করোনাভাইরাসে পশ্চিমা সমাজের বৈষম্য

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা জানায়, দেশটির সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয়ের মানুষের গড় আয়ুর পার্থক্য নয় বছর। 

ব্রিটেনের উচ্চবিত্ত এলাকাগুলো থেকে যাত্রা করে নিম্নবিত্ত এলাকার দিকে যেতে থাকলেই গড় আয়ু এক বছর করে কমতে থাকে। খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে হৃদরোগে মৃত্যুর হার উচ্চবিত্তদের চেয়ে তিনগুণ বেশি। 

ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট ও বক্ষব্যাধিও নিম্নবিত্তদের মাঝে অনেক বেশি। পেনশনে থাকা ১৯ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে। করোনাভাইরাস এখন এই বৈষম্যের বাস্তবতায় সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে।

উবার চালক, কারখানার শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী বা ডেলিভারি সার্ভিসে কাজ করা নিম্নআয়ের মানুষগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকিতে যেমন পড়ছে, তেমনি অর্থনৈতিক দুর্যোগেও পতিত হতে যাচ্ছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী ব্যাপক অর্থ নিজেদের পকেট ভরেছে; অন্যদিকে, নিজেদের অর্থনৈতিক ঝুঁকি জনগণের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের অর্থে বাঁচানো হয়েছে; যার ফলে পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলো ক্ষতি থেকে তো বের হয়েছেই; তাদের মুনাফা হয়েছে আকাশচুম্বী। অথচ পুরো সমস্যার কেন্দ্রেই ছিল ব্যাংকগুলোর দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণ ব্যবসা ও জনগণের লগ্নিকৃত অর্থ ব্যবহার করে জুয়া খেলা। 

বেশিরভাগ খেটে খাওয়া নাগরিকের জীবনে বিন্দুমাত্র উন্নতি আসেনি। অনেকেরই বাড়িঘর কেড়ে নেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দায় নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়েছিল। এবারো তাদের অবস্থাই সবচেয়ে খারাপের দিকে; তবে এর গতি অনেক বেশি দ্রুত। 

গোল্ডমান শাক্সের হিসাবে এপ্রিল থেকে জুনের মাঝে মার্কিন অর্থনীতি ২৪ শতাংশ কমতে পারে। আর মরগ্যান স্ট্যানলি বলছে, এটি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।

মার্কিন সরকারের অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজে ভাগ বসানোর জন্য বিভিন্ন কারখানার মালিক গ্রুপ, বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও হোটেল চেইন, ট্রাভেল অপারেটর, কয়লা খনির মালিক, মদ উৎপাদক কোম্পানি ইত্যাদি বাণিজ্যিক গ্রুপ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও শীর্ষ এক্সিকিউটিভরাই বরাবর সুবিধা পেয়েছেন; এতে উৎপাদন বৃদ্ধি বা গবেষণালব্ধ কাজে বিনিয়োগ হয়নি। 

এছাড়াও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি মানুষ চিকিৎসা ভাতা পায় না। লাখো নাগরিকের জন্য চিকিৎসাসেবা সুলভ নয়। মিয়ামি হেরাল্ডের ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনফেরত এক আমেরিকান ফ্লুর লক্ষণ দেখা যাওয়ার পর দায়িত্ববান নাগরিকের মতো ফ্লোরিডার হাসপাতালে যান করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে। টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এলেও কয়েক সপ্তাহ পর তার কাছে ৩ হাজার ২৭০ ডলারের একটা মেডিকেল বিল চলে আসে। 

ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি জানায়, তিনি সর্বোচ্চ এক হাজার ৪০০ ডলার ইন্স্যুরেন্স বাবদ পেতে পারেন; বাকিটা তার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। 

লস এঞ্জেলেস টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ইন্স্যুরেন্সের মাঝে থাকা চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম ইন্স্যুরেন্স পেয়ে থাকেন। চিকিৎসা খরচে অনেকটাই তাদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। উল্লেখ্য, তার হেলথ ইন্স্যুরেন্স রয়েছে; অনেকের আবার সেটিও নেই। 

ইউনাইটেড স্টেটস সেনসাস ব্যুরোর ২০১৮ সালের হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ, বা সাড়ে আট শতাংশ জনগণের হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেই। এটি ২০১৭ সালে ছিল ৭.৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৫৬ লাখ; অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই ১৯ লাখ মানুষ হেলথ ইন্স্যুরেন্স থেকে ঝরে পড়েন। এর পুরোটাই হয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে।

মার্কিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেক্স আজার জানান, করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন বের হলেও এর সুবিধা সবাই পাবেন, এমন নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারছেন না। 

মার্কিন গবেষণা সংস্থা গ্যালাপের ২০১৯ সালের এক জরিপে বলা হয়, জরিপে অংশ নেয়া জনগণের ১৩ শতাংশ জানিয়েছেন, গত ৫ বছরের মাঝে তাদের পরিচিত কেউ না কেউ অর্থের অভাবে চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেছেন। শ্বেতাঙ্গদের মাঝে এই হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ; আর অশ্বেতাঙ্গদের মাঝে তা ছিল ২০ শতাংশেরও বেশি! বার্ষিক ১ লাখ ডলারের বেশি আয়ের মানুষের মাঝে এই হার ছিল ৯ শতাংশ; আর ৪০ হাজার ডলারের কম আয়ের মানুষের মাঝে ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ!

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক লেখায় বলা হয়, ফেসবুক, গুগল ও টুইটারের মতো কোম্পানিগুলো নিজেদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে; কিন্তু হোটেল ও রেস্তোরাঁয় ওয়েটার, সুপারস্টোরে সেলসম্যান, বা বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ তো আর বাড়িতে বসে করা যাবে না। 

কলেজ পাস উচ্চ শিক্ষিত মানুষের অনেকেই বাড়ি থেকে কম্পিউটারে কাজ করতে পারছেন; অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত মানুষের অনেকেই কাজের অভাবে বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছেন। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা অনেকের জন্যই মানুষের সংস্পর্শে আসাটা বাঞ্ছনীয়। আর করোনাভাইরাসের কারণে এই মানুষগুলোই রোগের শিকার হচ্ছে বেশি; আবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তারাই উপার্জন ছাড়া বাড়িতে বসে থাকছে। 

শুধু তা-ই নয়, দ্য আটলান্টিকের এক লেখায় বলা হয়, কম আয়ের জনগণ বাস করছে গাদাগাদি করে; যার ফলে তাদের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকছে। 

করোনাভাইরাস পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যকে সরাসরি আঘাত করেছে। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে নিম্নআয়ের মানুষ; যাদের হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেই বা থাকলেও তা অপ্রতুল। উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত জনগণের অনেকেই বাড়িতে কাজ করে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ আশাহীন হয়ে পড়ছে। তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বড় বড় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও এক্সিকিউটিভদের সাথে। 

করোনাভাইরাস ঝড়ের আগেই পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের উপেক্ষা করেছিল; এখন সেই বৈষম্যের ফলাফলই আরো স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //