রমনার ঘোড়দৌড়

১৯৫০-এর দশকের স্কুলজীবনের কথা। হাতিরপুল রেল লাইনের পূর্বধারে পরিবাগে বাসা। কাছেই রমনা রেসকোর্স ময়দান। প্রতি রোববার বিকেলে সেখানে ঘোড়দৌড় হয়। অন্যান্য দিন মাঠের ভেতরে হয় গলফ খেলা। স্কুল থেকে এসে নাকে মুখে কিছু গুঁজে দৌড় দেই ঘোড়দৌড় দেখতে। 

ময়দানের কিনার ঘেঁষে ভেতরে বাহিরে কাঠের রেলিং দিয়ে সারা রেসকোর্স ময়দানে চক্রাকারে চারদিকে ঘোড়দৌড়ের ট্র্যাক। রেলিং সাদা রঙ করা। প্রতি ফার্লং দূরে দূরে দূরত্ব চিহ্ন। বিভিন্ন ফার্লংয়ের দূরত্বে দৌড় হয়। ট্র্যাকের ওপর পুরু বালির স্তর। সাদা শুকনো বালি চিক চিক করে। পা হড়কে পড়ে গেলে ঘোড়া এবং জকি কেউ যেন আঘাত না পায় তাই এ ব্যবস্থা। তাছাড়া বালির ওপরে ঘোড়ার পক্ষে দৌড়াতে সুবিধা। এতে ঘোড়ার পক্ষে দৌড়াতে সুবিধা ছাড়াও দৌড়রত ঘোড়া পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিলেতে এ খেলা ডার্বি নামে পরিচিত। বছরের নির্দিষ্ট এক সময়ে মহাসমারোহে এ খেলা এখনো সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। নারী-পুরুষ বাহারি পোশাক ও মাথায় ক্যাপ পরে এ খেলা উপভোগ করতে আসে। ইংরেজ শাসনামলেই ঢাকার রমনায় এ খেলা শুরু হয়। সেই থেকে রমনার এই ময়দানটির নাম রেসকোর্স ময়দান।

মাঠের উত্তর-পশ্চিম কিনারে ভিআইপি গ্যালারি। এখানে ভিআইপি বাজিকর ও দর্শকরা বসে। সামনে রেসের ট্র্যাক। ঘোড়াগুলো দক্ষিণ দিক থেকে দৌড়ে পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তরে গ্যালারির দিকে আসে। এখান থেকেই ঘোড়ার দৌড় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গ্যালারিতে দৌড়ের বিচারক ও স্টার্টাররাও বসে। বিচারকরা কোন ঘোড়া জিতল তার ফয়সালা করে। গ্যালারির সামনে ট্র্যাকের বাইরে পূবদিক ঘেঁষে উচালম্বা চওড়া সাদা কাঠের খাড়া বোর্ডের উপরে মাঝখানে একটি লম্বমান সরু কালো রেখা। রেখাটি সাধারণ খেলোয়াড়দের দৃষ্টির আড়ালে। এই রেখা দৌড়রত ঘোড়ার অতিক্রম দৃষ্টে বিচারকরা বুঝে নেয় কোন ঘোড়া আগে আর কোন ঘোড়া পরে ফিনিশিং দিল। এই দেখে বিচারকরা দৌড়ে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ঘোড়া নির্বাচন করে। মাঠের ভেতর পূব দিকের বটগাছ তলায় ও তার আশপাশে লোকে লোকারণ্য। তারা রেসের ঘোড়ার ওপর বাজি ধরে। মানে রেস খেলে। এরা সাধারণ রেস খেলোয়াড়। বিশেষ মর্যাদার খেলোয়াড়রা গ্যালারিতে বসে। দর্শকরা বাইরের রেলিংয়ের পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে দৌড় দেখে। 

রেসের দিন বাইরে পশ্চিমের পিচঢালা ময়মনসিংহ রোডে হাট বসে যায়। পিচঢালা রাস্তায় চানাচুর, চিনাবাদাম, বুটভাজা, খিরাই, লেমনেড আইসক্রিম, বাচ্চাদের খেলনা, লজেন্স- এ জাতীয় রকমারি পণ্যের পসরা সাজানো। যার যার সামর্থ্য মাফিক আয়োজন ও দোকান। তবে সবই সাময়িক। রেস খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আছে তার পর আর নেই। রেসের দিন সেখানে এক রকম মেলা বসে যায়। মধ্যবয়সী এক লোক এক-তারের একটি বাদ্যযন্ত্রে বাহারি হিন্দি গানের সুর তুলে উপস্থিত জনতাকে মুগ্ধ করে আর তার পিঠে ঝুলানো চটের থলি থেকে বের করে তা বিক্রি করে। এ সুর শুনে তাকে ঘিরেও লোক জমে যায়। মজার ব্যাপার হলো এ যন্ত্রে সে ছাড়া আর কেউ সুর তুলতে পারে না। তবু লোকে বাচ্চাদের জন্য এটি কিনে নিয়ে যায়। 

নানা রঙের টাইট পোশাক পরিহিত কালো চামড়ার হাঁটু অব্দি ফিতায় বাঁধা টাইট জুতা পরে জকিরা ঘোড়াগুলোকে বাজি খেলোয়াড়দের সামনে ধীরে ধীরে হাঁটায়। জকির মাথায় গায়ের পোশাকের মতোই আঁটসাঁট রঙিন ক্যাপ যাতে বাতাস তার গায়ে বা চুলে লেগে ঘোড়ার গতিবেগ ব্যাহত করতে না পারে। প্রত্যেক ঘোড়া ও তার জকির গায়ে একই নম্বর। আলাদা আলাদা ঘোড়া ও তার জকির গায়ে আলাদা আলাদা একই নম্বর। এভাবে বজিকরদের সামনে জিন টেনে ঘোড়ার স্বাস্থ্য এবং তেজ প্রদর্শন করা হয়। এই দেখে খেলোয়াড়রা আন্দাজ করে নেয় কোন ঘোড়া জিতবে। সে আন্দাজের ওপর বাজি ধরে। প্রত্যেক দৌড়ের আগে কিছুক্ষণ ধরে দৌড়ের ঘোড়ার এই প্রদর্শনী চলে। এরপর এক সময় জকিরা ঘোড়াগুলো হাঁটিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট ফার্লংয়ের দৌড়ের স্টার্টিং পয়েন্টে চলে যায়। স্টার্টিং পয়েন্টে ঘোড়াগুলো সারি বেঁধে দাঁড়ায় বা পায়চারি করে। এদিকে গ্যালারিতে ও বট গাছের কাছে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরার কাজ চলতে থাকে। এ কাজ শেষ হলে দৌড় শুরু করার জন্য গ্যালারি থেকে সবুজ রঙের ফ্লাগ উচিয়ে রেস স্টার্টারকে সংকেত দেওয়া হয়। এই সংকেত পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘোড়া নিয়ে জকিরা স্টার্টিং পয়েন্টের ধারে কাছে ঘোরাফেরা করে। ঘোড়ার জিন ধরে টান মেরে জকিরা ঘোড়াকে বাগে রাখে।

গ্যালারি থেকে দৌড় শুরুর সংকেত পেলে স্টার্টার বাঁশি বাজায়। সব ঘোড়া ঠিক মতো পজিশন নেওয়ার পর স্টার্টার সারি বাঁধা ঘোড়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে ‘রেডি’ বলে তার হাতের সবুজ রঙের ফ্লাগ উঁচু করে। সব ঠিক ঠাক মতো হলে দৌড় শুরু হয়ে যায়। খেলোয়াড়রা এতক্ষণ ঘোড়ার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। যেই দৌড় শুরু, তাদের চিৎকার চেঁচামেচিও শুরু হলো। যে ঘোড়ায় বাজি ধরেছে তার নাম্বার ধরে খেলোয়াড়রা ডাকাডাকি চিৎকার করতে থাকে। ঘোড়া যতই ফিনিশিং রেখার কাছাকাছি আসতে থাকে খেলোয়াড়দের চিৎকার ডাকাডাকি ততই বাড়তে থাকে। 

ওদিকে জকি ঘোড়ার পিঠের ওপর নুয়ে পড়ে নিজের বুক যতটা সম্ভব ঘোড়ার পিঠে লাগিয়ে জিন আলগা করে নেড়ে নেড়ে ঘোড়ার পেটে দুই পা ছুড়ে তাড়া করতে থাকে। ঘোড়া প্রাণপণে দৌড়ায়। পিছিয়েপড়া ঘোড়া এবং জকিকে খেলোয়াড়রা গালাগালি করে আবার উৎসাহও দেয়। দৌড়ে এগিয়ে থাকা ঘোড়ায় যারা বাজি ধরেছে তারা আনন্দে উল্লাসে লাফাতে থাকে। দর্শকরা ঘোড়ার দৌড় এবং খেলোয়াড়দের লাফঝাঁপ, হৈচৈ, চেঁচামেচি, আনন্দ-উল্লাস-হতাশা সবই উপভোগ করে। দর্শকরা মাঠের পশ্চিমে রাস্তার ওপরে রেলিংঘেঁষে বাইরে ফিনিশিং লাইন দৃশ্যমান হয় এমন দূরত্বে অবস্থান নেয়। ঘোড়া ফিনিশিং লাইন ক্রস করলে হৈচৈ কিছুটা কমে। এবার বাজিকরদের মধ্যে শুরু হয় টেনশন- না জানি কোন ঘোড়া জিতলো! সবার দৃষ্টি এবার গেলারিতে বসা বিচারকদের দিকে। তারা বিজয়ী ঘোড়ার নাম্বার উঁচিয়ে দেখাবে।

বিচারকরা তাদের রায় ঘোষণার পর আনন্দ এবং মাতম দুটোই শুরু হয়ে যায়। জকিরা ধীরলয়ে হাঁটিয়ে বিজয়ী ঘোড়া তিনটি সবাইকে দেখায়। যারা জিতেছে তারা জেতার টাকার জন্য বট গাছের পাশে টিকিট হাতে কাউন্টারের দিকে দৌড়ায়। গ্যালারির ভিআইপি বাজিকররা কিভাবে জেতার টাকা সংগ্রহ করে, তা দেখিনি। এদের জন্য নিশ্চয়ই একটা ‘সম্মানজনক’ সুবন্দোবস্ত আছে। যারা হেরেছে তারা ভাঙা মন নিয়ে মাতম করতে করতে বিচারকদের রায় নিয়ে গজ গজ করে। পরবর্তীবারের আশায় থাকে। প্রত্যেকবারই বিভিন্ন ফার্লংয়ের দূরত্বে আলাদা আলাদা মাপ ও সাইজের ঘোড়ার দৌড় হয়। 

ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করত তদানীন্তন ঢাকা জিমখানা ক্লাব। এমনো শুনেছি রেসে হারজিতের একমাত্র নিয়ামক ঘোড়ার স্বাস্থ্য, তেজ ও জকির দক্ষতাই সব নয়। এর পেছনে অদৃশ্য হাতের ছলচাতুরিও নাকি কাজ করত। খেলার কর্তারা ইচ্ছা করে জেতা ঘোড়াকে হারিয়ে দিতো আর হারু ঘোড়াকে জিতিয়ে দিতো। এ টাকার খেলা। এ জুয়া। বাজিকরদের যত কম টাকা দিয়ে বেশি টাকা আত্মসাৎ করা যায়, তারই নাকি চেষ্টা করা হয়। যে ঘোড়ার পেছনে যত বেশি টাকা বাজি ধরা হয়েছে তাকে নাকি ইচ্ছে করেই হারিয়ে দিয়ে উদ্যোক্তারা টাকা হাতিয়ে নেয়। নির্জীব ঘোড়া বা যার পেছনে কম লোক বাজি ধরেছে বা ধরেনি তাকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ বাজিকররা হায় হায় করে। গ্যালারির অভিজাত বাজিকরদের কথা জানি না। এরাই নাকি এ খেলার হর্তাকর্তা বিধাতা। জুয়া জুয়াই। এর কোনো স্থিতি নিশ্চয়তা নেই। খেয়াল খুশির খেলা।

যা নিশ্চিত তার প্রতি লোকের আকর্ষণ কম বা নেই। যা অনিশ্চিত তাকে ঘিরেই মানুষের যত যাচনা। কাল সূর্য পূব দিকে উঠবে, এ নিয়ে কেউ বাজি ধরবে না। কাল তা পশ্চিম দিকে উঠবে- এরকম দাবি যদি কেউ করে বসে তবে তার সঙ্গে বাজি খেলার লোকের অভাব হবে না। ইরেজিতে প্রবাদ আছে Zeal without knowledge is a runaway horse. একদিন শুনলাম আমাদের পাড়ার এক লোক রেস খেলে আশি টাকা জিতেছে। আশি টাকা তখন অনেক টাকা। এ টাকায় তখন মধ্যম সাইজের একটা কোরবানির গরু কেনা যেত। তাকে দেখার জন্য সবাই উদগ্রীর। বেশ লম্বা এক রুগ্ন লোক, জেতার আনন্দে আত্মহারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পর এ খেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটা এখন ইতিহাস। এ ময়দানকে এখন আর কেউ রেসকোর্স ময়দান বলে না। এটা এখন গাছগাছালিতে ভরা ছায়াঘেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //