আধুনিক জীবনের বাস্তবতা; একাকীত্ব

মনের এক গভীর সমস্যার নাম একাকীত্ব। এটি ব্যক্তিকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ করে দিতে পারে। আধুনিক জীবনের বাস্তবতা হলো এই নিঃসঙ্গতা, যা এখন এক বৈশ্বিক সমস্যা। যুক্তরাজ্যে একাকীত্ব এমনই গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে যে, সে দেশে এ-সংক্রান্ত একটি মন্ত্রণালয়ই আছে। অনেক সমাজবিদ মনে করেন, নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বিধান অনুসরণ করা থেকেই নিঃসঙ্গতার উৎপত্তি।

আবার কিছু মনস্তত্ববিদ মনে করেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা, নিজের অনুভূতি যথাযথ প্রকাশ করতে না পারা এবং সামাজিক প্রক্রিয়া থেকেই নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বের অনুভূতি চরম আকার ধারণ করে। জার্মান মনস্তত্ববিদ রিচম্যানের মতে, নিঃসঙ্গতা একটি আবেগের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা। নিঃসঙ্গতাকে মনস্তত্ববিদরা সংযুক্ত করেছেন মানুষের মনের সাধারণ অসন্তোষ, অসুখী, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, শূন্যতা ও একঘেয়েমির অনুভূতির সাথে। আন্তর্জাতিক যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও শিক্ষক রবার্ট এস উইস মনে করেন, নিঃসঙ্গতা একটি ক্ষতিপূরণমূলক দীর্ঘস্থায়ী মর্মপীড়া।

একাকীত্বের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নে মোটাদাগে বলা যায়- এক সময় যৌথ পরিবারে তিন প্রজন্ম একসঙ্গে বসবাস করতেন। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। বার্ধক্যেও একাকীত্ব ছিল বিরল ঘটনা। কিন্তু নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। পড়াশোনা অথবা ভাগ্যের সন্ধানে পরিবার ছেড়ে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে বা অন্য দেশে। বিচ্ছিন্নতার সেই থেকে শুরু। যদিও ভিড়ের মধ্যে বসে অথবা পরিবারে থেকেও অনেকে একা, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যৌথ পরিবার ভাঙ্গনের মধ্য দিয়েই মূলত একাকীত্ববোধ সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, একাকীত্বের আক্রমণ মধ্যবয়স বা প্রৌঢ়ত্বের তুলনায় বয়ঃসন্ধিতে বেশি। আঠারো বছর বয়সের নাগরিকদের সত্তর শতাংশেরও বেশি একাকীত্বে ভোগেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কাজ করা একটি মার্কিন সংস্থা সিগনার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আঠারো থেকে বাইশ বছর এবং তেইশ থেকে সাঁইত্রিশ বছর বয়ঃসীমায় থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে এর প্রকোপ বেশি। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগের মতো অজস্র মানসিক ও শারীরিক ব্যাধি।

এই যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তীব্র হয়ে উঠছে একাকীত্ববোধ আর বিচ্ছিন্নতা; এর বড় কারণ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। এতে সময় কাটে ঠিকই। কিন্তু কাছের মানুষগুলোর সাথে বাড়ে অমোচনীয় দূরত্ব। একাকীত্ব ঘোচে না। আর এভাবে দিন দিন তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার অক্ষমতা। ফলাফল নিঃসঙ্গ মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি নিঃসঙ্গ হতে থাকেন।

সামাজিক যোগাযোগ যাদের কম, তাদের মস্তিষ্কে এমন পরিবর্তন আসে, অন্য মানুষের চেহারা দেখলেও তাদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। ফলে অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও সম্পর্ক গড়ে ওঠা ক্রমেই আরো দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়, সামাজিক যোগাযোগের অভাব মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই নিঃসঙ্গ মানুষের অকাল মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেশি। ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, একাকীত্ব হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং মৃত্যু ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ করে তুলতে পারে। তাই একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে ইন্টারনেট-আসক্তি কমিয়ে পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর দিকে জোর দিয়েছেন মনোবিদরা। তারা বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সৃষ্টিশীল কাজে আরো সময় কাটানোর কথা বলেছেন। 

তবে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে দুঃসহ। কাজকর্ম, ব্যস্ততা নেই, নেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। নানারকম রোগ শরীরে ধরা পড়ে। সন্তানরা বড় হয়ে যার যার মতো আলাদা জগৎ গড়ে তোলে। চেনা পৃথিবীটা হয়ে যায় অচেনা। এ পরিবর্তন অনেকের পক্ষেই মেনে নেয়া কঠিন। আসলে সমাজে বয়স্কদের ব্যাপারে আমাদের উদসীনতা কম নয়। তাদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা আমরা করি না। উল্টো পরিবারের বোঝা মনে করি। বয়স্ক মানুষদের দেখভাল করার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকেও আমরা প্রায়শ দুরে সরে যাই। বার্ধক্যের একাকিত্ব দূর করতে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালো বন্ধু হতে পারেন আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষ। কেবল পত্রপত্রিকা পড়ে বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে বা ফেসবুকে মুখ গুঁজে না থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ, আশপাশের মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি করবে।

আমাদের মানবিক সম্পর্কের জমি ক্রমশ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা–ভরসা–বিশ্বাস-বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূলতা, অপ্রিয় বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে সবাই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভিড় করছে। কিন্তু এই কোলাহলের জগত প্রতেকটা মানুষকে পরস্পরের কাছে থেকে, আত্মার কাছে থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //