সিয়াটলে আন্দোলনকারীদের ‘মুক্তাঞ্চল’

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পর গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাঝেই গত ৮ জুন সিয়াটলে দেখা গেল এক অভাবনীয় চিত্র। 

বিক্ষোভকারীরা শহরের একাংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেন, যেখান থেকে পুলিশ বাহিনী সরে গেছে। আন্দোলনকারীরা ওই এলাকার নাম দিয়েছেন ‘ক্যাপিটল হিল মুক্তাঞ্চল’। গতানুগতিক পুলিশ বাহিনী ছাড়াও যে একটি সমাজ চলতে পারে, সে কথাই যেন বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিল ওই ‘মুক্তাঞ্চল’!

আন্দোলনকারীদের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে পরিত্যক্ত পুলিশ স্টেশনটি। সেখানে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে লাল অক্ষরে বড় একটি ব্যানারে লেখা ‘এই জায়গাটি এখন সিয়াটলের জনগণের সম্পত্তি’। গত ৮ জুন কাঠামোগত বর্ণবাদ বন্ধে পুলিশ বিভাগ সংস্কার করার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরে আন্দোলনকারীদের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাঁধে সিয়াটল পুলিশের। টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়েও আন্দোলনকারীদের দমানো যায়নি। এক পর্যায়ে হাজারো আন্দোলনকারী একত্রিত হয়ে পুলিশের একটি ভবন দখল করে নেন। তীব্র সংঘর্ষ এড়াতে সিয়াটলের পূর্বাঞ্চলে পুলিশ দফতর থেকে সরে আসেন পুলিশ সদস্যরা। আন্দোলনকারীরা ছয়টি আবাসিক ব্লক নিয়ে মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলেন। পুলিশের একটি ভবনে ‘সিয়াটল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট’ এর জায়গায় লেখা হয় ‘সিয়াটল পিপল ডিপার্টমেন্ট’।

ওই ‘মুক্তাঞ্চল’ নিয়ে উগ্র-ডানপন্থী প্রচারণায় ব্যাপক মিথ্যাচার করা হলেও, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে উঠে আসে এক ভিন্ন চিত্র। কয়েক হাজার মানুষ সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হয়েছেন। চালু রয়েছে আংশিক কমিউন ব্যবস্থা। রাস্তার ধারেই একটি বক্তব্য রাখার স্থান করা হয়েছে কনভারসেশন ক্যাফে, যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী ও পুলিশমুক্ত এলাকা গঠন নিয়ে যে কেউ মতামত রাখতে পারেন। 

বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে, চলছে গানের অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, কমিউনিটি বাগান, রাতে দেখানো হয় প্রতিবাদী, প্রগতিশীল চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বেচ্ছাসেবীরা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই টহল দিচ্ছেন পুরো এলাকা।

৩০ বছর বয়সী লিসা ম্যাকক্যালিস্টার বলেন, ‘এই মুক্তাঞ্চল এক অসাধারণ ঘটনা। সহিংসতাপূর্ণ একটি অঞ্চলকে নতুন করে চেনা। রাত সাড়ে ১২টা থেকে শুরু করে কয়েক ঘণ্টা ধরে পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে, দমন চালিয়েছে। এরপর আন্দোলনকারীরা এখানকার দখল নিয়ে শান্তি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করেন।’

গত ১১ জুন সকালে ওমারি সলিসবারি নামের এক সাংবাদিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজকে জানান, এখানকার পরিবেশ একেবারে ব্লক পার্টির মতো। কেউ ফ্রিসবি খেলছেন, কেউ সরাসরি গানের অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন, আবার কেউ কেউ তথ্যচিত্র প্রদর্শনীতে ব্যস্ত, আবার কেউ রাস্তার মাঝখানে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ লিখেছেন।

কোর্টনি ব্লডগেট নামের এক কনসালট্যান্ট জানান, ‘মুক্তাঞ্চল মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার মতো। এখানকার মানুষ বন্ধুসুলভ, শান্ত, সহযোগিতাপূর্ণ ও অনুপ্রাণিত। আমি অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি- কীভাবে আমরা সহযোগিতা করতে পারি? কীভাবে খাবার দিতে পারি? অন্য কিছু করার আছে কী? ন্যায়বিচারের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নিয়েও আলোচনা শুনেছি। মানুষ জর্জ ফ্লয়েড, ব্রিওনা টেইলরসহ পুলিশের হাতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।’

এদিকে সিয়াটলের ‘মুক্তাঞ্চল’ থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে গত ১১ জুন ট্রাম্প একের পর এক টুইট করেন। আন্দোলনকারীদের ‘স্থানীয় সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষের প্রতি এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, ‘এখনই আপনাদের শহর নিয়ন্ত্রণে নিন। যদি আপনারা সেটি না পারেন, তবে আমিই তা করে দেখাব।’ 

আরেক টুইটে ট্রাম্প বলেন, ‘ওয়াশিংটনের উগ্র বামপন্থী গভর্নর জে ইন্সলি ও সিয়াটলের মেয়রকে উপহাস করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা সিয়াটল দখলে নিয়েছে, যা আমাদের এই দেশ আগে কখনো দেখেনি। এটি কোনো খেলা নয়। এই কুৎসিত এনার্কিস্টদের এখনই থামাতে হবে।’

পাল্টা একটি টুইট করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ওয়াশিংটন গভর্নর। তিনি লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি শাসনব্যবস্থা চালাতে পুরোপুরিই অক্ষম, তার ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।’ 

ট্রাম্পের এসব টুইটের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা টুইট করেছেন সিয়াটলের মেয়র জেনি ডুরকানও। এক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সবাইকে নিরাপদে থাকতে দিন। আপনি নিজের বাঙ্কারে ফিরে যান।’ 

উল্লেখ্য সম্প্রতি হোয়াইট হাউস এলাকায় বিক্ষোভ চলার সময় সিক্রেট সার্ভিসের সহায়তায় হোয়াইট হাউসের ভেতরে একটি গোপন বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলেন ট্রাম্প।

এদিকে আন্দোলনকারীরা বেশকিছু দাবি উত্থাপন করেছেন। এর মধ্যে তিনটি প্রধান দাবি হলো- পুলিশ বিভাগে আর্থিক বরাদ্দ কমানো, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও সেবা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে আনা আইনি অভিযোগ খারিজ করা। 

সিয়াটল অধিবাসী লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট শন স্কট বলেন, ‘এ মুহূর্তে সিয়াটলের আন্দোলনকারী তিনটি প্রধান দাবির সাথে পুলিশ বিভাগ বিলুপ্ত করার সুস্পষ্ট দাবিও জানাচ্ছেন, যা সিয়াটলের আন্দোলনকে পৃথকভাবে গুরুত্ব প্রদান করে।’

সিয়াটল আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে আলোচনায় আছেন রাজ সিমোন নামের এক র‌্যাপার। তাকে উগ্র-ডানপন্থীরা ‘যুদ্ধবাজ’, ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করছেন। তবে ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারভিত্তিক এক নিবন্ধে উঠে আসে বন্ধুবৎসল, বুদ্ধিদীপ্ত, উদারমনা সিমোনের এক প্রতিকৃতি; যিনি নিজেকে নেতা বলতেও রাজি নন। এ আন্দোলনের আগেও তিনি বর্ণবাদ ও বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাই সিমোন সহজেই এবারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

সিমোন পুলিশের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন না। তবে পুলিশ কেন দরকার তা নির্দিষ্ট করার দাবি তোলেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ দরকার মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য। এজন্য নতুন এক কাঠামো দরকার, যা প্রকৃত অর্থেই জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকবে। সামরিক বাহিনীর মতো অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণে গড়ে তোলা কোনো পুলিশ বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা আমাদের নেই। আর এজন্য আমাদের যথাযথ ব্যবস্থা, নীতি ও কার্যপ্রক্রিয়া দরকার।’

সিমোনের মতে, ‘আন্দোলনকারীরা কমিউন বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই আরেকটি বিচ্ছিন্ন দেশ গঠনের লক্ষ্যে এখানে যুক্ত হননি। যা গড়ে উঠেছে, সেটি নিজ থেকে সহজাতভাবেই হয়েছে। আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি স্বশাসিত এক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণ নিজেই সরকার, নিজেই পুলিশ, নিজেই নিজেকে টেকসই করে গড়ে তুলছে। এ ব্যবস্থা অন্যান্য জায়গার জন্যও একটি মডেল হতে পারে। এখানে সবার উদ্দেশ্য একইরকম নয়, আন্দোলনকারীদের মতাদর্শিক অবস্থানে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এটি সবাইকে নিজের কথাটা বলার সমান সুযোগ দেয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম।’ সিমোন নিজেকে ‘আন্দোলনকারীদের আওয়াজের প্রতিধ্বনি’ বলে উল্লেখ করেন, যে আওয়াজ সবসময় শোনা যায় না।

গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড সিগারেট কিনছিলেন; তিনি জাল নোট ব্যবহার করছিলেন কিনা তা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ তাকে আটক করে। এক ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন তাকে গ্রেফতার করছেন ও মাটিতে শুইয়ে ফেলে বেশ কয়েক মিনিট ধরে তার হাঁটু দিয়ে ফ্লয়েডের ঘাড় চেপে ধরে আছেন। ফ্লয়েড বারবার কাতরাতে কাতরাতে বলছিলেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ 

ওই ভিডিও ছড়িয়ে পডার পর থেকেই শুরু হয় বিক্ষোভ, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও শুরু হয় বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //