কাঠামোগত বর্ণবাদে প্রশ্নবিদ্ধ মার্কিন গণতন্ত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রায় আড়াইশ’ বছর হতে চলল। নিজেদের ‘গণতন্ত্রের ধারক’ হিসেবে দাবি করলেও মার্কিন সমাজে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুদৃঢ় নয়, তা সাম্প্রতিক গণবিদ্রোহ ও সমসাময়িক ঘটনায় আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন হলেও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৮ সালে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার পর এবারের মতো এমন জনরোষ যুক্তরাষ্ট্রে আর দেখা যায়নি। 

কার্যত এ বিদ্রোহ মার্কিন রাষ্ট্র কাঠামোর মূলে আঘাত করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক চেতনাকে- যেখানে আজও ছড়িয়ে আছে দাসপ্রথা ও বর্ণবাদের অবশেষ, জাতিগত বিদ্বেষ ও তীব্র শ্রেণি বৈষম্য; সেখানে গণতন্ত্র কতটুকু সমন্বিত থাকতে পারে? 

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচকরা এ গণবিদ্রোহের নামকরণ করেছে- ‘আমেরিকান স্প্রিং’ বা আমেরিকান বসন্ত। 

গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড সিগারেট কিনছিলেন; তিনি জাল নোট ব্যবহার করছিলেন কিনা তা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ তাকে আটক করে। এক ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গ্রেফতার করছেন এবং তখন ফ্লয়েডকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন বেশ কয়েক মিনিট ধরে তার হাঁটু দিয়ে ফ্লয়েডের ঘাড় চেপে ধরে আছেন। ফ্লয়েড বারবার কাতরাতে কাতরাতে বলছিলেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ 

ওই ভিডিও ছড়িয়ে পডার পর থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও। সম্প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি জোর পেয়েছে হত্যাবিরোধী আন্দোলনও।

কাঠামোগত ‘ডবল স্ট্যান্ডার্ড’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চোখে আইনের প্রয়োগ সবার জন্য একইরকম নয়- গায়ের রঙ, ধর্ম, জাতি বা শ্রেণিগত পরিচয়ে তা পরিবর্তিত হয়। যখন একটি সশস্ত্র শ্বেতাঙ্গ মিলিশিয়া গ্রুপ মিশিগান রাজ্যে লকডাউন উঠিয়ে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করে, তখন ট্রাম্পের মতে ‘তারা ভালো মানুষ’। অথচ যখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে কৃষ্ণাঙ্গদের বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদে, তখন ট্রাম্প তাদের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী’, ‘লুটপাটকারী’ দেখতে পান। তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নামাতেও প্রস্তুত!

এ বিষয়টি নতুন কিছু নয়। নির্বাচনী বা বিচারিক কাঠামোতে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গরা আন্দোলন করে আসছেন। তবে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকার সময়েও কালো মানুষদের হত্যার প্রতিবাদে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। তখনো তাদের ‘লুটপাটকারী’, ‘দাঙ্গাবাজ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন রাষ্ট্রের পদস্থ কর্মকর্তারা। 

সেই সাথে কালোদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে আরো বেশি নজরদারি, নিযুক্ত করা হয়েছে আরো বেশি পুলিশ সদস্য, সেই সাথে বেড়েছে অশ্বেতাঙ্গদের ‘সংঘবদ্ধ অপরাধী’ হিসেবে দেখানো। যা শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিচয়ের ওপর নির্ভর করবে কে, কতটুকু নির্ভয়ে ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশ করতে পারবে- এটিই আজকের দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মত প্রকাশের মানদণ্ড। ক্ষুব্ধ সশস্ত্র শ্বেতাঙ্গরা সেখানে ‘ভালো মানুষ’ খেতাব পায়, আর নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীরা হয়ে যান ‘উগ্রবাদী’, ‘লুটপাটকারী’, ‘দাঙ্গাবাজ’! 

উল্লেখ্য মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহতদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা চার গুণ বেশি।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের তুলনা করছেন অনেকেই। এ দুই রিপাবলিকান নেতার তুলনা আসাটা খুবই স্বাভাবিক। নিক্সনের মতো ট্রাম্পও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ধারণা সামনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা কুড়িয়েছেন। নিক্সনের মতো ট্রাম্পও মনে করেন, আইন শুধু অশ্বেতাঙ্গদের ওপরই প্রয়োগ করা উচিত। তবে নিক্সন এত ভিতু ছিলেন না যে, আন্দোলনের ভয়ে বাঙ্কারে ঢুকে পড়বেন। বরং ট্রাম্পের মতো আন্দোলনকারীদের কাঁদানে গ্যাস দিয়ে ছত্রভঙ্গ না করে, তিনি ওই সময়ে আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেছেন, যদিও তাতে নিজের বর্ণবাদী অবস্থান থেকে সরে আসেননি নিক্সন। 

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য আর দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি। এর মধ্যে ৭২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ, আর ১৪ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। বছর শেষে নির্বাচন; তাই ভোটের রাজনীতিতে জিততে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ধারণাকে আরো সক্রিয় করে তুলছেন ট্রাম্প।

তবে আজকের যুক্তরাষ্ট্র তার ভেতরের ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে ধুঁকছে। যার ফলে দেশটিতে হাঙ্গেরির মতো ‘এক পার্টি, এক ব্যক্তি’র শাসন ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে ব্যাপকভাবে। সত্তরের দশকে নিক্সনের বিপরীতে শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল। সেই সাথে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও তার বিরোধী মতাবলম্বীদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন- ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান খুবই নড়বড়ে, আর রিপাবলিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের উস্কানিমূলক বক্তব্যের জবাব দেয়ার মতো ক্ষমতাও কারও নেই। 

এ বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়েছে শপথ ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত ফায়দা নেয়ার অভিযোগে ট্রাম্পের অভিসংশন প্রস্তাবে রিপাবলিকান পার্টির অন্ধভাবে তাকে সমর্থনের সময়ে। অথচ নিক্সন দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুত হয়েছিলেন, যেখানে দলীয় সতীর্থরাও তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। 

এ প্রসঙ্গে কলামিস্ট ও নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পল ক্রুগম্যান বলেন, ‘আজ ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকতে সামরিক অভ্যুত্থান করলেও তাতে বাধা দেবে না রিপাবলিকানরা। বরং তারা এটি উদযাপন করবে।’

বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক ও শ্রেণিগত বৈষম্য

হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন মিশেল এ উইলিয়ামস বলেন, ‘গণস্বাস্থ্য সংকটেও বর্ণবাদ কোনো অংশে কম যায় না। এই বাস্তবতা শুধু পুলিশি নির্যাতনেই দেখা যায় না, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করা হচ্ছে দেদার; বরং দাস প্রথা ও বিভক্তির অবশেষ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, যা সামাজিকভাবে স্বাস্থ্য সেবার অধিকার নির্ধারণ করে। ঐতিহাসিকভাবে যে অধিকারের জন্য কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা যুদ্ধ করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন; বর্ণবাদ সেই অধিকার তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন এই বাস্তবতা প্রকাশিত হয় অসংখ্য উপায়ে- স্কুলের অপ্রতুল তহবিল থেকে নখ-দন্তহীন স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক কর্মসূচি, আর্থিক অসঙ্গতি, গণ-গ্রেফতার, পুলিশি নির্যাতন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। আর এগুলো নিশ্চিতভাবেই তাদের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যার ফলে সময়ের আগেই অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুবরণ করছেন।’

কয়েকদিন আগে পেডিয়াট্রিক ইনফেকশিয়াস ডিজিজ সোসাইটি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কাঠামোগত বর্ণবাদ কভিড-১৯ এর মতো সংক্রমক রোগের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।’ 

কাঠামোগত বা রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদ খুব সহসাই ভাইরাল হয়ে যায় না, তবে এটি ভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর। সম্প্রতি মেহারি মেডিক্যাল কলেজের এক গবেষণায় দেখা যায়, জ্বর, শুকনো কাশির মতো কভিড-১৯ লক্ষণ থাকা শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয় শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭২.৯ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ নিজের ঘরে থাকেন, যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই হার ৪৩.৫ শতাংশ। শ্বেতাঙ্গ শিশুদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি। 

’৬০-এর দশকে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের বেকারত্বের হার ছিল ২ থেকে ২.৫ গুণ বেশি। ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৬.২ শতাংশ হলেও কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই হার ১১.৪ শতাংশ, আর শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ। রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামোগত বৈষম্যের কারণে সব নাগরিকের অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন নীতিতে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নেই। 

গবেষক রিচার্ড রথস্টেইন উনিশ ও বিশ শতকে কেন্দ্রীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ের মার্কিন সরকারগুলো দ্বারা গৃহীত জননীতিকে এ বৈষম্যের জন্য দায়ী করেন। তার মতে, এসব জননীতি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সামাজিক বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ফলে বর্ণ-বিভাজন ও বৈষম্য প্রজন্মগতভাবে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব রেখেছে। 

রিচার্ড রথস্টেইন সেন্ট লুইস শহরের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে সরকারিভাবে গৃহীত উন্নয়ন নীতিমালা অনুযায়ী শহরটিকে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত আলাদা আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। যেখানে শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলকে আবাসিক এলাকা এবং কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলকে বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকার বাইরে কেন্দ্রীয় সরকার ভর্তুকিও দিয়েছে। 

সমাজবিজ্ঞানী অরল্যান্ডো প্যাটারসনের মতে, শ্বেতাঙ্গরা আগের চেয়ে প্রগতিশীল চিন্তা ধারণ করলেও, তারা প্রায়ই এমন জননীতি সমর্থন করেন, যা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য অসুবিধাপূর্ণ। যেমন- তারা কোনো উপশহরে বিভিন্ন পরিসরের হাউজিং সমর্থন করবেন না; এর ফলে সাশ্রয়ী মূল্যের ঘরের সংখ্যা যেমন কমে আসে, তেমনি সামাজিক বিভক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। অথবা তারা হয়তো একটি ভঙ্গুর স্থানীয় তহবিল পুনরায় গড়ে তুলবেন, যা সমাজের ওপর তলার সুবিধাপ্রাপ্তদের জন্যই স্কুল গড়ে তুলবে, কালো সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //