আমাদের কালের নিয়তি

এখন হইতে দুই বছর আগে আ ফ ম মাহবুবুল হক পরলোকে গিয়াছেন। দেশে তাঁহার কবর হয় নাই। হইয়াছে কানাডা নামক বিদেশে। ফলে তাঁহার জানাজায় যেমন শরিক হইতে পারি নাই তেমনি কবর জিয়ারত করিবার সুযোগও পাই নাই। সময়ের স্বল্পতাহেতু এই নিবন্ধে যাহা বলিব তাহাও সংক্ষেপেই বলিতে হইবে। দুঃখের মধ্যে, জীবদ্দশায়ও আ ফ ম মাহবুবুল হককে খুব কাছ হইতে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। তাঁহার বিষয়ে যাহা জানি তাহা অনেকটা দূর হইতে।

কাছে দাঁড়াইয়া দেখিবার আগেই-বহু আগে তাঁহার নাম শুনিয়াছিলাম এবং শুনিয়া কৃতার্থ হইয়াছিলাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হইয়াছিলেন আর দেশে ফিরিয়া ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে যাঁহারা গণতন্ত্রের পতাকা হাতে দণ্ডয়মান হইলেন তাঁহাদের দলভুক্ত হইয়াছিলেন। শুনিয়াছি, এই দুই সংগ্রামেই- যথাক্রমে স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে- তিনি বীরের ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন।

স্বাধীনতা সংগ্রাম এক প্রকার সফল হইয়াছিল কিন্তু গণতন্ত্রের সংগ্রামে তিনি বিজয়ী হইতে পারেন নাই। এই দ্বিতীয় সংগ্রামকে তিনি নিজে (এবং আরও অনেকে) ভুল করিয়া ‘সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম’ বলিয়া প্রচার করিতেন। ফলে গণতন্ত্রের সংগ্রামও পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিল। তাঁহার রাজনৈতিক জীবনের মূল্য যাঁহারা মাপিতে চাহিবেন তাঁহাদের সম্মুখে এই প্রস্তাবটি তুলিয়া ধরা আমার কর্তব্য বলিয়াই এই লেখায় হাত দিয়াছি।

দেশ স্বাধীন হইবার পর যাঁহারা ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ গঠন করিয়াছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হকও তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন। আমার এখনো মনে হয় নিজেদের রাজনৈতিক দলের জন্য এমন একটি নাম তাঁহারা কেমন করিয়া বাছিয়াছিলেন তাহা পরিষ্কার নয়। এই নামের পেছনে যে বড় একটা কলঙ্ক জড়িত ছিল তাহা তো ইতিহাসের সামান্যতম ছাত্রেরও অজানা থাকার কথা ছিল না। আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবি আমরা হয়তো এই পথেই বার বার ঠকিয়াছিলাম। 

এই দলটি যখন ভাঙ্গিয়া দুই টুকরা হইল তখন মনে হইল অন্তত দ্বিতীয় অংশটির বোধোদয় হইয়াছে। তাঁহারা দলের নাম পরিবর্তন করিয়াছিলেন। এই পরিবর্তিত নামের দলটিও যখন ভাঙ্গিল তখন আ ফ ম মাহবুবুল হক দ্বিতীয় টুকরার নেতা হইলেন। আর নাম পরিবর্তনের আবশ্যক বোধ করিলেন না তিনি। তাঁহার অংশেও ‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল’ নামই জারি রহিল।

এই অবস্থায় তিনি একদিন অজ্ঞাতনামা শত্রুদের হাতে আক্রান্ত হইলেন এবং সেই আক্রমণের আঘাত হইতে শেষ পর্যন্ত তিনি আর সারিয়া উঠিতে পারিলেন না। আর তাঁহাকে কাহারা এহেন নিষ্ঠুর আঘাত করিলেন তাহাদের পরিচয় আজও নির্ণয় করা হয় নাই। আর কিছুদিন পরে আ ফ ম মাহবুবুল হকও একদিন নীরবে দেশ ছাড়িলেন এবং সেই যাত্রাই তাঁহার শেষযাত্রা হইল।

আ ফ ম মাহবুবুল হক যে ধরনের সামাজিক পটভূমি হইতে ঢাকায় আসিয়াছিলেন- এক দশক মতো পেছনে পেছনে- আমিও রাজনগরে আসিয়াছিলাম সে ধরনের পটভূমি হইতেই। তাই তাঁহার মনের বেদনা হয়তো কিছুটা বুঝিতে পারি বলিয়া মনে করিতেছি। কিন্তু সঙ্গে ইহাও স্বীকার করি কোন দুইজন মানুষের একজন হুবহু আরজনের কপি বা নকল হয় না।

কোন কোন মানুষ আছেন যাহাদিগকে আমরা বলি ‘কালের নায়ক’। আ ফ ম মাহবুবুল হক ‘কালের নায়ক’ হইবার মতন অনেক যোগ্যতা লইয়া জন্মাইয়াছিলেন, কিন্তু কাল তাঁহাকে সেই সুযোগ দেয় নাই। কিন্তু তিনি কালের প্রহারে ভাঙিয়াও পড়েন নাই। তাঁহাকে যতদূর দেখিয়াছি বা যতদূর বুঝিয়াছি তাহার জোরে বলিব যদিবা ভাঙ্গিয়াও থাকেন, তিনি কদাচ মচকাইয়া যান নাই। তিনি ধ্বংস হইয়াছেন, কিন্তু পরাভব স্বীকার করেন নাই। তাঁহার সংগ্রাম সেই অর্থে সার্থক সংগ্রাম।

আ ফ ম মাহবুবুল হক যে সমাজ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছিলেন সে সমাজ ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষক সমাজ। এই সমাজের নেতারাই ১৯৪৭ সালে পরম বিশ্বাসে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হইয়াছিলেন। সেই বিশ্বাস তাঁহারা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করিতে পারেন নাই। আর ১৯৭১ সাল নাগাদ তাহারা আরো চরম বিশ্বাসে বাংলাদেশ আন্দোলনে-জাতির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে শামিল হইলেন। সেই বিশ্বাসও রাখা শেষ পর্যন্ত কঠিন প্রমাণিত হইল। তাই আ ফ ম মাহবুবুল হক অতি অল্পসংখ্যক বিশ্বাসী সঙ্গে করিয়া নতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনি যদি সফল হইতেন যুক্তির খাতিরে যদি ধরিয়াও লই সফলই হইতেন তবে কি এই সমাজ নতুন কোন বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় নীল হইয়া যাইত না? কে জানে? চুন খাইয়া যাঁহার মুখ পুড়িয়াছে সে তো দই দেখিয়া ভয় পাইবেই।

আমি জানি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে আ ফ ম মাহবুবুল হকের জীবন হইতে কোনো শিক্ষা যদি লইবার মতো থাকে তাহা এই তিনি এই তৃতীয় সংগ্রামের গোড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এই সংগ্রামের নাম গোড়াতেই হওয়া উচিত ছিল ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম’ কিন্তু ‘কালের নায়ক’ হইবার বাসনায় আমরা ইহার নাম রাখিয়াছিলাম ‘সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম’। আমরা খুব বেশি ভুল করি নাই। সামান্য মাত্র করিয়াছি। রুশদেশের মহান নেতা লেনিন বলিয়াছিলেন, ‘যে কোনো কাজ করে না সে কোনো ভুলও করে না। তবু মৌলিক ভুল করা চলিবে না।’

আমি অতি সাধারণ মানুষ। আমি অন্য এক সাধারণ মানুষের কথা ধার করিয়া বলিব, ‘যে মানুষ কেবল কথা বলে, কোন কাজই করে না, তাহাকে ফুলের বাগানে গজানো আগাছার সহিত তুলনা করা যায়।’ আ ফ ম মাহবুবুল হক আর যাহাই হউন- আগাছা ছিলেন না। আগামীকাল এই গাছের ছায়ায় আমরা সকলেই দাঁড়াইব।

লেখক: সলিমুল্লাহ খান
অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //