‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ আজ

স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের হুমকিতে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি পাঁচ জনে একজন স্থূলদেহী। ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৯ বছরে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে স্থূলতা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বেড়েছে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের ৭ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ স্থূল ছিলেন, কিন্তু ৩৩ বছরে ২০১৬ সালে দেশে স্থূলতা বেড়ে ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে। স্থূলতা এমনই এক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা বিশ্বের সব স্থানে সব বয়সের, সব আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। স্থূল মানুষ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, আরথ্রাইটিস, ক্রনিক কিডনি রোগ, এমনকি ক্যান্সারেও বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে স্থূলতা ও অপুষ্টি দুটিই এক সঙ্গে বিরাজমান। বেশিরভাগই শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। আবার এই শিশুদের মধ্যেই ৪.৫ শতাংশ স্থূলতায় ভুগছে। শিশুরা যেমন অপুষ্টিতে ভুগছে, আবার শহুরে স্কুলে যাওয়া শিশুদের মধ্যে স্থূলতা ও বেশি ওজন ‘এলার্মিং’ অবস্থায় পৌঁছে গেছে বলে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) গবেষণায় বলা হয়েছে। 

মনে করা হয়, শুধু ধনী পরিবারের মধ্যেই স্থূলতা আর বেশি ওজন সমস্যা রয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ধনী পরিবারের মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় খাবারের সমস্যা নেই, তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার (রিচ ফুড) খেয়ে থাকে।

কিন্তু বিএমজে প্রকাশিত গবেষণাটি দেখিয়েছে, ঢাকার বস্তির মানুষের মধ্যেও স্থূলতা ও বেশি ওজন এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ, জাপানসহ ১২ দেশের গবেষকরা ঢাকার বাউনিয়া বাঁধ বস্তির ১৮ থেকে ৬৪ বছরের দুই হাজার মানুষের মধ্যে গবেষণাটি চালান। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে, ১৬.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ২৪ শতাংশ নারী স্থূল হলেও গবেষণায় যাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র। বাউনিয়া বাঁধের বস্তিবাসীদের মধ্যে ১৮.৯ শতাংশ পুরুষ এবং নারীদের ৩৯.২ শতাংশ স্থূলতায় ভুগছেন।

বস্তিবাসীদের মধ্যে স্থূলতার কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, কায়িক শ্রম থেকে বসে করার মতো কাজে মানুষ বেশি করে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আবার উচ্চ কার্বোহাইড্রেট খাবার গ্রহণ, খাবারের সঙ্গে চিনি, ভোজ্য তেল ও লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া ও রাস্তার খাবার খাওয়ার কারণে বস্তিবাসীরা স্থূল হয়ে যাচ্ছেন।

গবেষণায় আরো বলা হয়, বাউনিয়া বাঁধ বস্তিবাসী নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার ছিল ২২.৫ শতাংশ এবং পুরুষের মধ্যে ১৫.৬ শতাংশ। ডায়াবেটিসের এ হার জাতীয় পর্যায় থেকেও দ্বিগুণ। জাতীয় পর্যায়ে পুরুষদের ৮.৬ শতাংশ এবং নারীদের ৭.৪ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। একই গবেষণায় বস্তিবাসীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশনে) ভুগছে এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়। বস্তিবাসী মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ছিল ২০.৭ শতাংশ নারী এবং ১৮.৬ শতাংশ পুরুষের।

ডায়াবেটিস সম্বন্ধে অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। শহরের মতো গ্রামেও ডায়াবেটিক রোগী বাড়ছে। এ রোগে প্রতি বছর ২ শতাংশ নতুন রোগী যোগ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান। এত বিশাল সংখ্যাক মানুষ এ রোগটিতে ভুগলেও ৭৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী এখনো চিকিৎসার আওতায় আসতে পারেনি। তাদের অনেকেই জানেন না যে, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। অসচেতনতা, কায়িক পরিশ্রম কম করা ও ফাস্ট ফুড কালচারসহ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে এ রোগের সংখ্যা বাড়ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ১৯৮৫ সালে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩ কোটি থাকলেও বর্তমানে ৩৬ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। গত আড়াই দশকে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ গুণ। আগামী ২০ বছরে রোগীর সংখ্যা ৫৫ কোটিতে দাঁড়াবে। উল্লেখ্য, ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীই উন্নয়নশীল বিশ্বের।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকোর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ৩৮ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক বিশ্বের ১৯৫টি দেশে ২৫০টি রোগে মৃত্যু ও ভবিষ্যতে কোন রোগে বেশি মৃত্যু হতে পারে, তার একটি গবেষণালব্ধ পূর্বাভাস দিয়েছেন। তাদের হিসাবে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে মারা গেছেন ৩১ হাজার ৪৬০ জন। ডায়াবেটিসে ২০৪০ সালে মারা যেতে পারে ৬৯ হাজার ৭৫০ জন। ২০ বছর পর ডায়াবেটিসে দ্বিগুণেরও বেশি মারা যাবে। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গবেষণা ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। ওই গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম স্থানে রয়েছে ডায়াবেটিস এবং ২০৪০ সালে ডায়াবটিসে মৃত্যুর স্থান হবে পঞ্চম। এটা এক সময় উচ্চবিত্তের রোগ হলেও বর্তমানে তা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন (বাডাস) ৮ দফা সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো ফাস্ট ফুড ও কোমল পানীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা, পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে সচেতনামূলক নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা, ফাস্ট ফুডের মোড়কে চর্বি ও ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ করা, নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি দেওয়ার সময় একক বা যৌথভাবে খেলার মাঠের ব্যবস্থা রাখা, রেডিও-টিভিতে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, এলাকাভিত্তিক ওয়ার্কিং ক্লাব ও সুইমিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা, নতুন বসতি গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়ার আগে পর্যাপ্ত রাস্তা রাখার বিধান করা, হাসপাতালে চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থা করা, ইমামদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মোবাইল ফোন অপাররেটরদের উৎসাহিত করা। 

ডায়াবেটিস কী
ডায়াবেটিস হলে রক্তে শর্করা বা গ্লকোজ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। ইনসুলিন অগ্নাশয়ের বিশেষ ধরনের কোষ (বিটা সেল) থেকে তৈরি হওয়া হরমোন, যা রক্ত থেকে গ্লুকোজকে কোষে নিয়ে জমা করে। শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হয় অথবা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকর ব্যবহার না হলে গ্লুকোজ কোষে পৌঁছাতে পারে না, শক্তির জোগানও দিতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য দেখা দেয়। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিলে দেহের স্বাভাবিক বিপাক ব্যাহত হয়। 

আক্রান্ত হওয়ার কারণ
ওজনাধিক্য ও মেদবাহুল্য, কায়িক শ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভাস এবং পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। এজন্য আগে-ভাগেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। 

ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণ
ঘন ঘন প্রসাব, স্বল্পসময়ে ওজন হ্রাস, অধিক তৃষ্ণা ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, অতিশয় দুর্বলভাব, ঘন ঘন রোগ সংক্রমণ, সার্বক্ষণিক ক্ষুধা ও ক্ষত না শুকানো। 

ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে প্রধাণত চার ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এগুলো হলো হৃদযন্ত্র ও রক্তনালির সমস্যা, কিডনিজনিত সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ও চোখের সমস্যা।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ
জীবনব্যাপী কায়িক পরিশ্রম করা বা শরীরচর্চা করা, পরিমিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ ও স্বাস্থ্যচর্চা করা, যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও পরিপূর্ণ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //