রেশনিং ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন এখন সময়ের দাবি

মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটলে কোনো আইন ও শাস্তির বিধান মানুষকে কখনো সুপথে এনেছে বলে ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। চৈনিক সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক যুগে আফিম আসক্ত চীনা জনগোষ্ঠী এটি ত্যাগ করার নির্দেশ কার্যকর করেনি। তখন তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ মেপে খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় রাষ্ট্র কর্তৃক। এভাবে ক্রমান্বয়ে চীন দেশের মানুষ আফিম আসক্তি থেকে মুক্ত হয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন আফিম মাপার বাটখারা ঘসে ওজন কমিয়ে আনার পদ্ধতি কার্যকর হয়েছিলো। 

আমাদের বঙ্গীয় ভোগবাদী সমাজে সুবচন আর ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্যবসায়ীদের সঠিক পথে অদ্যাবধি আনা সম্ভব হয়নি। যা সাম্প্রতিককালে পেঁয়াজসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের অনাকাঙ্ক্ষিত কারসাজি দ্বারা মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। ফরিয়া মহাজন কিংবা চাতাল বা হাসকিং মিল মালিকরা ধানের মওসুমে ৪৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে উৎপাদক-কৃষকের ধান ক্রয় করে গুদামজাত করে। পরবর্তী সময়ে ধান থেকে চাল তৈরি করে বিভিন্ন প্রকার ভেদে ২০০০ টাকা থেকে ২৮০০ টাকা মণ বা কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত দরে ভোক্তাদের নিকট বিক্রি করেন। সরকারি ধান সংগ্রহ অভিযান চলাকালে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে এবং ফড়িয়া মহাজনদের সঙ্গে অলিখিত অবৈধ আঁতাতের কারণে উৎপাদক কৃষক ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেনি। জরুরিভাবে ঋণ শোধ এবং ব্যক্তিগত গুদামের অভাবে কম দামেই চাতাল বা রাইস মিল মালিকদের নিকট ধান বিক্রিতে বাধ্য হয়। তাই উৎপাদন খরচও উঠে আসে না। উপরন্তু সরকারি খাদ্য গুদামে স্থানাভাবে সরকারও যথেষ্ট পরিমাণ ধান সংগ্রহ করতে না পারায় এক শ্রেণির স্থানীয় অসাধু ক্ষমতাশীলদের অনৈতিক ব্যবসা করার সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বিলম্বে ধান-চাল ক্রয় করে গুদামজাত করায় কাঙ্ক্ষিতভাবে ধান সংগ্রহ অভিযান সাধারণ কৃষকের কোনো উপকারেই আসছে না। বরং মহাজনী মজুদদারদের লাভের পাল্লাই ভারী হচ্ছে। পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির যাতাকলে পড়ে কৃষক ক্রমেই দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন। অনুরূপভাবে নাগরিক জীবনে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছে।

১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত আধুনিক কৃষির চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলনে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে প্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ওঠা-নামা করে আর সাধারণ ভোক্তা-ক্রেতাদের মাসুল গুনতে হয়। কথিত খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশে এটা এক ধরনের নিষ্ঠুর রসিকতা। খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সব শ্রেণি পেশার কর্মচারীদের মহার্ঘ্য ভাতা প্রদানের বিষয়টি এখন উপেক্ষিত। এ বিষয়ে জোরালো দাবিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। তাই রেশনিং ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা জরুরি।

১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ভারত উপ-মহাদেশে নিদারুণ খাদ্য সংকট দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার জনরোষ এড়াতে এতদাঞ্চলে রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। বড় বড় শহরে স্বল্পমূল্যে রেশন দোকানের মাধ্যমে খাদ্যশস্য তথা চাল, ডাল, গম, চিনি, তেল, ঘি ও লবণ প্রভৃতি বিক্রি শুরু করলে শহরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং প্রধান শহর ঢাকায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিলো। এই ব্যবস্থা নগরে বসবাসকারীদের জীবন ধারণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়কে সহযোগিতা করাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। বিশ্বযুদ্ধ উত্তর খাদ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে রেশনিং ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করে জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতেও চালু করা হয়েছিলো। ২২ টাকা মণ দরে সরকারি চাল বিক্রি হলেও খোলাবাজারে প্রকার ভেদে ১৬-১৮ টাকা মণ দরে চাউল পাওয়া যেতো। তবে ভারত বিভক্তির পর এই অঞ্চলে প্রয়োজনের কম খাদ্যশস্য উৎপাদিত হলে বৈদেশিক খাদ্য সহায়তায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু ছিলো। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মেরুকরণে বৈদেশিক খাদ্য সহায়তা প্রায় শুন্যের কোটায় নেমে এলে মুজিব সরকার বাধ্য হয়েই ফুড কার্ডের ব্যবস্থা করে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্যশস্য পাচার বন্ধ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে এদেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিলে, তা মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে রূপ নেয় এবং লক্ষাধিক মানুষ খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ করে। তৎকালীন সরকার Grow more food তথা Green revolution এর কর্মসূচি গ্রহণ করে। পতিত জমিসহ রাস্তার আইল্যান্ড এবং রেল লাইনের দু’পাশে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই শস্য আবাদ শুরু করলে এক বছরের মধ্যে খাদ্য সংকট সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। আর দাতা দেশগুলো সহনীয় হয়ে সাহায্যের হাত প্রশস্ত করে।

সেই সময় নগর ও শহরে বসবাসকারীরা সাপ্তাহিক রেশন স্বল্পমূল্যে পেয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছিলেন। যদিও বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তর রেশনে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ৪০ শতাংশ বাড়ানোও হয়েছিলো। তবে রেশনিং ব্যবস্থা চালু থাকায় সেই সময় খাদ্য ব্যবসায়ীদের তেমন কোনো বিস্তার ঘটার সুযোগ হয়নি। সরকারের ভর্তুকির কারণে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ওই সব পণ্যের মূল্য অযাচিতভাবে বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা করারও সুযোগ পায়নি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে এখনো মাসিক রেশনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শুধু তাই নয় দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে এবং ছিন্নমূল হতদরিদ্র অসহায়দের জন্য বিনামূল্যে মাসিক রেশনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। 

১৯৮০-১৯৯০ সালে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন (আধুনিক পদ্ধতি ও উন্নত জাতের হাইব্রিড বীজ ব্যবহারে) সাফল্য লাভ করে। এ কারণে দাতাগোষ্ঠী ও FAO রেশনিং পদ্ধতি বাতিল করে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করার জন্য অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে চাপ দিতে থাকে। এ কারণে তৎকালীন এরশাদ সরকার আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৯২ সালের মে মাসে রেশনিং পদ্ধতি সরকারিভাবে বাতিল করে। এতে দেশব্যাপী খাদ্য ব্যবসায়ীদের সংখ্যা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার লাভ করে। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নিতে পারছে না। সবক দিয়েই সরকার তার দায়িত্ব শেষ করছে কেবল। সরকার টিসিবিকে দিয়ে উন্মুক্ত বাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি করে জনতার চোখে ধুলো দিতে চেষ্টা করছে। এ ঘটনা ২০১৯ সালের শেষ দিকে পেঁয়াজ আমদানিতে দৃশ্যমান হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আমদানি করা পেঁয়াজ লভ্যাংশ রেখে টিসিবির কাছে বিক্রি করলে সংকট মোকাবেলায় টিসিবি ভর্তুকি দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। এক্ষেত্রে টিসিবি সরাসরি আমদানি করে বিক্রি করলে নিঃসন্দেহে জনগণের অর্থ ভর্তুকিতে সাশ্রয় করা সম্ভব ছিলো, অকারণেই আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের মুনাফা লাভের সুযোগ করে দেওয়া হলো। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে রিসার্চ ও এনালাইটিক্যাল উইং থাকলেও কোন পণ্য কতোদিনের মজুদ রয়েছে তা সরকারকে অবহিত করার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। 

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেশনিং ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই বিধায় তা পুনঃ চালু করলে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এমনিতেই অকার্যকর হয়ে পড়বে। সারাবছর সরকারি খাদ্য গুদামে ধান-চাল জমা করে রাখার আর প্রয়োজন থাকবে না। তবে আপদকালীন মজুদও জরুরি। গুদাম ভরা থাকার অজুহাত দেখিয়ে মওসুমে সংগ্রহ অভিযান হ্রাস করে অসৎ ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুযোগ প্রদান বন্ধ করা যেতে পারে এবং এতে কৃষককূলেরও প্রতারিত হবার ভয় থাকবে না। 

নতুন বছরে সবার জীবনে স্বস্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে রেশনিং ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলে সীমিত আয়ের আপামর মানুষ অন্তত ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবে।

আবুল খায়ের
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম পরিচালক, পিএমও

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //