সড়কে সরেজমিনে

এক.
সড়ক দুর্ঘটনায় নিকট ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর কেমন লাগে সেই অনুভূতি কাউকে বলে বোঝানো যায় না। আমার কাছের এক বন্ধুর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর বুঝেছি এই যাতনা কতটা কষ্টের, যন্ত্রণার, অসহনীয়। আমি নিজেও একবার ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলাম। সেই দুর্ঘটনাটি সম্পূর্ণ চালকের কারণেই হয়েছিল। সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কথা মনে পড়লে আমরা শরীর আজও শিহরিত হয়ে ওঠে।

বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কার্যকর হওয়ার পর পরই যে দেশে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে সেই কথা অন্তত বলা যাচ্ছে না। তাছাড়া আইনটি কার্যকর হওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।

চালকের জায়গায় কন্ডাক্টর গাড়ি চালাবে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস ছাড়া গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামবে, যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে, নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় ও এটা নিয়ে কথা বললে যাত্রীদের ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেবে, নিজেদের ইচ্ছেমতো অপর গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে, যাত্রী তোলার জন্য জলজ্যান্ত মানুষ খুন করে ফেলবে, নারী যাত্রীদের বাসে একা পেলে ধর্ষণ করবে, মাদক সেবন করে গাড়ি চালিয়ে যাত্রীদের দুর্ঘটনা ঘটাবে, প্রয়োজনের সময় ভাড়া ডাবল করে দেবে, আদেশ অমান্য করে শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাস’ কার্যকর করবে না, যখন তখন গাড়ি বন্ধ রেখে যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলবে, যখন যেভাবে সুবিধা হয় সেইভাবে নিয়ম বানিয়ে চলবে এইরকম অসংখ্য কারণ থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না। কারণ তারা পরিবহন শ্রমিক, তাদের সংগঠন শক্তিশালী, তারা যখন তখন যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, তাদের কাছে সবাই জিম্মি। তাদের পেছনে রয়েছে স্বয়ং পরিবহন মালিকরা, যারা গোটা সড়ক-যোগাযোগ খাতকে মুঠোয় পুড়ে রেখেছে। কেউ কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না।

দুই.
‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ কার্যকর হওয়ার পর রাজধানীর বাস কেমন চলছে তার একটি বিবরণ দিলেই সবাই পরিষ্কার ধারণা পাবেন আসলে তাদের চরিত্র কেমন। রাজধানীর একটি বাসের নাম ‘রাইদা এন্টারপ্রাইজ’। নিচে লেখা ‘সিটিং সার্ভিস গেটলক’। তার নিচে লেখা ডিয়াবাড়ী-এয়ারপোর্ট-বাড্ডা-খিলগাঁও-পোস্তগোলা। সর্বশেষ লেখা রুট নং- এ/৩১৭। এসব লেখা গাড়ির সামনের গ্লাসে। এই পরিবহনের মালিক কে? চালক কে? এই পরিবহন বৈধ নাকি অবৈধ? বা এর রুট পারমিট আছে কিনা সেই আলোচনায় যাব না। আমি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের চালচিত্র তুলে ধরব।

১৯ নভেম্বর ২০১৯, বেলা সাড়ে ১১টায় আমি দিয়াবাড়ী (বাসে লেখা ডিয়াবাড়ী) থেকে উঠলাম, গন্তব্য সায়েদাবাদ। অল্পকিছু যাত্রী নিয়ে বাসটি চলা শুরু করল। চলার পর থেকে যে যখন যেখানেই হাত দেখাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাত্রী নিচ্ছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আমি চালক এবং কন্ডাক্টরের কর্মকা- দেখছিলাম। তাদের কোনো বিকার নেই। যাত্রী দরকার, তা কোনো উপায়ে উঠছে, কীভাবে উঠছে, তা জানার বা দেখার দরকার নেই। সবচেয়ে অদ্ভুত সত্য হলো, দিয়াবাড়ী থেকে হাউসবিল্ডিং পর্যন্ত এই অল্প রাস্তায় বাসটি নয়বার থেমে একজন-দুইজন বা একাধিক যাত্রী নিয়েছে।

যত্রতত্র বাস না থামানোর জন্য একাধিকবার ট্রাফিক আইনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া যাত্রী না ওঠানোর কথা বললেও বাসটি সেটা মান্য করছে না।

বার বার থামার কারণে কয়েকজন যাত্রী পেছন থেকে চিৎকার করায় কন্ডাক্টর গলা উঁচিয়ে বলছে, ভাই এহনো আমার সিট ফাঁকা আছে। এর মধ্যে চালকের ফোন আসে, সে যথারীতি স্বল্প পরিসরে কথা বলে আবার গাড়ি চালানো শুরু করে।

সড়ক আইনে চালক ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদ- এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এখন কে এইভাবে চালকদের দেখাশোনা করবে। যদি প্রতিটি বাসের চালকদের শুধু ফোনে কথা বলে কিনা দেখাশোনা করতে হয়, তাহলে তো প্রায় ৪৫ হাজার লোক লাগবে, কারণ রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় ৪৫ হাজারেরও বেশি গণপরিবহন চলাচল করছে। দিনদিন এ সংখ্যা বাড়ছে। এইভাবে মনিটর করা অসম্ভব।

বাস যখন কাউলা স্টপেজে আসে তখন তাদের চেকার ওঠে। চেকার লোকসংখ্যা গুনে ওয়েবিলে তা লিখে দেয়। পিছনে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের হাফ পাসের কথা বললে চেকার বলে, এই গাড়িতে হাফ পাস কাডে না। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য সরকার সব গাড়িতে হাফ পাস আইন করে দিয়েছে, তোমরা কেন নেবে না? চেকারের বক্তব্য, এইডা মালিকে বুঝে না, মালিক আমাগোরে কয় নাই। অতএব, এই গাড়িতে হাফ পাস নাই। এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর চেকার তাদেরকেসহ গণনা করে ওয়েবিলে লিখে দেয়।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রাজীব এবং দিয়া মারা যায়। সেই সময় ৯ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ছয় দিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ করে। তাদের নয় দফার সাত নম্বর দাবি ছিল- শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা। সরকার তা মেনেও নেয় এবং বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়। সরকার মেনে নেওয়ার পরও ‘রাইদা এন্টারপ্রাইজ’ বা অন্যান্য গণপরিবহনগুলো মানছে না কেন তা বোধগম্য নয়। তবে কি এইসব বাস মালিকরা সরকারের আদেশকে অমান্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে? তাই যদি হয় তাহলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয় তাও মনে হয় বাসমালিক বা পরিবহন শ্রমিকরা অমান্য করবে।

রাইদা বাস এভাবে যাত্রী তুলতেই থাকে। সবাই উচ্চবাচ্য করলে কিছুক্ষণ যাত্রী নেওয়া বন্ধ করে, আবার আগের মতো যেখানেই হাত দেখায় সেখানেই যাত্রী নেওয়া শুরু করে। মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে দেয়। এভাবে নতুন বাজার এসে দেখা যায়, সব যাত্রী সিটে বসার পরও আরও ২০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে।

অথচ রাইদা বাসে লেখা ‘সিটিং সার্ভিস গেটলক’। এই কথাটার অর্থ হলো সব সিট পূর্ণ হয়ে গেলে বাসের গেট বন্ধ থাকবে। তাহলে রাইদা বাসে যা লেখা তাও তারা অমান্য করছে। মূলত ‘সিটিং সার্ভিস গেটলক’ বা ‘সিটিং সার্ভিস’ বা ‘কম স্টপেজ’ বা ‘গেটলক সার্ভিস’ এসব লেখা বা দেখানোর একমাত্র কারণ হলো নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা। এরপর যাত্রীদের চোখ সয়ে গেলে সেই ডাবল ভাড়াতেই বাসগুলো লোকাল চলতে থাকে।

আমি উঠেছি দিয়াবাড়ী থেকে। দিয়াবাড়ী থেকে পোস্তগোলা ৫০ টাকা ভাড়া। কিন্তু আমি সায়েদাবাদ নামলেও আমাকে ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। এটাই তাদের নিয়ম। আমার পাশের সিটের যাত্রী উঠেছেন এয়ারপোর্ট থেকে। তিনি যাবেন সায়েদাবাদ। তার ভাড়াও ৫০ টাকা। শুভঙ্করের ফাঁকিটা হলো, দিয়াবাড়ী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এই সিটের আগের যাত্রী ১০ টাকা দিয়ে নেমে গিয়েছেন। এয়ারপোর্ট থেকে তিনি যেমন ৫০ টাকা দিচ্ছেন, আমি দিয়াবাড়ি থেকে উঠে আমিও ৫০ টাকা দিচ্ছি। আবার আমরা দুইজনই সায়েদাবাদ নেমে যাচ্ছি। তখন এই সিটগুলো ফাঁকা। স্বভাবতই এই দুই সিটে আবার নতুন যাত্রী উঠবেন তারা ১৫ টাকা দিয়ে সায়েদাবাদ থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত যাবেন। তাহলে একটি সিটের মোট ভাড়া ৫০ টাকার বেশি হয়ে যাচ্ছে। আরও ভেঙে গেলে মোট ভাড়া আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে ৫০ টাকার একটি সিটের ভাড়া ৭৫ থেকে ৯০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিদিনই যাত্রীদের কাছ থেকে ডাবলের ডাবল ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যা কেউই তদারকি করছে না।

রাইদা এন্টারপ্রাইজ এভাবে ৫০ টাকা করে যে ভাড়া সবার কাছ থেকে আদায় করছে, সেই ভাড়া নেওয়ার অনুমোদন কি তাদের আছে? অথচ আইনে বলা আছে, গণপরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত দাবি বা আদায় করলে এক মাসের কারাদ- বা ১০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। এই অর্থদ- বা জরিমানাটা কে করবে? কে তাদের মনিটরিং করবে? দেশে যে পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকবল আছে তা দিয়ে এসব অসম্ভব।

তিন.
একটি নির্দিষ্ট রুটের একটি বাসেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সারা রাজধানীতে কি ভয়ানক অবস্থা বিরাজ করছে? প্রতিবার কোনো দুর্ঘটনার পর জানা যায়, এইসব গাড়ির রুট পারমিট নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, মালিকের যে পরিমাণ গাড়ি চালানোর কথা ছিল তারচেয়ে বেশি গাড়ি সে চালাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির মৃত্যু হচ্ছে। এই ৫৫ জন ব্যক্তি অন্যগ্রহ থেকে আসা কেউ নন। এই ৫৫ জন আমি বা আপনি। আমার বা আপনার পরিবারের নিকটজন। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হন। একটি নির্দিষ্ট বছরে ১২ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়! এটা সত্যিই বিস্ময়কর।

প্রতিবার একই ঘটনা ঘটে, আর আমরা বার বার ভুলে যাই। পরিবহন শ্রমিকসহ মালিকরা আমাদের সঙ্গে এই ধরনের আচরণ করতে থাকে, আমরা সহ্য করি। প্রতিবার তারা আমাদের নিকটজনকে খুন করে, আমরা চুপ করে তাও মেনে নেই। কখনো আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়, সেই আশ্বাস শেষ হতে না হতেই আবার একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই ভুলে যাওয়াটা, এই মেনে নেওয়াটা, এই চুপ করে থাকাটা আমাদের জন্য যে কতবড় কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা আমরা নিজেরাও জানি না।

লেখক: বিনয় দত্ত,
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //