জীবনের কথা বলে ভাওয়াইয়া গান

সংগীত মানুষের প্রাচীনতম বিদ্যাগুলোর মধ্যে একটি। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষের মুখে মুখে নানা সুরে নানাভাবে মনের ভাব প্রকাশ করত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এই গানগুলোর আলাদা আলাদা নাম হয়েছে। খুব প্রচলিত একটি কথা-  ‘বাঙালির গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গান’ ছিল।

উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং জেলার সমভূমি অঞ্চল, পশ্চিম দিনাজপুরের উত্তরাংশ আসামের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলার বেশ কিছু অংশে ভাওয়াইয়া গান ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাংলাদেশের লোকসংগীতের মধ্যে ভাওয়াই গান উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে।

ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি নিয়ে অনেক কথাই প্রচলিত।  উত্তরাঞ্চলের অনেক নদী যেমন- তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ক্ষীরখ্যাপা, তোরষা, কালজানি ইত্যাদি অনেক নদী ও উপ-নদীর শাখাগুলো বেশ খরস্রোতা থাকায় নদীভাঙন, চরজেগে ওঠা, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় অনেক নিচু জমি তৈরি হতো। এই নিচু জমিগুলোতে মধুয়া, কাশিয়াসহ নানারকম ঘাস জন্মায়। এই নিচু পলিবেষ্টিত জায়গাগুলোকে বলা হতো ভাওয়া। অত্র অঞ্চলের মইশালরা দল বেঁধে এই ভাওয়া নিচু অঞ্চলে মহিষ চড়াত আর নিজস্ব সুরে নিজস্ব ভাষায়-দড়াজ গলায় মনের মাধুরী মাখা দরদ দিয়ে গান গাইত। এখান থেকেই ভাওয়াইয়া নামের উৎপত্তি। 

আবার অনেকে বলে থাকেন উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে একটা ভাব আছে, আর এই ভাব থেকেই ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন ও এই মতটিকে সমর্থন করেন। অন্য একটি মত হচ্ছে- বাওয়াইয়া শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি। বাওয়া শব্দের অর্থ বাতাস। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে এ অঞ্চলের গানকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে উত্তরাঞ্চলে বাওদিয়া নামে ‘উদাসী’ সম্প্রদায় এ গানের রূপকার বলে অনেকে বাওদিয়া থেকে ভাওদিয়া আর ভাওদিয়া থেকে ভাওয়াইয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করেন।

উৎপত্তির দিক থেকে ভাওয়াইয়া নাম যেভাবেই হোক এ গান উত্তরাঞ্চলীয় মানুষের। এ গান মাটি ও মানুষের গান। এ গানগুলো মানুষের কথা বলে জীবনের কথা বলে। এই গানগুলোর মধ্যে দুঃখ কষ্ট, হাসি-কান্না, নারীর মনের আবেদন, আবেগ অনুভূতি প্রেমের আকুতি সমস্তই মিশে আছে। এই গানগুলো গাইতে অনেক বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। এই গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র দোতারা ও সারিন্দা।

এ ছাড়াও তবলা, ঢোল, বাঁশি ও মন্দিরার প্রচলন আছে। গানের সুর আর বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে এক অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি হয়। সে সময় ট্রেন-বাসের ব্যাপক প্রচলন না থাকায় মানুষ গরুর গাড়ি নৌকা, মহিষের গাড়ি ইত্যাদি যোগে হাট-বাজার, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। স্বামী গরুর গাড়ি নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাইরে গেছে, স্ত্রী বার বার মেঠোপথের দিকে চেয়ে থাকে, কতক্ষণে তার স্বামী বাড়ি ফিরবে। তার মনের আবেগ অনুভূতি দিয়ে গান ধরেন- ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ কত কান্দিম মুঁই নিধুয়া পাথারে রে...।’  

সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের মাঠ, ঘাট, নদী, ইত্যাদি নিয়ে কবি ও লোকগানের গীতিকার নানা ধরনের ভাবের আবির্ভাব ঘটান। ভাব থেকেই গ্রাম্য বধূরা তাদের স্বামীর জন্য মেঠোপথে দুরের বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে স্বামীর উদ্দেশে গেয়ে ওঠেন-  

‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে/ কোন দিন আসিবেন বন্ধু/কয়া যাও কয়া যাও রে। বট বৃক্ষের ছায়া যেমন রে/ মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে...’

ভাওয়াইয়া গানের একটা নিজস্ব ঢং রয়েছে। গানের মধ্যে প্রেমগীতি অনুরাগ ও ভালোবাসার কথা ব্যক্ত হয়। যেমন-  

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কত কান্দিম, মুঁই পন্থের দিকে চাইয়ারে। ওকি মইশালরে ছাড়িয়া না যান মোক/ কাগাশিয়ার ঘরে রে। কোন দ্যাশে যান /মইশাল বন্ধুরে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //