এন্ড্রু কিশোরের জীবনের গল্প

২০১৮ সালের ৪ জুন, হয়ত দিনটি ছিল একটু অন্যরকম। মিরপুরের বাসায় নিজকে মেলে ধরেছিলেন কিংবদন্তী শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তিনি বলছিলেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। আজ তার চলে যাওয়ার দিনে, সেই মুগ্ধতার কিছু অংশ এন্ড্রু কিশোরের নিজের মুখে।

একটু থমকে গেলাম। অবাক হলাম অনেক। এমন মুহূর্ত আসলে কোনো ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। বন্ধুরা মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। গরুর গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। একটু দূরে মোষের পিঠে চড়ে একজন কিশোর ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানটা গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে। এমন গহীন গ্রামে এসে নিজের গাওয়া গান শুনতে পাবো ভাবেননি। আকাশের দিকে তাকালাম। চোখটা চিকচিক করছে। এক বন্ধু পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘তোর জীবন সার্থক। এক জীবনে আর কী চায় মানুষ।’

বিস্ময় আনন্দ আর গভীর ভালোলাগায় চুপ হয়েছিলাম। প্রাণ সজনী ছবির গানটা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে। ধানের আইলে একটা ফিঙ্গে পাখি এসে বসল। একটু দূরে দুটো শালিক- সব যেন অবাক করে দিচ্ছে আমাকে। বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে এতটা অবাক হবো ভাবিনি। এমন ভালোলাগা আজীবন বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়ানো যায়। সেখানেও সুখ রয়েছে। প্রতিজ্ঞা সিনেমার ‘এক চোর যায় চলে, এই মন চুরি করে’ গানটা আমার প্রথম জনপ্রিয়তা পাওয়া গান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর শুধু নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার গল্প। মুকুল চৌধুরীর কথায় আলম খানের সুরে গানটি অসম্ভব রকমের সৌভাগ্য এনে দিয়েছে আমার জীবনে। অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছেন আলম খান আর ‘এক চোর যায় চলে’ গানটা।

দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম হয়। আলম খানের সুরে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কথায় ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানটা গাওয়ার পর সব্যসাচী বললেন, দেখবেন এ গানটার জন্য জাতীয় পুরস্কার থাকবে। হয়েছিলও তাই। গুণীরা হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পান। না হলে এমন করে বলেছিলেন কেন? এরপর ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’ মানুষের প্রিয় গানের তালিকায় নীরবে জায়গা করে নিল। তবে ১৯৮২ সালে বড় ভালো লোক ছিল সিনেমার জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পাওয়া আমার জীবনের একটি বড় ঘটনা। এরপর আটবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি কিন্তু, প্রথম পুরস্কার পাওয়া দিনটার কথা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে বুকের গভীরে। পুরস্কার পাওয়ার আগের দিন সারারাত নির্ঘুম কেটেছিল। একটুও চোখের পাতা এক করতে পারিনি।

এসব অর্জন যখন আমাকে ছুঁয়ে থাকে, তখন বারবার গানের শুরুর কথা মনে হয়। রাজশাহীর বেলদার পাড়ায় আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সংগীত শেখার দিনগুলো ভীষণ করে মনের মাঝে উঁকি দেয়। প্রায় প্রতিদিন যেতাম গান শিখতে। আধুনিক গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্র, নজরুল, লোকগান, দেশাত্মবোধক গান শিখেছি। আব্দুল আজিজ বাচ্চু অনেক যত্ন করে আমাকে গানের তালিম দিয়েছেন। বাচ্চুর কথা ভেসে উঠছে মনের ভেতর। এখন বেঁচে নেই তিনি। কিন্তু, আমার গানের যাত্রার পুরোটা তৈরি করে দিয়েছেন সেই ব্যক্তি।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর আমার জন্ম। তখন কি জানতাম একদিন আমিই হবো বাংলাদেশের ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। হয়তো জানতেন কেউ। মা শিক্ষিকা মিনু বাড়ৈ জানতেন একদিন এন্ড্রু অনেক বড় শিল্পী হবে। কিশোর কুমারের গান খুব পছন্দ করতেন মা। তাই তো ছেলের নামের শেষে কিশোর যোগ করেছিলেন। আজ শ্রোতারা মুগ্ধ হন এন্ড্রু কিশোরের গানে। চার দশক ধরে বেশ দাপটের সঙ্গেই তো গান গেয়ে যাচ্ছি। অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছি। দীর্ঘ আমার গানের তালিকা- আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন, আমার গরুর গাড়িতে, তোমায় দেখলে মনে হয়, পড়ে না চোখের পলক, প্রেমের সমাধি ভেঙে, সবাই তো ভালোবাসা চায়, হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, এত সুখ সইবো কেমন করে, তুমি ছিলে মেঘে ঢাকা চাঁদ, পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমার মাঝে খুঁজে পেয়েছি, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তুমি আজ কথা দিয়েছো, দুঃখ বিনা হয় না সাধনা, এক বিন্দু ভালোবাসা দাও, আশা ছিল মনে মনে, চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পরে। তবে প্রথম প্লেব্যাক করেছিলাম আলম খানের সুরে ১৯৭৭ সালে। মেইল ট্রেন সিনেমায় ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ নামের গান ছিল সেটি।

আলম খানের সঙ্গে আমার অসংখ্য গান হিট হয়েছে। এতটা শ্রোতাপ্রিয় গান আর কেউ উপহার দিতে পারেননি। আলম খান ছাড়াও রয়েছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলী, আনোয়ার পারভেজ ও আনোয়ার জাহান নান্টু। একটু সিনিয়রদের মধ্যে সুবল দাস, সত্য সাহা, আবু তাহের, শেখ সাদী খানের সুরেও গান গেয়েছি। প্রতিটি সুরকার ও সংগীত পরিচালককে শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছি। প্রেম, বিরহ, বিষাদ, হাসি, দেশাত্মবোধক সব ধরনের গান গেয়েছি।

একক কণ্ঠের গানে দর্শকরা যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, দ্বৈত কণ্ঠের গানগুলোও ছিল অনবদ্য। ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’ দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলাম। এমন অসংখ্য দ্বৈত গান আমার কণ্ঠে সুর পেয়েছে। ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, আবিদা সুলতানা, শাম্মী আখতার, শাকিলা জাফর, কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, রিজিয়া পারভীন, বেবী নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী, ফাহমিদা নবী, রোমানা ইসলাম, ন্যান্সি, সালমার সঙ্গে দ্বৈত গান গেয়েছি। এতো এতো কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে দ্বৈত গান একটা ঘটনা বটে।

সিনেমার গানের ‘সম্রাট’ হলেও অডিওর গানে খুব একটা দেখা যায়নি আমাকে। প্লেব্যাক নিয়েই রাত-দিন মেতে থেকেছি। অনেক পরে ‘ভুল সবই ভুল’ নামে একটি অডিও অ্যালবাম করেছিলাম। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে দুটি অডিও অ্যালবাম করেছিলাম। অ্যালবাম দুটির গানগুলো শ্রোতারা গ্রহণ করেছিলেন। তবে সিনেমার গানের মধ্যেই যেন জীবন ছড়িয়ে দিয়েছি। দিন-রাত, ভোর-সন্ধ্যা সবকিছু উৎসর্গ ছিল সিনেমার গানের জন্য। সিনেমার গানে অভিনয় থাকতে হয় এটা শিখেছিলাম অনেকের কাছ থেকে।

দেশের সীমানা মাড়িয়েছিলাম প্রায় ২৮ বছর আগেই। বিখ্যাত সুরকার, সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণের সুরে গান করেছিলাম। ছবির নাম ছিল শত্রু। আর ডি বর্মণ আমাকে আদর করে ঢাকাইয়া বলে ডাকতেন। বোম্বেতে তিনটা বাংলা ও একটা হিন্দি গান গেয়েছিলাম। ‘সুরজ’ নামে হিন্দি গানটা লিখেছিলেন আনন্দ বকসী।

-জাহিদ আকবর, ডেইলি স্টার

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //