গুপ্তঘাতক সিফিলিস, অবহেলায় মৃত্যু-অঙ্গহানি

ট্রেপনোমা প্যালিডাম নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে ছড়ায় যৌনবাহিত রোগ সিফিলিস। প্রচলিত তত্ত্ব মতে, কলম্বাস এবং তার সঙ্গীরা আমেরিকা আবিষ্কারের পর ১৪৯২ সালে ইউরোপে ফেরার পথে এ রোগ নিয়ে আসেন। সেখান থেকে ইতালি, ফ্রান্স হয়ে পুরো ইউরোপে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে সিফিলিস। মূলত অনিয়ন্ত্রিত যৌন মিলন, আক্রান্ত ব্যক্তির লালা ও রক্ত; এমনকি গর্ভাবস্থায় মায়ের সিফিলিস থাকলে নবজাতকও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সিফিলিসে আক্রান্ত ব্যক্তির এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।

সাধারণত চার ধাপে মানব শরীরে রোগটি বিস্তার করে। বিভিন্ন ধাপে রোগটির লক্ষণও বিভিন্ন রকম। সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ রোগের সুপ্তকাল ৯ থেকে ৯০ দিন।

সিফিলিসের লক্ষণ

প্রাইমারি স্টেজ:

এই পর্যায়ে শরীরে এক বা একাধিক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। মূলত যে স্থান দিয়ে সিফিলিস শরীরে প্রবেশ করে সেখানেই ক্ষত দেখা দেয়। ব্যথা না থাকায় এই ক্ষত সহজেই মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। চিকিৎসা ছাড়াই তিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ক্ষত সেরে যায়। অবহেলা করে চিকিৎসা না নিলে দ্বিতীয় ধাপে চলে যায় প্রাণঘাতী এই রোগ।

প্রাইমারি সিফিলিসের ক্ষত।


সেকেন্ডারি স্টেজ:

এই ধাপে চামড়ায় এক ধরনের র‍্যাশ দেখা দেয়, যা সাধারণত চুলকায় না। হাত ও পায়ের তালুতে শক্ত লাল বর্ণের র‍্যাশ দেখা দেয়। গা ম্যাজম্যাজ করা, জ্বর ভাব, মাথাব্যথা, ওজন হ্রাস ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। শরীরের লসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলে যাওয়ার পাশাপাশি মুখ, পায়ুপথ ও যৌনাঙ্গে ক্ষত দেখা দেয়। কয়েক সপ্তাহ পর বিনা চিকিৎসায় ক্ষত সেরে যায়। কিন্তু চিকিৎসা না নেয়ায় রোগটি সুপ্ত অবস্থায় চলে যায়।

হাতের তালুতে সিফিলিস র‍্যাশ।


ল্যাটেন্ট স্টেজ:

এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। চিকিৎসা না নিলে কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করে বছরের পর বছরে শরীরে থেকে যায় সিফিলিস। 


টারশিয়ারি স্টেজ:

সিফিলিস এই পর্যায়ে চলে আসাটা বিপজ্জনক। কারণে এই পর্যায়ে জীবাণুটি মানুষের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গে হামলা করে। আক্রান্ত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্র বিকল করে দিতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার ১০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এই পর্যায়ে লক্ষণ দেখা দেয় এবং অঙ্গহানির পাশাপাশি মৃত্যুও হয়।

সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ না করলে চোখেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে ব্যাকটেরিয়াটি। এমনকি চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যাওয়ারও ঝুঁকি থাকে।


সিফিলিস নির্ণয়

সাধারণত দুই ধরনের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সিফিলিস শনাক্ত করা হয়। সিফিলিস নির্ণয়ে ননট্রেপনোমাল টেস্ট (ভিডিআরএল ও আরপিআর) এবং ট্রেপনোমাল টেস্ট (এফটিএ-এবিএস,টিপি-পিএ) এই দুই ধরনের টেস্ট করার কথা বলেছে সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।

অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ট্রেপনোমা প্যালিডাম জীবাণু।


চিকিৎসা

সিডিসির নির্দেশিত গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও আর্লি ল্যাটেন্ট পর্যায়ের সিফিলসের চিকিৎসায় ২.৪ মিলিয়ন ইউনিট বেনজাথিন পেনিসিলিন জি ইনজেকশন আক্রান্ত ব্যক্তির মাংসপেশিতে একবার প্রয়োগ করতে হবে।

লেইট ল্যাটেন্ট পর্যায়ের সিফিলিস চিকিৎসায় ২.৪ মিলিয়ন ইউনিট বেনজাথিন পেনিসিলিন জি-এর তিনটি ডোজ আক্রান্ত ব্যক্তির মাংসপেশিতে প্রতি সপ্তাহে একবার করে মোট তিন সপ্তাহ প্রয়োগ করতে হবে।

স্নায়ুতন্ত্র ও চোখ সিফিলিসে আক্রান্ত হলে ১৮ থেকে ২৪ মিলিয়ন ইউনিট অ্যাইকুইয়াস ক্রিস্ট্যালিন পেনিসিলিন জি প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে। সিডিসির নির্দেশিত গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতি চার ঘন্টা পর তিন থেকে চার মিলিয়ন ইউনিট পেনিসিলিন শিরায় প্রয়োগ করতে হবে। ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত এই চিকিৎসা চালাতে হবে।

চিকিৎসা নিলে সিফিলিস পুরোপুরি সেরে যায় কিন্তু জীবাণুটির কারণে অঙ্গপ্রতঙ্গের যে ক্ষতি হয়, তা সারানো সম্ভব হয় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //