যে গ্রন্থ হয়ে ওঠে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের অনন্য স্কুল

মেনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট : দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া 

যে গ্রন্থ হয়ে ওঠে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের অনন্য স্কুল

মিডিয়া-সমাজ-ক্ষমতার পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া’ একটি আকরগ্রন্থ। দুনিয়াজুড়ে মিডিয়ার ভূমিকা পঠন-পাঠনে গ্রন্থটিকে আবশ্যক পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলধারার মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে রচিত এটি এক বিশ্লেষণাত্মক ও দৃষ্টি উন্মোচনকারী মৌলিক গ্রন্থ। যা গণমাধ্যমের শ্রেণি-চরিত্র বুঝতে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। একটি গ্রন্থ হয়ে ওঠে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের অনন্য প্রতিষ্ঠান।

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি ও করপোরেট স্বার্থের পক্ষে মিডিয়া কীভাবে দীক্ষায়ন চালায়, তা নিয়ে এক প্রচারণা মডেলের কাঠামো এ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কি। লেখকদ্বয়ের ভাষায়, ‘আমরা এ গ্রন্থে, একটা প্রচারণা মডেলের নকশা এঁকেছি, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার গণমাধ্যম কর্মকা-ের ওপর এর প্রয়োগ ঘটিয়েছি। বহু বছর ধরে মিডিয়ার কর্মতৎপরতা নিয়ে গবেষণার সুবাদে আমাদের যে বিশ্বাস গড়ে ওঠেছে, গ্রন্থে তার প্রতিফলন ঘটেছে; আর বিশ্বাসটি হলো- মিডিয়া সবসময় রাষ্ট্রীয় ও প্রাইভেট কর্মকান্ডে আধিপত্যকারী বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর পক্ষে সমর্থন আদায়ে তৎপরতা চালায়...।’

এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কির বক্তব্য- মিডিয়া যেসব কাজ করে বা সেবা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো, মিডিয়া সমাজে আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির স্বার্থের পক্ষে প্রচারণা চালায়। ক্ষমতাশালীদের স্বার্থের পক্ষে এজেন্ডা তৈরি ও বাস্তবায়ন করে। এ ধরনের স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর জন্য যেমন নীতি আবহের প্রয়োজন, তা নির্মাণে সহায়তা করে। মিডিয়ার এ কর্মতৎপরতা কোনো সহিংস অভিযানের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না। আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী উপযুক্ত চিন্তাশীল জনবল, সাংবাদিক ও সম্পাদক নিয়োগ করে সংবাদমূল্য নির্ধারণে তাদের অগ্রাধিকারগুলো মগজে গেঁথে দেয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নীতি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে। 

গণমাধ্যমের প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণায় ‘মেনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া’ এক অসামান্য সংযুক্তি। মিডিয়াকে দেখার যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লেখকদ্বয় নির্মাণ করেছেন, অর্থাৎ মিডিয়া ব্যবহার করে শক্তিশালী পক্ষ কীভাবে তাদের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে, তা বুঝতে এ গ্রন্থকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বইটি পড়তে গিয়ে বুকে ব্যথা লাগে, তা লাগে একটি বিশেষ কারণে- গণমাধ্যমের প্রারম্ভিক বিকাশের সঙ্গে একটা হলি বা পবিত্র ব্যাপার কাজ করেছে; আর তা ছিল অন্যকে সত্য তথ্য জানানো, অপকর্ম ফাঁস করে দেওয়া, অসংগত না অন্যায্যতা তুলে ধরা। 

অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করতে সভ্যতার ইতিহাসে মিডিয়া এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশিত হয়। গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবীরা বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, প্রশ্ননির্ভর জীবনযাপন করেন, নিয়ত উত্তর খুঁজেন। স্বচ্ছতা ও স্পষ্টিকরণ তাদের বড় কাজ। এমন মূল্যবোধে নিয়ে মিডিয়া খুব সহজে জনগণের কাছাকাছি যেতে পেরেছিল। আস্থা অর্জন করেছিল। গণমাধ্যমের প্রভাব সংক্রান্ত প্রথম দিকের তত্ত্বগুলোতে দেখা যাচ্ছে, গণমাধ্যমে ওপর মানুষের আস্থা ব্যাপক। গণমাধ্যম যা বলে দর্শক-শ্রোতা সহজেই তা বিশ্বাস করেন।

‘ইনভেশন ফ্রম মার্স’ নাটকটি যখন আমেরিকান রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন যে সকল শ্রোতা মাঝামাঝি থেকে নাটকটি শোনা শুরু করেন, তারা ভেবেছিলেন সত্যিই বুঝি মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে আক্রমণ হচ্ছে। সবাই হুড়মুুড় করে প্রাণ বাঁচাতে রাস্তায় নেমে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যে শ্রোতারা বাস্তব পরিস্থিতি উপলদ্ধি করেন। বুঝতে পারেন, এটি মূলত একটি নাটক। পরবর্তীতে ‘গণমাধ্যমের প্রভাব’ সংক্রান্ত অনেক তত্ত্ব আবিষ্কার হয়েছে, যেখানে মিডিয়া ও তার প্রভাবের কার্যকর শর্ত ও বহুমাত্রিক বিষয়গুলো ওঠে এসেছে।

গণমাধ্যমের মৌল চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। মান পরিচিতিকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। যে কথাটি বলতে চাইছি মিডিয়ার পবিত্র বা হলি চরিত্রটি ধীরে ধীরে ভারতীয় ভাষা বিজ্ঞানী কলিম খানের ভাষায় ‘বরাহকরণ’ প্রকল্পের আওতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়ার মৌল জীবনীশক্তি শুষে নেওয়া হয়েছে। মিডিয়াকে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে স্বার্থ, ক্ষমতা ও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে।

এই যে মিডিয়ার মৌল চরিত্রটা চুরি হয়ে গেল, অথবা কে বা কারা এ চরিত্রটা চুরি করলো, কেন চুরি করলো তা গণমাধ্যম গবেষণায় এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ মহামূল্য গ্রন্থটি মার্কিন গণমাধ্যম ব্যবস্থার শ্রেণিচরিত্র ও এটি নিয়ন্ত্রণকারী কুশীলবদের চিনতে সহায়তা করেছে। কীভাবে সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে মিডিয়া প্রকৌশলকে নিপুণভাবে কাজে লাগানো হয়, তা হারম্যান ও চমস্কি উদ্ভাবিত প্রচারণা মডেলে দেখানো হয়েছে। 

চিন্তাকে দূষিত করা, চিন্তার সজীবতা ও স্বকীয়তা ধ্বংস করা বিশেষ ধরনের অপরাধ। ছাঁচবদ্ধ জনমত নির্মাণ নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় কাজ। কারণ এ ব্যবস্থা এক দৃষ্টিভঙ্গি, এক মত, এক চিন্তা নির্মাণে সহায়তা করে। আর এ কাজে মিডিয়াকে লাগানো হচ্ছে সহায়ক শক্তি হিসেবে। এমন ব্যবস্থায় মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণকদের মৌল আদর্শ স্বার্থ এবং পরিষ্কার করে বললে কায়েমি স্বার্থ। ক্ষমতা ও পুঁজির মিশ্রণে মার্কিন গণমাধ্যমে ব্যবস্থা কীভাবে অন্যদের মতামতকে নিজের অনুকূলে আনে বা বানায় তা এ গ্রন্থের সারবত্তা। রাষ্ট্রীয়, রাজনীতিক ও অর্থনীতিক কাঠামো যখন গণমাধ্যমের এমন চরিত্র নির্মাণ করে এবং প্রাধান্যশীল হয়ে ওঠে তখন পাঠক হিসেবে কিছুটা অসহায়বোধ কাজ করে। 

এটি একটি জনপ্রিয় বক্তব্য যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনমত গঠনে গণমাধ্যমের রয়েছে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা। গণমাধ্যম জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরে। সরকারি নীতি পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু দর্শক-শ্রোতাদের সামনে হাজির করে। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি চর্চার জন্য তথ্যসমৃদ্ধ জনসমাজ নির্মাণ অপরিহার্য। এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কি মিডিয়া পরিচালনায় যে প্রচারণা মডেলের ধারণা তুলে ধরেছেন, সেখানে পরিষ্কারভাবে বিবৃত হয়েছে- সমাজের উঁচু শ্রেণি ও অন্যান্য স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কীভাবে এর মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও সমাজের অন্যান্য অক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে জনগণের বিশ্লেষণী ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ক্ষমতাশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে দাঁড়ায়।

এ প্রচারণা মডেলে মিডিয়ার কর্তৃত্ববাদী পরিচালনের কারণে সমাজের এলিট শ্রেণি কী কী সুবিধা অর্জন করে, তাও দেখানো হয়েছে। এ প্রচারণা ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, মিডিয়ার ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়, নিজেদের অনুকূলে বিশেষ ধরনের কোনো মনোভঙ্গি বা আচরণ তৈরিতে মিডিয়াকে কাছে লাগানো অনৈতিক। যদিও পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র, করপোরেশন পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্বার্থবাদী সম্পর্কের কারণে সমাজের কর্তৃত্ববাদী অবস্থা বিরাজ করে। এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা মিডিয়ার এ প্রচারণাধর্মী মডেল খারিজ করে দিয়েছেন। তারা একে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ এবং মিডিয়ার আচরণের ক্ষেত্রে ‘নির্ধারণবাদী’ কৌশল হিসেবে দেখেছেন। মিডিয়া কী সমাজে আধিপত্যবাদী অবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে? এর কী কোনো বৈধ রূপ রয়েছে? এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।

‘মেনুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য ম্যাস মিডিয়া’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে প্যানথন বুকস্ থেকে। পরবর্তীতে ২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে তারা নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে। বইটির মোট সাতটি অধ্যায়- প্রথম অধ্যায়ে প্রচারণা মডেল, যেখানে এ মডেলের মূল কাঠামো তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মূল্যবান ও মূল্যহীন শিকারসমূহ, এ অধ্যায়ের মূল কথা হলো- প্রচারণা সিস্টেম সর্বদা শত্রুরাষ্ট্রের নিষ্পেষিত জনগণকে তুলে ধরে ‘মূল্যবান বলি’ হিসেবে।

অন্যদিকে, নিজ সরকার দ্বারা বন্ধুরাষ্ট্রের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি নিগৃহীতদের তুলে ধরে ‘মূল্যহীন বলি’ হিসেবে। তৃতীয় অধ্যায়ে তৃতীয় বিশে^র অর্থহীন নির্বাচন বনাম বৈধতাকরণ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে. যেখানে দেখানো হয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আধিপত্যশীল মিডিয়া এসব দেশসমূহের নির্বাচনকে কীভাবে হ্যান্ডেল করে। ১৯৮৩ সালে পোপ হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি ও বুলগেরিয়ার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের জন্য মার্কিন মিডিয়ার অসংখ্য বানোয়াট কাহিনী প্রচারের প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে ‘কেজিবি-বুলগেরিয়ার পোপ-হত্যা ষড়যন্ত্র : মুক্তবাজারের যুগে সংবাদ হিসেবে অপতথ্য’ শিরোনামে।

গ্রন্থটির বড় অংশজুড়ে বিস্তৃত পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়- যথাক্রমে ‘ইন্দোচীন (১) : ভিয়েতনাম’ ও ‘ইন্দোচীন যুদ্ধ(২) : লাওস ও কম্বোডিয়া’ শিরোনামে। আর সপ্তম অধ্যায়ে টানা রয়েছে উপসংহার। তিনটি সংযোজনীসহ গ্রন্থটি পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠা বিস্তৃত। 

বইয়ের লেখক এডওয়ার্ড এস হারম্যান পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুলে ফিন্যান্সের অধ্যাপক। ‘করপোরেট কন্ট্রোল এন্ড পাওয়ার’ বিষয়ে তার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশকিছু প্রকাশনা রয়েছে। নোম চমস্কি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভাষাতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের ইস্টিটিউট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। তিমি একজন ভাষা বিজ্ঞানী। তার রয়েছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা, বক্তব্য ও মন্তব্য। তিনি সমকালীন পৃথিবীর অন্যতম পাবলিক ইনটেলেকচুয়াল।


লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //