পেঁয়াজ

সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে আশির দশকের প্রথম কয় মাস তিতুমীর কলেজে শিক্ষকতা করছিলাম। সে সময়ে শিক্ষকতা পেশায় বেশ কিছু প্রতিভাবান শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। তাদেরই একজন ইংরেজি বিভাগের শামসুল হক সাহেব। তার স্ত্রীও সরকারি কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক। থাকতেন বনানীর সরকারি বাড়িতে। একদিন ক্লাস থেকে এসে স্টাফ রুমে বসে আছি পরবর্তী ক্লাসের অপেক্ষায়। দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণের আধাপাকা ঘন কোঁকড়া চুল মাথায়, একহারা গড়নের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। হাতে হাডবোর্ডে বাঁধাই করা একটি বই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে বইটি খুলে আমাকে দেখালেন। না, কোনো ছাপা বই নয়। টাইপ রাইটারে টাইপ করা বাঁধাই করা পরিমিত সাইজের একটি বই। বললেন - ‘সর্বক্ষণ পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, চাল, ডালের দাম নিয়ে মাথা ঘামাতেই আমাদের সময় যায়। কোনো কিছু লেখার বা উচ্চচিন্তা, উচ্চভাব মাথায় ঢোকার সুযোগ কোথায়? এরই মধ্যে এটি টাইপ রাইটারে লিখে বাঁধাই করেছি। একটু দেখুন’। বইটি হাতে নিলাম। ইরেজিতেই লিখেছেন। বললেন- ‘ভাবছি চেষ্টা চালিয়ে যাব। শুরু করেছি’। এর কিছুদিন পর ঢাকা কলেজে চলে এসেছি। তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বইগুলো ছেপেছেন কিনা জানি না।

ম্যাক্সিম গোর্কির প্রথম জীবন দারিদ্র্যক্লিষ্ট ছিল। তেমনি বিজ্ঞানী আলভা অ্যাডিশনের। এমন আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সারাটা জীবনই তেমন ছিল। পরাধীন ভারতে ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় চির দুঃখী নজরুল লিখেছেন ‘বড় কথা বড় ভাব আসে না’ক মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে,/অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে’। দেশ ও সমাজের পরিবেশ পরিস্থিতিও মানুষের চিন্তা জগতে প্রভাব ফেলে। সুখে থাকা প্রজার খাজনাভোগী জমিদার কবি রবি ঠাকুর অমরত্বের অভিলাষে এক ঠেলাগাড়ি লিখেছেন। দুঃখ-দৈন্যে জীবন টেনে টেনে চলা অমর নজরুল তত লিখতে পারেননি। তার জীবন ও লেখা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মনকে স্পর্শ করে গেছে। মহৎ নজরুলকে ‘সর্বক্ষণ পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, চাল, ডালের দাম নিয়ে মাথা’ ঘামানোর পরও তাকে আমরা সাধারণ লোকের মতো জীবন পার করাতে বাধ্য করতে পারিনি।

সেই ব্রিটিশ ভারতেরই আর এক লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পত্রে লিখেছিলেন ‘বেগুনের দাম এক পয়সা বাড়িল। লোকে বাঁচিবে কেমন করিয়া’। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণের সম্পর্ক এ কথাটি বিভূতি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে পেঁয়াজের কেজি শত টাকার ঊর্ধ্বে উঠেছে। অপরাপর নিত্যপণ্যের দামও এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শামসুল হক সাহেবের ভাষায়, ‘সর্বক্ষণ পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, চাল, ডালের দাম নিয়ে মাথা ঘামাতেই আমাদের সময় যায়’। রাষ্ট্রের ভালোমন্দ দিক নিয়ে সাধারণের ভাবার সময় ও সুযোগ কোথায়? নিজের জৈবিক অস্তিত্ব রক্ষায় লোকজন এতটাই ব্যস্ত যে আয় উপার্জনের ভালোমন্দ দিক বিবেচনা করার নৈতিক মূল্যবোধও মানুষের লোপ পেতে বসেছে। অথচ সমাজের উচ্চ পর্যায়ে এমন একটি অবস্থা বিরাজমান যে তা প্রাচীন রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের ‘অভিজাত’ শ্রেণির ধন-ঐশ্বর্য আহরণের দুর্মর প্রতিযোগিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এতে করে নানা কিসিমের দুর্নীতি সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।

এই প্রক্রিয়ায় স্বাধীন দেশে ব্রিটিশরাজের মতো লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। তাই সমাজের একটি শ্রেণির কাছে ‘পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, চাল, ডালের দাম’ যাই হোক তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না এবং তাদের এ ‘নিয়ে মাথা ঘামাতে’ হয় না বলে কেবলই এই চিন্তায় তাদের ‘সময় যায়’ না। এরা নিশ্চিন্তে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় আর নিত্যপণ্য যেমন পেঁয়াজ, বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস ইত্যাদির দাম ও দুর্নীতি নিয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে সময় কাটায়। দেশের লুটেরাদের কাছে এ এক মজার খেলা। যেন এরা ধোয় তুলসী পাতা এবং সর্বান্তকরণে জনদরদি। এদের উদ্দেশ্য করেই হয়তো লোক-গায়করা গেয়েছেন ‘ও আমার দরদি, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’। ভাঙা নৌকার পানি দিয়ে সরবত বানিয়ে সাধারণ মানুষ পান করতে পারে না বা জানে না বলেই তাদের এই হাহাকার। যারা পারে তারা অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো ট্রাকভর্তি, গুদামভর্তি, দোকানভর্তি বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ সাজিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে মুনাফা লুটে কোটি কোটি টাকা আয় করে। এই তো সেদিন (০৪ নভেম্বর ২০১৯) দৈনিক নয়া দিগন্তে দেখলাম পেঁয়াজের এ দুর্র্মূল্যের দিনেও ‘চার মাসে ৩২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পেঁয়াজ সিন্ডিকেট’। সাধারণের কাছে পেঁয়াজের ঝাঁজ, কাঁচা মরিচের ঝাল যত বাড়ে তাদের তত মজা। তাই সাধারণের ‘বড় কথা বড় ভাব আসেনাক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে’। পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণকে বিপাকে ফেলে জনগণের চিন্তা চেতনা ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ পর্যায়ে রেখে এরা মজা লুটে। একেই বলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার।

জনহিতেই মানুষ দলবেঁধে রাজনীতি করে। এর ব্যত্যয় হলে রাজনীতিকরা স্বার্থপর বলে চিহ্নিত হন। দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির ক্ষেত্রেও সরকার বা সরকারি দল বিরোধীদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যে জনহিতের কথা ভুলে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ চিৎকারের ঘেরাটোপের মধ্যেই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আটকে যায়। রাজনীতিকরা তখন বাধ্য হয়ে দেশের কথা ভুলে নিজেদের অস্তিত্বের কথাই বেশি ভাবে। আমাদের দেশে সরকার বিরোধী দলগুলোকে সেই পর্যায়েই নিয়ে গেছে। ফলে তারা দেশের কথা মাথা থেকে মুছে কেবল নিজেদের কথাই ভাবছে। উদাহরণ স্বরূপ নিকট অতীতের ১/১১-এর এবং বর্তমান সরকারের আচরণের কথা উল্লেখ করা যায়। ১/১১-এর সরকার দেশের বৃহৎ দুই দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দুই শীর্ষ নেতাকেই শুধু জেলে পুরেনি একই সঙ্গে এই দুই দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের দেশ সেবার নাম ভুলিয়ে দিয়েছিল। উভয় দলই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ চিৎকারে।

এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নিজেদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে বিএনপির নেতা কর্মীদের মামলাগুলো শুধু যে রেখে দিয়েছে তাই নয় বরং আরও অনেক মামলা দিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নাস্তানাবুদ করে দেশ সেবার নাম প্রায় ভুলিয়েছে। এখন বিএনপির মূল দাবি হলো তাদের দলনেত্রীর কারামুক্তি, মৌলিক দাবি। ক্ষমতাসীনরা যে দেশ লুট করছে সেটাও বিরোধীরা বলে। তবে আপাতত সেটা অভিযোগের পর্যায়েই আছে। এর বেশি কিছু তাদের করার নেই। ব্রিটিশ ভারত বা পকিস্তান আমলেও বিরোধী নেতারা রাজবন্দি বলে বিবেচিত হতো এবং সেভাবেই তাদের বন্দি করা হতো। এখন বিরোধীদের বন্দি করা হয় ‘ক্রিমিনাল’ হিসেবে। বিষয়টা তাই এখন জটিল আকার ধারণ করেছে।

আমি তো নিত্যপণ্যের বিশেষত পেঁয়াজের দাম নিয়ে এ নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম, রাজনীতির অবতারণা করলাম কেন তা বলি। মানুষ যত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কাজে নামুক না কেন, পথের কাঁটা এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে যে তখন ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী নচিকেতার মতো বলতে বাধ্য হয় ‘হাজার কবিতা/বেকার সবই তা/তার কথা/কেউ বলে না’। সে আমার সহকর্মী শামসুল হক সাহেবের কথাই হোক, দেশপ্রেমীদের কথাই হোক বা নচিকেতার প্রেয়সী নীলাঞ্জনার কথাই হোক। ‘অভাব এসে যখন দুয়ারে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’-পেঁয়াজের ঝাঁজ যেমন চোখে পানি আনে, তেমনি ব্যর্থতার বেদনার ঝাঁজও চোখে পানি আনে। তাই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ও কিছুটা গাইতে হলো।

লেখক: অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //