নব্য স্বৈরশাসকরা যেভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে

গণতন্ত্রের পেছনের দিকে যাত্রা এবং এক ধরনের হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। গণতন্ত্রের পেছনের যাত্রা হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রধান উপাদানগুলোর অবসান কিংবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়সাধন। হাইব্রিড বা দোআঁশলা ব্যবস্থা হলো এমন ব্যবস্থা, যেখানে গণতন্ত্রের কিছু উপাদানের সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনের সংমিশ্রণ এবং কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা করা হয়।

এসব ব্যবস্থা উদ্ভবের ফলে সারাবিশ্বেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। এ ধরনের সরকারগুলোর গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিগত দশকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে খর্ব করছে। ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ফ্রিডম হাউস (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান) উল্লেখ করেছে, বিগত ১৩ বছর গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ক্রমাগত পতনের দিকে যাচ্ছে। এই পতনোন্মুখ পরিস্থিতি দুটি প্রতিষ্ঠানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যার একটি হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়া, অন্যটি গণমাধ্যম।

এ পরিস্থিতিতে যে দেশগুলো কেবল গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, তারাই শুধু নয়; যে দেশগুলো সংগঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, তাদের স্বাধীনতাও ক্রমবর্ধমান বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। বহু দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গণমাধ্যমের প্রতিবন্ধকতাও বেড়েছে। 

অতীতের নির্মম স্বৈরাচারী শাসকরা তথ্যের উৎসের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিত এবং হরণ করতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। যেসব সংবাদ এবং তথ্য স্বৈরশাসকরা বিধ্বংসী হিসেবে বিবেচনা করতেন অথবা ক্ষতিকারক হিসেবে দেখতেন, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগেই সেন্সর করা হতো। আমরা কী জানতে পারছি না, তাও জানতাম না। সেন্সরশিপ ছিল ভোঁতা এবং স্বৈরশাসকরা সেন্সর করছেন- এ বিষয়টা তারা গোপন করতেন না। আমরা পেতাম স্যানিটাইজড ইনফরমেশন বা সুসংবাদ- যা নিছকই প্রচারণা। গণমাধ্যমগুলো অধিকাংশক্ষেত্রেই হতো রাষ্ট্র এবং সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এক কথায়- হিজ মাস্টারস ভয়েস। রাষ্ট্র এবং সরকারের আজ্ঞাবাহী, তল্পীবাহক।

কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অধীনে, রাষ্ট্র গণমাধ্যমের ওপর মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতো। যার ফলে কী প্রচারের অনুমতি দেয়া হবে এবং কী প্রচারের অনুমতি দেয়া হবে না, তা সিদ্ধান্ত নেয়া রাষ্ট্রের পক্ষে সহজতর হতো। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং নব্য স্বৈরশাসকরা নিজেদের ‘গণতন্ত্রবাদী’ জাহির করার আকাক্সক্ষার ফলে পুরনো কায়দায় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

নব্য স্বৈরশাসকরা আবির্ভূত হওয়ার পর এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলোর নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি এবং সমালোচকদের বিচলিত করার নতুন সরঞ্জামগুলো আয়াসসাধ্য হয়ে উঠেছে। 

অবশ্য নব্য স্বৈরশাসকরা সেন্সরশিপের কৌশল ত্যাগ করেননি। তবে সেন্সরশিপের পদ্ধতিটি এখন আগের চেয়ে বেশি পরিশীলিত। নির্বিচারে গণমাধ্যম বন্ধ করা নব্য স্বৈরশাসকদের শেষ পছন্দ। কারণ এটি খারাপ একটি ধারণা দেয়। এতে প্রতীয়মান হয়- শাসকরা বেআইনিভাবে কাজ করেছেন। তার বদলে, নব্য স্বৈরশাসকরা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় এগোতে আগ্রহী। যে দেশগুলো গত দশকে বি-গণতন্ত্রায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তারা গণমাধ্যম এবং তথ্য সম্পর্কিত নতুন নতুন আইনের মুখোমুখি হচ্ছে।

এই আইনগুলো আগের তুলনায় কঠোর, এই আইনগুলোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরো কঠোর। এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টভাবে রাখা হয় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন ইচ্ছামতো আইনগুলো ব্যবহার করতে পারে, সে সুযোগ তৈরি করে দেয়। জনসাধারণকে বলা হয়, এসব আইন নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন আইনগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। ১. সন্ত্রাস বিরোধী; ২. গুজব বিরোধী এবং ৩. সাইবারস্পেসে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা।

২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিশ্ব তথাকথিত গ্লোবাল ওয়ার অন টেররের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তার নামে এই নতুন সন্ত্রাস বিরোধী আইনের পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তু এই আইনের পরিধি এবং প্রকৃতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আকার নিয়েছে। সমযরে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। যারা গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর মোকাবেলার জনপ্রিয় বাহনে সওয়ার হয়েছিলেন, তারা সমালোচকদের স্তব্ধ করতে এই নতুন আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। নজরদারি সম্প্রসারণ, তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’র অন্তর্নিহিত কৌশলগুলো একইসঙ্গে একজন ব্যক্তির চলাফেরা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে গণমাধ্যম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

নতুন আইনে ‘গুজব বিরোধী প্রচারের’ উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও পৃথক আইন করা হযেেছ। এই পথ দেখিয়েছে চীন- ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীন একটি ‘গসিপ’ বা পরচর্চা বিরোধী মানহানির আইন প্রণয়ন করে, যা অনেক দেশেই বিভিন্নভাবে অনুসরণ করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো তার কাজকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, গুজব ছড়ানো এবং ভুয়া সংবাদ প্রচার সমার্থক হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর, ২০১৬ সাল থেকে ভুয়া সংবাদের ধারণাটি মূলধারার আলোচনায় ঠাঁই করে নিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে, অনেক দেশে ভুয়া সংবাদ সম্পর্কিত আইন হয়েছে।

এই নতুন আইনগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দুভাবে প্রভাব ফেলে- প্রথমত, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা শাস্তির হুমকি এবং দ্বিতীয়ত, সেলফ-সেন্সরশিপের পরিবেশ তৈরি। সরকার নিয়মিতভাবে ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং তাদের ‘বেআইনি’ কাজের জন্য শাস্তি দেয়। সাংবাদিকদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়- কোথায় তার সীমারেখা। এটি জবরদস্তির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল প্রভাবক হলো সেলফ-সেন্সরশিপ। যা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। সংজ্ঞা অনুসারে, সেলফ-সেন্সরশিপ সরাসরি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। তবে নিঃসন্দেহে এটি সরকারের পদক্ষেপের ফলাফল। এটি কোনো অনিচ্ছাকৃত পরিণতি নয় বরং নব্য স্বৈরাচারী শাসকদের একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল। এটিকে অনেক প-িতই কৌশলগত নীরবতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটি গণমাধ্যমের অধীনস্ততা নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়।

এই কৌশলগুলো মূলধারার গণমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সম্প্রসারিত হয়। সাইবারস্পেসের ওপর কর্তৃত্ববাদী শাসনকর্তাদের বিশাল নিয়ন্ত্রণকে ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। প্রায়শই, এগুলোকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নামে জায়েজ করা হয়। যার আড়ালে সরকার ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে।

কৌশলগত নীরবতা ও জবরদস্তির প্রক্রিয়া অবলম্বন করার পাশাপাশি নব্য স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের নীতি নিয়ে সমালোচনা সীমাবদ্ধ করার জন্য উদ্ভাবনী পথ খোঁজেন। লুকান ওয়ে এবং স্টিভেন লেভিটস্কি বইয়ে উল্লেখ করেছেন, অনেক দেশে গণমাধ্যমের ওপর শাসকদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা বেসরকারি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়; তবে প্রচ্ছন্ন মালিকানা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং অন্যান্য অবৈধ উপায়ে প্রধান গণমাধ্যমগুলো শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এটি বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী এবং হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থার নতুন প্যাটার্নে পরিণত হয়েছে। আইরিয়া পুয়োসা গত বছরের গোড়ার দিকে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করে, গ্লোবাল আমেরিকান নামের এক সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সরকারি তহবিলে (ভর্তুকি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে) সহানুভূতিশীল গণমাধ্যম পরিচালিত হয়। একই সময়ে স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক মাধ্যমগুলো কাগজ সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ট্যাক্স আইনের চূড়ান্ত প্রয়োগসহ বিভিন্ন ধরণের হুমকির সম্মুখীন হয়।’

অনুগত সমর্থক এবং ব্যবসায়ীদের মিডিয়ার লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়। আর বিরোধী এবং স্বতন্ত্র গণমাধ্যমগুলো যাবতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়। সরকারের সমালোচক গণমাধ্যমগুলো নিস্তব্ধ করতে সরকার-সমর্থিতদের এসব গণমাধ্যমের মালিকানা গ্রহণের উদাহরণ রয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমাবদ্ধ করে, গণমাধ্যমের পরিসরকে গৃহপালিত করে তোলে। শুধু তা-ই নয়, এগুলো রাজনৈতিক আখ্যান বা ডিসকোর্সকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেয়। এই আখ্যানগুলো স্বাধীন গণমাধ্যমের দ্বারা পরিচালিত অনুসন্ধানের বিপরীতে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়, যা সমালোচনামূলক আখ্যানগুলোকে নাকচ করে দেয়। 

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমাগত দুর্বল করার জন্য আরেকটি কৌশল হলো সেন্সরশিপকে ফ্র্যাঞ্চাইজ করা। রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয় এমন ব্যক্তিদের দ্বারা এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়, যাতে গণমাধ্যমগুলো সমালোচনা করতে নিরুৎসাহিত হয়। এই পরিস্থিতিতে সমালোচনামূলক আওয়াজকে আক্রমণ করার সময় কেবল সরকারই নীরব থাকে না, ক্ষমতাসীন দল এবং তার নেতারা প্রায়শই তাদের অনুগতদের প্ররোচিত করে স্বাধীন কণ্ঠস্বর এবং গণমাধ্যমকে আক্রমণ করতে। আইরিয়া পুয়োসাকে তার লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, ভিন্নমতকে অবিরাম আক্রমণ করা হয় এবং উপহাস করা হয়।

ভিন্নমতাবলম্বীদের চরিত্র হনন করা হয়, তাদের মতামতগুলোকে বোকা, উগ্র, অবৈধ এবং অনৈতিক বলে দেখানো হয়। প্রায়শই সাংবাদিকদের চাপ দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় মৌখিক হয়রানি, মানহানি এবং কালিমালেপন। অন্যদিকে, যারা গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের আক্রমণ করেন, তারা দায়মুক্তি ভোগ করেন। 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধে নতুন কর্তৃত্ববাদী ও হাইব্রিড সরকার কর্তৃক গৃহীত কৌশলগুলো ক্রমাগতভাবে বিকশিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে। এগুলো মোকাবেলা করার জন্য এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্যে এই কৌশলগুলো বোঝা আবশ্যক।


লেখক: আলী রীয়াজ।  যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

অনুকৃতি : আরশাদ সিদ্দিকী


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //