দিল্লি নির্বাচনে বিজেপির ‘তিন পার’

দিল্লি ভারতের রাজধানী শহর এবং একই সঙ্গে অন্য সব রাজ্যের মতো এক রাজ্যও বটে। তাই দিল্লি মানেই এক দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা, স্ট্যাটাস ও সংঘাত। স্বভাবতই গত ১৯৯১ সাল থেকে দিল্লি নামের সঙ্গে বিতর্ক-বিরোধও পাশাপাশি হেটে চলেছে। দিল্লি বলতে যেটা ‘রাজ্য দিল্লি’ বোঝায়, সেই রাজ্য সরকারের নির্বাচনের তারিখ নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করেছে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি।

২০১৯ সালের মে’তে কেন্দ্রীয় নির্বাচন সমাপ্ত করে মোদিকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ওই নির্বাচনের পূর্বের এক বছর এবং পরের প্রায় এক বছর এই দুই সময়কালেই রাজ্য নির্বাচনগুলোতে সবখানেই বিজেপি হেরে গিয়েছিলো। অর্থাৎ মাঝের কেন্দ্রীয় নির্বাচনের দু’মাস যদি বাদ দেই তাহলে ২০১৮-১৯ এ দুই বছরে বিজেপি সব রাজ্যেই হেরেছিলো। এই হারই ছিলো নির্বাচনি ট্রেন্ড। তাহলে কেন্দ্র নির্বাচনে মোদি হঠাৎ জিতেছিলো কী করে? এটা বেশ রহস্যজনক যে, প্রায় সব রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির হেরে যাওয়া যদি এক ট্রেন্ড বা বিশেষ অভিমুখ হয়ে থাকে অথবা এখনো থাকতে দেখা যায়; তাহলে কেন্দ্র নির্বাচনের বেলায় অভিমুখ ভিন্ন কেনো? এটা এখনো রহস্য। এর ব্যাখ্যা-জবাব নিশ্চয় পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। তা সত্ত্বেও এখনকার ফ্যাক্টস হলো, গত ২০১৯ সালের মে’র পর থেকে নির্বাচনে বিজেপি কেবল হেরেই চলেছে। বিশেষ করে নাগরিকত্ব (অর্থাৎ পড়শি দেশের মুসলমান বাদে বাকি সব ধর্মের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার) আইন পাস করার পর থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিরোধ যখন থেমে থেমে প্রবল হয়ে উঠছে, তখন বিজেপি কী এবার দিল্লিতেও হেরে যাবে? রাজ্য নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে কী ফলাফল হয় তা দেখার জন্য প্রায় সব মহলে এক বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। 

ওপরে দিল্লিতে দ্বৈত প্রশাসনের কথা বলেছি। ভারতের জন্মের পর থেকেই একেবারে গোড়ার কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে দেওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। যেমন ভারতের রাজধানী কোথায় অবস্থিত হবে, ভারতেরই একটা রাজ্যের ভেতরে? যার কিছু অংশজুড়ে থাকবে রাজধানী অর্থাৎ কেন্দ্র সরকারের অফিস স্থাপনাগুলো, অথবা পুরা রাজ্যটাই একই সঙ্গে হবে রাজধানী শহর? নাকি একটা জেলা শহরকে রাজধানী শহর বলে গড়ে তোলা হবে? 

ভারত কতগুলো প্রদেশ বা রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটা রাষ্ট্র- তা একেবারেই না। নেহেরুর এটা নিয়েই ভয় ও আপত্তি ছিলো যে, কে কোথায় বের হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। বরং কনসেপ্ট হিসেবে ব্যাপারটা উল্টা। আর তা হলো, ভারত বলে একটা রাষ্ট্র আছে, যার কিছু কিছু অঞ্চল একেকটা রাজ্য (বা প্রদেশ)। আর ছোট-বড় মিলিয়ে যার সংখ্যা বর্তমানে ২৮টি। আর এই রাজ্যশাসিত অঞ্চলগুলো ছাড়াও সরাসরি কেন্দ্রশাসিত প্রশাসনিক এলাকাও অনেকগুলো আছে। এই কেন্দ্রশাসিত প্রশাসনিক এলাকা, এদের এক বাহারি নাম হচ্ছে ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’। ইউনিয়ন মানে? যেমন কেন্দ্রীয় সরকার কথাটায় ‘কেন্দ্র’ বলতে যা বুঝায় এটাকেই ভারতের সংবিধানে কোথাও কোথাও ‘ইউনিয়ন’ বলে বোঝানো হয়েছে। তাহলে ভারত কী রাজ্যগুলোর এক ইউনিয়ন? না এই বোঝাবুঝি সঠিক হবে না। এর মূল কারণ হলো, যেহেতু ভারত কোনো ফেডারেল রাষ্ট্র নয়, কাঠামোর নয় অথবা এর রাজ্যগুলো কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নয়- তাই স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ বা রাজ্যগুলোর কোনো ইউনিয়ন (ফেডারল ইউনিয়ন) ভারত নয়। বরং ওপরে যেভাবে বলেছি- ভারত মানে একক কর্তৃত্বের রাষ্ট্র, যার কোন কোন অঞ্চলে (প্রাদেশিক ধরনের) রাজ্য সরকার আছে, কিন্তু এগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নয়। আবার সরাসরি কেন্দ্র সরকারশাসিত ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ আছে। যেগুলোতে কোনো রাজ্য বা প্রাদেশিক সরকার নাই। যেমন শুরুতে ১৯১১ সালে দিল্লি ছিলো পাঞ্জাব প্রদেশের এক জেলা শহর। এটা পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানীও ছিলো। পরে ১৯৫৬ সালে সেই দিল্লিকে আলাদা করে নিয়ে ওই ‘ইউনিয়ন টেরিটরি’ বলে ঘোষণা করা হয়। ততোদিনে, মানে ১৯৪৭ সালের পর থেকে, দিল্লি আসলে ছিলো স্বাধীন ভারতের রাজধানীও। ইউনিয়ন টেরিটরি মানেই এর টপ প্রশাসক- তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন পরিচালনা করবেন। আর এই প্রশাসক পদেরই নাম লেফটেন্যান্ট গভর্নর রাখা হয়। যার সোজা কথাটা দাঁড়ায় লেফটেন্যান্ট গভর্নর মানেই কেন্দ্র সরকারের চোখ, কান ও ক্ষমতার প্রতিনিধি। এতোদিন পর্যন্ত তা কোনো মতে চলেছিলো। 

কিন্তু যেহেতু এটা রাজধানী, তাই বাণিজ্যিক বিষয়াদির কেন্দ্র মুম্বাই হলেও গুরুত্বপূর্ণ সব সরকারি-বেসরকারি অফিসের একটা করে শাখা দিল্লিতে রাখা আবশ্যিক হয়ে যায়। অন্তত সরকারের সঙ্গে সমন্বয় ও যোগাযোগের জন্য। তাতে সবার জন্য অফিস ও বাসা তো বটেই পুরা নাগরিক সুবিধার বন্দোবস্ত করা ছাড়া এটা কোনো কার্যকর রাজধানী হতে পারবে না। কাজেই প্রথম সমস্যা জমির অভাব। কয়েকবারে তা মিটানো হয়েছে পাশের উত্তর প্রদেশ বা পাঞ্জাব-হরিয়ানা রাজ্য থেকে জেলা কেটে নিয়ে দিল্লিতে অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়ে। কিন্তু তাতে আরেক সমস্যা হলো, এটা কোন ধরনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া এক অনির্বাচিত লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা হয়ে, বিরাট বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে থাকল। সেটা সামলাতে গিয়ে অবশেষে ১৯৯১ সালে দিল্লিকে এবার রাজ্য ঘোষণা করা হয়। মানে তখন থেকে আইনত দিল্লি আর সব রাজ্যের মতো এক নির্বাচিত রাজ্য সরকার, প্রাদেশিক পার্লামেন্ট বা বিধানসভা ইত্যাদির ব্যবস্থায় চলে যায়। যদিও এটা কাযর্কর হতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। সেই সময় কংগ্রেসের শীলা দিক্ষিত পরিপূর্ণ নির্বাচিত রাজ্য সরকার হয়ে আসেন এবং এই প্রথম তিনি পরের পুরো পাঁচ বছর পূর্ণ ক্ষমতায় ছিলেন। অবশ্য তিনি পরবর্তী সময়ে একই সঙ্গে পর পর তিনবারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সঙ্গে একটা বাড়তি জিনিস থেকে যায় আর তা হলো সমান্তরালভাবে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। কেনো?

কারণ এর দ্বৈত স্ট্যাটাস। তখনও দিল্লি একদিকে এক রাজ্য আবার অন্যদিকে এটা ‘ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি’। সোজা কথা এটা রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকার- এই দ্বৈত ক্ষমতার ঠেলাঠেলি ও মারামারির জায়গায় পরিণত হয়। মূল প্রশ্ন- কেন্দ্রীয় সরকার কি রাজ্য সরকারের টেনেন্ট বা ভাড়াটে বাসিন্দা হবে? বা হতে পারে কি? রাজ্য সরকারের পুলিশ বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তার দায়িত্বে কীভাবে যেতে পারে, যেখানে কেন্দ্রেরও নিজস্ব বাহিনী আছে? যেখানে এমনিতে সংবিধান অনুসারে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব রাজ্য পুলিশ ও রাজ্য সরকারের। আবার যেমন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়- এটা কেন্দ্র বা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের অধীনে নয়। ফলে সম্প্রতি অমিত শাহ্ তার পুলিশ বাহিনীর পাহারা ও ছত্রছায়ায় মুখোশধারী দলীয় গুন্ডাবাহিনী পাঠিয়ে ছাত্র সংসদের নেতাসহ প্রায় ত্রিশজন ছাত্র-শিক্ষককে বেধড়ক মারধর ও হামলা চালিয়েছে। তাতে কেজরিওয়ালের কিছু করার ছিলো না।

এসব বিরাট বিরাট প্রশ্নের সবকিছুই অমীংসিত রেখে দিল্লি চলছে। দিল্লি তাই আজও পূর্ণ অর্থে রাজ্য (স্টেটহুড) নয়। তাকে ক্ষমতা শেয়ার করতে হয়, কেন্দ্রের খুশি খামখেয়ালি সহ্য করতে হয়। তারপরেও আম আদমি পার্টির নেতা কেজরিওয়াল প্রথম পাঁচ বছর সমাপ্ত করে আগামী মাসে দ্বিতীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

দিল্লির রাজ্য বাসিন্দাদের সমস্যা অন্য রাজ্যের চেয়ে ভিন্ন। কারণ এর বাসিন্দাদের নিজস্ব ভূমিতে তৈরি বা গড়ে ওঠা রাজ্য এটা নয়। বরং পাশের রাজ্য থেকে কেটে আনা জেলা অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি করা এক রাজ্য। এই কথাটাকেই আর একভাবে বলা যায় বাসিন্দাদের বেশির ভাগই মাইগ্রেন্ট। এমনিতেই কোনো রাজধানী মাত্রই এর বাসিন্দার বড় অংশ মাইগ্রেন্ট হয়। দিল্লি এর চেয়েও বিশেষ রাজ্য। আর তাই বড় সমস্যাটা হলো নাগরিক অবকাঠামো সুবিধা- বাসা, গ্যাস, পানি, নিষ্কাশণ, বিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজ, দোকান ও অফিস ইত্যাদিতে সাজাতে যে কাঠামো লাগে এর সবকিছুই গড়তে হবে আর বাসিন্দাদের তা নগদ পয়সা দিয়ে কিনতে হবে। এককথায় নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের প্রথম ষাটভাগ চলে যাবে এই সুবিধাগুলো পূরণ করতে।

এসবের প্রচণ্ড অভাবের মধ্যে অনেক লড়াই করে কেজরিওয়াল ক্ষমতায় থিতু হয়েছিলেন ২০১৫ সালে। এরও আগে থেকে তিনি লেফটেন্যান্ট গভর্নর মানে কেন্দ্রের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত হয়েছিলেন। পরে বুঝতে পারেন এটার চেয়েও দিল্লির বাসিন্দাদের বিশেষ করে স্বল্পআয়ের মানুষদের অগ্রাধিকার হলো নাগরিক সুবিধার অবকাঠামোগুলো কার্যকর করা। কেজরিওয়াল এখন পপুলার সরকার হিসেবে পাঁচ বছর শেষ করছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখছে, “কেজরিওয়াল সস্তায় বিদ্যুৎ-জল, মহিলাদের বিনামূল্যে বাস সফর, মহল্লা-ক্লিনিক, আধুনিক সরকারি স্কুল ইত্যাদি দাবির মাধ্যমে ভালো জনপ্রিয়তা তৈরি করে ফেলেছেন”। এটা খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। এবার কে জিতবে, এমন নির্বাচনী আগাম সমীক্ষাও কেজরিওয়ালের পক্ষে। বলছে মোট ৭০ আসনের দিল্লি রাজ্যে ৫৯ আসন একাই তার দল আবার পাবে। যা গত সংসদে ছিলো ৬৭ আসন। আনন্দবাজার বিজেপির ঘরের একটা হতাশার খবর তুলে এনে লিখেছে, তাদের নাকি এক ঠাট্টার স্লোগান হলো- ‘অবকি বার তিন পার।’ মানে এবার তিন পেরোতে হবে। মানে হলো- গতবার কেজরিওয়াল কেবল তিন আসন দিয়েছিলো বিজেপিকে; বাকি নিজের। তাই তাদের ভয়, বিজেপি কী এবারও তিনের বেশি আসন পাবে? অতএব, ‘তিন পার’ হতে হবে!

লেখক: গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : গৌতম দাস

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //