবং গণপরিষদে পাস করে এই দায়িত্বটুকু তারা পালন করে এই বিষয়ে তাদের দিয়ে মুচলেকা নেয়া।

উল্লেখ্য, তখনো পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব বঙ্গ। কারণ পাকিস্তান নামটি এসেছে এটা অনেকে ভুল করে, পূর্ব পাকিস্তান নামটি এসেছে ৫৬ সালের গণপরিষদের অধিবেশনে। যখন প্রথম সংবিধানে অধিবেশন তৈরি হলো। ওই সংবিধানেই বলা হলো- পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান। এর আগে নাম ছিলো- পূর্ব বঙ্গ, আইন সভার নাম ছিলো পূর্ব বঙ্গ পরিষদ বা ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি।

আন্দোলন নিয়ে সারা দেশব্যাপী প্রস্তুতি চলছে। এ সময়ে এক সমস্যা দেখা দিলো। আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান এবং গণ আজাদী লীগের কামরুদ্দিন সাহেবের মতো নেতারাও মনে করলেন- সামনেই পূর্ব বঙ্গ প্রাদেশিক নির্বাচন। প্রাদেশিক নির্বাচন মানেই তো ক্ষমতা। রাজনীতিক নেতারা চাইছিলেন- এখনই যদি আমরা সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে যাই, সংঘাতে যাই তাহলে হয়তো পাকিস্তান সরকার নির্বাচন বন্ধ করে দেবে।

আমার এখনো মনে আছে, সংগ্রাম পরিষদের আয়োজন প্রস্তুতি লক্ষ্য করে পূর্ব বঙ্গ প্রশাসন, নূরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি বিকালে সেক্রেটারি রোড ধরে আসা ঘোড়ার গাড়িতে ঘোষণা করছিলো ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং এখানে কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল চলবে না। এই অবস্থায় ২০ তারিখ রাতে সর্বদলীয় কমিটি নবাবপুরে সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়- এই মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না, কাজেই ১৪৪ ধারা ভাঙা সঠিক হবে না। সেখানে ছাত্র প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন ছিলেন- ওলি আহাদ, আবদুল মতিন এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র ও কলেজ ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলা। তারা প্রতিবাদ করে বললেন- সাধারণ ছাত্ররা এ সিদ্ধান্ত মানবে না।

তখন একটা আপোষ সিদ্ধান্ত হলো- পরদিন সকালে এই আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে আমতলায় ছাত্রসভা ডাকা হোক, তখন সিদ্ধান্ত দেখা যাবে কি হয়? পরদিন সকালে ছাত্র সভা হলো, সেখানে ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীরা পর্যন্ত অংশ নিয়েছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাসহ সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধি ছিলো। বাইরের রাস্তায় খাকি হাফ প্যান্ট পরা পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়লো, লাঠিপেটাও হলো অনেক।

এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ছাত্রদের মিছিল ব্যাচ হিসেবে বেরুলো। ছাত্রছাত্রীদের আলাদা আলাদা খন্ড খন্ড দল বের হচ্ছিলো, সেখানেও লাঠিপেটা হলো, গ্রেফতারও হলো অনেক- আমার অনেক বন্ধু, যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজের আলি আজমল, ফজলুল হক হলের আনোয়ারুল হক খান এ রকম আরো বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হলেন। হাবিবুর রহমান শেলী পরে বিচারপতি হয়েছিলেন, তিনিও গ্রেফতার হলেন।

এই পরিস্থিতিতে সবার একটাই লক্ষ্য ছিলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণটা তখন বিশাল আয়তনের। এখন যেখানে নার্সেস কোয়ার্টার, আউট ডোর- তখন সেখানে বিরাট বিরাট ছাউনি ছিলো, আমরা বলতাম মেডিকেল ব্যারাক। সেখান থেকে জগন্নাথ হল তো ১০০ গজ দূরে, সুতরাং সবচেয়ে কাছের জায়গাটিতে একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই উদ্দেশ্যেই সবাই চেষ্টা করেছে, কেউ রেললাইনের পেছন দিয়ে, কেউ মাঝখানের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে, কেউ ইট খুলে- আমিও ওই পথ দিয়ে গেলাম।

বাইরের রাস্তা দিয়ে পুলিশের লাঠির পিটুনিকে উপেক্ষা করে দুপুর ১২টা নাগাদ বেশ ভালোই জমায়েত হলো। পুলিশ তখন তাদের ব্যারিকেড সরিয়ে আমাদের ফুলার রোডে অর্থাৎ সেক্রেটারি রোডে নিয়ে এলো। বেশ শক্ত করেই ব্যারিকেড দিলো, যাতে জগন্নাথ হলের দিকে যেতে না পারে এই জমায়েত থেকে কেউ। এই অবস্থায় যত বেলা গড়াচ্ছিলো ততোই সাধারণ মানুষ যোগ দিচ্ছিল। তা না হলে কী করে সালাম এখানে গুলিবিদ্ধ হবেন- সচিবালয়ের পিয়ন, ময়মনসিংয়ের গফরগাঁওয়ের মানুষ আবদুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হবেন?

ছাত্র-অছাত্র তাদের সবারই মিলিত চেষ্টা ছিল বাইরে বেরোনোর, লাঠিপেটা খেয়ে গণপরিষদের ভেতরে ঢোকা। এই অবস্থার মধ্যে বেলা ৩টা ২০ মিনিট, এই সময়টা লেখা আছে এলিস কমিটির রিপোর্টে। তখন হঠাৎ সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্রদের জমায়েতে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালাল। গুলি চালানোর পর প্রথম শহীদ কে, এটা সব সময় সিরিয়ালি বলা হয় না। সিরিয়ালি বলা উচিত। প্রথম শহীদ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিক উদ্দিন, তার মাথায় গুলি লেগেছিল। মাথায় গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার, স্পট ডেড। আর আমাদের ২০ নম্বর ব্যারাকটা ছিল ফুলার রোডের সঙ্গেই লাগানো। এর কাছেই আবদুল জব্বার তলপেটে গুলিবিদ্ধ হলেন। তাকে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা বন্ধুবান্ধবরা মিলে হাসপাতালে নিলাম, সঙ্গে আমিও ছিলাম।

আর ১২ নম্বর ব্যারাকের কাছেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আবুল বরকত। তিনি মারা গেলেন অনেক পরে, অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো তার আগে। জব্বার ইমার্জেন্সিতে নেয়ার অনেক পরে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা গিয়েছিলেন। তাহলে প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন, দ্বিতীয় শহীদ আবদুল জব্বার, তৃতীয় শহীদ আবুল বরকত। সালাম, যার নাম দ্বিতীয় শহীদ হিসেবে উচ্চারিত হয়, এটা ঠিক না- উনি মারা গেলেন আরও পরে, তার পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগেছিলো। হাসপাতালে ভর্তি তিনি, মারা গেলেন এপ্রিল মাসে, আমি বলি- যথাযথ চিকিৎসার অভাবে।

কারণ, পায়ে গুলি লাগা লোক মরে যায় কীভাবে? আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাটা এমনই ছিল। আরেকটা কথা আমি বরাবরই বলি-এখানেও বলছি, আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। আমাদের ব্লাড ব্যাংক বা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ভালো থাকতো, রক্ত পরিবহনের ব্যবস্থা যদি ভালো থাকতো, তাহলে অন্তত আবুল বরকতকে বাঁচানো যেত। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা গেছেন তিনি, অন্য কোনো কারণে নয়। অপারেশন করে অনায়াসেই এটা করা যেত, কিন্তু উনি মারা গেলেন। 

ভাষা আন্দোলন, একুশের ভাষা আন্দোলনে- এতটা গতি সঞ্চারিত হওয়া এবং প্রদেশব্যাপী ব্যাপকভাবে জেলা শহর, থানা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার কারণ হলো ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। ২০১৯ সালে আমার লেখা একটা বই প্রকাশ করেছে ‘প্রথমা প্রকাশন’, নাম- ‘ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া’। এটা মূলত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে, কোথায় কোথায় গেছে, সেটার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

প্রত্যেকটি জায়গায় আমি দেখেছি, পুলিশের গুলিবর্ষণে ঢাকায় ছাত্রদের মৃত্যুর খবরই আন্দোলন শুরু করার একটা প্রেরণা, যা স্কুল পর্যন্ত বিস্তৃত- সে কারণে শিক্ষায়তনিক আন্দোলন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছিল। দ্বিতীয় দিনেই মিছিলগুলোতে একটা নতুন স্লোগান ছিলো- ‘ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’ এ ছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান তো ছিলই, সঙ্গে ছিল ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সারা ঢাকা সেদিন মিছিলের শহর। লাল-কালো, লাল মানে- লাল বর্ণমালায় লেখা ব্যানার, ফেস্টুন আর কালো মানে- কালো ব্যাচ, কালো পতাকা।

এই লাল-কালোর সমাহারে ঢাকা সেদিন প্রতিবাদের শহর। মিছিলের শহর। সেদিন ছাত্র আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হলো। যখন সাধারণ মানুষ শুনতে পেলো, ঢাকায় সাধারণ ছাত্রদের পুলিশ গুলি করে মেরেছে, তখন সারা দেশের মানুষ জাগলো, আন্দোলন বেগবান হলো। এইভাবে আন্দোলন চলল গোটা ফেব্রুয়ারি মাস। এর মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটলো শহীদ মিনার তৈরি। ওই যে দ্বিতীয় দিনে একটা আলাদা স্লোগান তৈরি হয়েছিল, সেটা ছিলো ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এই স্লোগানের পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে, আমাদের বন্ধুবান্ধবগণরা  এমনি কথা প্রসঙ্গে (এটা কাকতালীয়ও বলা যায়) বললেন- শহীদ স্মৃতি অমর করতে, একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করলে কেমন হয়? শহীদ মিনার নয়, তখন কথাটা ছিলো ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’।

২৩ তারিখ রাত, এই এক রাতের শ্রমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে এবং সেখানকার ছাত্রদের চেষ্টায় আবুল বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়া রক্তমাখা স্থানটিতে ১০ ফুট উঁচু, ৬ ফুট চওড়া একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হলো, দু’জন রাজমিস্ত্রির সহায়তা নিয়ে হোস্টেল প্রাঙ্গণে জমা ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে। এই সিমেন্ট সরবরাহে সহায়তা করেছিলেন আমাদের কলেজের সম্প্রসারণ কাজের সাব কন্ট্রাক্টর, হোসেনি দালানের পিয়ারী সরদার। তার কাছ থেকে  চাবি এনে গোডাউন থেকে হাসপাতালের স্ট্রেচারে করে সিমেন্ট এবং বালু হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হলো। কারফিউয়ের মধ্যে, পুলিশি টহলের মধ্যে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টার মধ্যে একটি শহীদ স্তম্ভ তৈরি করা হলো।

সেই সময়ের রেপ্লিকাটি আমার কাছে রয়েছে। পরদিন রবিবার ২৪ তারিখ, সরকারি ছুটির দিন। সেই দিন থেকে শুরু করে সারাক্ষণ ঢাকার মানুষ এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কেউ ফুল দিয়ে, কেউ টাকা পয়সা দিয়ে, কেউ অলঙ্কার দিয়ে ইত্যাদি। ২৬ তারিখ ভেঙে ফেলা হলো, সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে। কিন্তু শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ শুধু ঢাকা শহরে নয়, গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক জেলা শহর, মহকুমা শহরগুলোতেও হয়েছিল। যেমন রাজশাহী, মহকুমা শহর নড়াইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়সহ অনেক জায়গায় এ শহীদ মিনার তৈরি হয়েছিল। এই আন্দোলন চলেছে ২৭ তারিখ অবধি, তখনকার সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার আগপর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার পর- হোস্টেলগুলোকে খালি করে ফেলা হলো, শুধু মেডিকেল কলেজ এবং মিডফোর্ডের মেসগুলোতে ছাত্ররা ছিল, আমরা ছিলাম।

এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল যে, আন্দোলন আস্তে আস্তে স্থিমিত হয়ে গেল। ৫ মার্চ সাধারণ হরতাল ডাকা হয়েছিল ঢাকায়, সেটা খুব সফল হয়নি। ইতিমধ্যে অনেক রাজনীতির খেলা চলতে শুরু করেছে। 

১ সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের ভাষা আন্দোলন। এক সপ্তাহই বলা উচিত, এটা আমাদের কী দিয়েছে? এ থেকে কী পেয়েছি? প্রতীক হলো দুটো- প্রথমত, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, প্রতিবাদ দিবস বা ভাষা দিবস যা-ই বলি। দ্বিতীয়ত, শহীদ মিনার, এটা প্রতিবাদ-আন্দোলনের একটি প্রতীক। এই আন্দোলনের ফলাফল কী? ফলাফলটা হলো- এর আগপর্যন্ত আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি রাজনীতিতে পাকিস্তানি চেতনাটাই প্রধান ছিলো।

এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল, রাজনীতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ আন্দোলনের প্রভাবে একটি বাঁক ফেরা পরিবর্তন। পরিবর্তন দুই দিকে- রাজনীতিক বিচারে দুই ধারায়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা, সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চিন্তা। এই দুই ধারায় পরিবর্তন, যেটা পাকিস্তানি কনসেপ্টের পুরোপুরি বিরোধী। এই দুটোর পরিপ্রেক্ষিতেই ভাষা আন্দোলনের যত তাৎপর্য বলুন আর তার প্রতিক্রিয়া বা তার ফলাফল বিশ্লেষণ করুন- এগুলো একুশের মাধ্যমে হয়েছে। তিনটি স্লোগান আমরা ২১ তারিখ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত মিছিলে মিছিলে দিয়েছি- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’। আমাদের রাজনীতিক নেতারা সবাই স্বীকার করেন- ভাষা আন্দোলন আমাদের নতুন রাষ্ট্রের সুতিকাগার।

জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ, রাজনৈতিক প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ, ষাটের দশকে প্রাদেশিক সায়ত্বশাসন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মন্ত্রিসভা গঠন- এ সবই এ আন্দোলনের মাধ্যমে এসেছে। আবার আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে শেষপর্যন্ত ’৭১ সালের যুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তা যদি হয় দল মত নির্বিশেষে- আমি খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনেছি, শেখ সাহেবের বক্তৃতাও শুনেছি এবং শেখ হাসিনার বক্তৃতাও শুনেছি, তারা সবাই এই একই কথাগুলো বলেছেন। তাহলে এই ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস, সেটা সরকারের সংরক্ষণ করা উচিত ছিল না? মুক্তিযুদ্ধের ১৬ খন্ডের ইতিহাস তৈরি হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা লগ্নের সে ইতিহাস যে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রামের স্কুলগুলো পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো, বিস্তৃতি লাভ করেছিল-সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গড়া বা দলিলপত্র সংগ্রহ কিংবা লিপিবদ্ধ করার দ্বায়িত্বটা কোনো সরকার নেয়নি কেন? একই সঙ্গে আরেকটি প্রতীক শহীদ মিনার- আমাদের এই শহীদ মিনার তো ২৬ তারিখে ভেঙে ফেললো, তার পরিপ্রেক্ষিতেই পরে ৫৫ সাল থেকে শুরু করে ৫৬ সালে এসে আমাদের সর্বদলীয় সংগঠনের একটি অংশ হক সাহেবের কেএসপি, কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবুল হোসেন সাহেব এসে ভিত্তিপ্রস্তর করেন- আমাদের এ জায়গাটুকু, আমাদের হোস্টেলের অংশ বিশেষ এবং ফুলার রোডের অংশ বিশেষ নিয়ে। সেই শহীদ মিনারের ইতিহাসটা রচনা করা উচিত ছিল না? যা এখনো আমাদের প্রেরণা যোগাচ্ছে, রাজনীতিকভাবে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সব কিছুতে কাজের প্রেরণা যোগাচ্ছে- জাতি, জাতীয়তা, প্রগতিশীলতা সবখানে।

অথচ এই সামান্য দায়িত্ব কেউ পালন করেনি। তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতায় যাওয়া। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমাদের শেষ স্লোগানটি- সর্বস্তরে বাংলা চালু কর- একুশের বদৌলতে স্বাধীন বাংলাদেশে তো সেটা চালু করা সম্ভব ছিল। উচ্চ শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, উচ্চ আদালতে- সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমরা কি দেখছি- ১৯০ বছর যে বিদেশি শাসন এ দেশকে চালিয়েছে, তাদের রাজ ভাষা ইংরেজি এবং আদালত পর্যন্ত, উচ্চ আদালত- হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট; এখানে রাজ ভাষার প্রচলন রয়েছে একইভাবে, যেভাবে ওরা চালাতো ঠিক সেইভাবে সেই নিয়মেই চলছে। 

স্বাধীন বাংলাদেশে আদালতের নিয়ম, বিধি-বিধান কিছুই বদলায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা উচ্চ আদালতে ব্যবহৃত হয়নি, অথচ রাষ্ট্রভাষা বাংলা। স্বভাবতই আদালতের বাংলা ভাষার সর্বপ্রকার ব্যবহার উচিত বলে আমি মনে করি। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ছাড়াও বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি মাধ্যমে ভরে গেছে, যেমন এই একটি বিশেষ শ্রেণির উন্নতি হয়েছে।

আমি এই উন্নতিকে বলি- ভার্টিকেল গ্রোথ, মানে সামান্য ছোট্ট শ্রেণি, কিন্তু তার উচ্চতা অনেক। বিশাল এক বিত্তবান শ্রেণির জন্ম হয়েছে এদেশে, ফলে এদের এই দুর্মূল্য ইংরেজি মাধ্যমে তাদের সন্তানদের শিক্ষা নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অসুবিধে হচ্ছে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের। ফলে প্রত্যেকে তার ক্যারিয়ার তৈরি করতে ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাচ্ছে, তাহলে কি হলো?

আমি যদি বলি- ভাষা আন্দোলন এখানে ব্যর্থ! ভুল বলা হবে? ভাষা আন্দোলনের স্লোগানটাও তো ব্যর্থ হলো! সেই কারণেই আমি বলি, আমাদের সরকারগুলোর এক ধরনের উদাসীনতা, এক ধরনের অবহেলা- দুটোই কাজ করেছে। একুশের সুফলটা আমি ভোগ করেছি, ভোগ করছি- কিন্তু এর প্রতি যে দায় দ্বায়িত্ব, সে দায় দ্বায়িত্বটুকু পালন করিনি এবং করছি না। এটাই হলো ভাষা আন্দোলনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির একটা মূল্যায়ন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //