করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পশ্চিমা পুঁজিবাদ

১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) কমিশনার স্টিফেন হান মার্কিন কংগ্রেসকে বলেন, এফডিএ এ বিষয়ে অবগত- নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য যেসব কেমিক্যাল বা রিএজেন্ট দরকার, সেগুলোর সরবরাহের ওপর চাপ পড়েছে।

মেডিকেল ম্যাগাজিন মেডটেক ডাইভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি কিয়াজেন জানিয়েছে, তারা তীব্র চাহিদার কারণে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। 

মার্কিন চাহিদা বাড়ার কারণে কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যন্ডের জার্মানটাউনে তাদের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। কিয়াজেন হলো মেডিকেল গবেষণার জন্যে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি, যাদের বাৎসরিক আয় দেড় বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কোম্পানিটির হেডকোয়ার্টার নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে; যার কর্মী সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। 

ইয়াহু ফিন্যান্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ছয় মাসে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে মেডিকেল কোম্পানিগুলোর স্টকের মূল্য যেখানে ৪ শতাংশ কমেছে, সেখানে কিয়াজেনের শেয়ারের মূল্য বেড়েছে ১৪ শতাংশ। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতনের মাঝেও কোম্পানিটির দর বেড়েছে।

মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) করোনাভাইরাসের টেস্টিং কিটের জন্য ছয়টি রিএজেন্টের নাম উল্লেখ করেছে, যার মাঝে কিয়াএম্প ডিএসপি, এজেড-১ ও কিউআইএকিউব তৈরি করছে কিয়াজেন। এর বাইরেও কোম্পানিটি কিয়াস্ট্যাট-ডিএক্স নামের একটি টেস্ট কিট বাজারে ছেড়েছে। 

সিডিসির অনুমতিপ্রাপ্ত বাকি তিনটি রিএজেন্ট হলো রোশ কোম্পানির ম্যাগনা পিউর এলসি, ম্যাগনা পিউর কমপ্যাক্ট এবং ম্যাগনা পিউর ৯৬। 

ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন ইনভেস্টর্স বিজনেস ডেইলি এক প্রতিবেদনে জানায়, এফডিএর কাছ থেকে করোনাভাইরাসের টেস্টিংয়ের জন্য পণ্য সরবরাহের অনুমতি পাওয়ার পর ১৩ মার্চ রোশের শেয়ারের মূল্য একদিনেই ১৩ শতাংশ বেড়ে যায়। 

রোশ বা ফ্রিতস হফম্যান লা রোশ ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটা বহুজাতিক মেডিকেল কোম্পানি, যার হেডকোয়ার্টার সুইজারল্যান্ডে। এর বাৎসরিক আয় প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মী সংখ্যা ৯৪ হাজারেরও বেশি। 

অন্যদিকে, এই রিএজেন্টগুলো মার্কিন বাজারে সরবরাহের অনুমতি পেয়েছে ইনটিগ্রেটেড ডিএনএ টেকনোলজিস এবং বায়োরিসার্চ টেকনোলজিস নামের দুটি কোম্পানি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংস্থা দ্য ইন্টারসেপ্ট জানায়, করোনাভাইরাসের আতঙ্ক শুরুর পর থেকে প্রভাবশালী ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো মেডিকেল কোম্পানির ওপর করোনাভাইরাসের ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির জন্য চাপ দিচ্ছে। এমনই একটি কোম্পানি গিলিয়াড সাইন্সেস। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত এই বায়োটেকনোলজি কোম্পানির বাৎসরিক আয় ২২ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মী সংখ্যা ১১ হাজারের মতো। 

গিলিয়াডের ডেভেলপ করা ‘রেমডেসিভির’ নামক এন্টিভাইরাল ওষুধ ডেঙ্গু, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, মার্স ও সার্স ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এই রেমডেসিভিরই একমাত্র ওষুধ, যা করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা গেলে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই কথা বলার সাথে সাথেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গিলিয়াডের শেয়ারের মূল্য একদিনে ৬.৯ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২০১৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ মূল্যে পৌঁছায়। 

আল জাজিরা জানায়, শুধু ফেব্রুয়ারিতেই শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে গিলিয়াডের বাজারমূল্য ১২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়। ব্যাংক অব আমেরিকার বিশ্লেষকদের মতে, রেমডেসিভির বিক্রি করে কোম্পানিটির এককালীন আড়াই বিলিয়ন ডলার আয় আসতে পারে।

অন্যদিকে, বিপুলসংখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে অক্সিজেন দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। 

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতালির এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ্চিয়ান ফ্রাকাসি ও তার সহযোগী আলেসান্দ্রো রোমাইওলি ইতালির উত্তরে মিলানের কাছাকাছি চিয়ারি শহরের এক হাসপাতালে ‘ভেনচুরি’ ভালভ নামে পরিচিত একটা যন্ত্রের অপ্রতুলতার কথা শুনে থ্রিডি প্রিন্টারের সাহায্যে যন্ত্রটির ১০০টি কপি করার ব্যবস্থা করেন। আর এই কাজের জন্যে খরচ হয় এক ডলারেরও কম; যেখানে এই যন্ত্রের অরিজিনাল ভার্সনের মূল্য কয়েক হাজার ডলার। 

হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন, কপি করা মূল্যহীন এই যন্ত্র মুমূর্ষু রোগীর জন্য অমূল্য সেবা দিচ্ছে। এই যন্ত্রের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ইন্টারসার্জিক্যালের কাছ থেকে যন্ত্রটির ব্লুপ্রিন্ট চাওয়া হলে তারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানিয়ে দেয়, এই যন্ত্রের স্বত্ব শুধু তাদের কোম্পানির ও অন্য কারও এই যন্ত্র কপি করা বেআইনি। 

১৯৮২ সালে স্থাপিত হওয়া ইন্টারসার্জিক্যালের হেডকোয়ার্টার ব্রিটেনে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জন্যে কোম্পানিটি বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে থাকে। বর্তমানে এর কর্মীসংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। কোম্পানিটি এমন এক সময়ে তার যন্ত্রের ডিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানাল, যখন ইতালির স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান এসআইএএআরটি কলেজ জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মাঝে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি, শুধু তাদেরকেই চিকিৎসা দেয়ার জন্য গাইডলাইন দিয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ কত বয়স পর্যন্ত রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হবে, সে ব্যাপারেও ডাক্তারদের চিন্তা করতে বলেছে।

রিএজেন্ট, ওষুধ বা যন্ত্রপাতি ছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সব কিছুরই মারাত্মক স্বল্পতা চলছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চলছে ব্যবসা ও মুনাফার দৌরাত্ম্য। 

সামরিক পত্রিকা এয়ারফোর্স টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন বিমানবাহিনীর এক সাবেক সদস্য ১৭ হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেন। তারই মতো আরেকজন সাড়ে তিন ডলার দামে দুই হাজার জীবনরক্ষাকারী কিট নিনে ৪০ ডলার করে বিক্রি করেছেন। 

এনবিসি নিউজ ২৫০ মেডিকেল কর্মীর ওপর করা এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে বহু মেডিকেল কর্মী কোনো মাস্ক বা জীবাণুনাশক ছাড়াই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) এখন মারাত্মক স্বল্পতায় রয়েছে। 

চাকরি হারানোর ভয়ে নিজের নাম পরিচয় গোপন করে মিশিগানের এক নার্স জানান, তার মনে হয় না হাসপাতাল তাদের ব্যর্থতার কারণ; বরং পুরো ব্যবস্থাটাই এখন ব্যর্থ! 

মিশিগানের নার্সের মন্তব্য পুঁজিবাদের গোড়ার সমস্যাকেই তুলে ধরে। জীবনরক্ষাকারী রিএজেন্ট, ওষুধ ও যন্ত্রের ওপর মালিকানার স্বাধীনতা এবং যে কোনো দ্রব্য যে কোনো মুনাফায় বিক্রি করার মতো চিন্তাগুলো করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগের মাঝে পশ্চিমা মানবাধিকারের চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা কিনা পশ্চিমা সভ্যতার মূলেই আঘাত করছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //