মোহাম্মদ বদরুল আহসান

একজন রুচিশীল সম্পাদক ও বিনয়ী মানুষের নীরব প্রস্থান

নয় বছর আগের কথা, বন্ধু এজাজুল হক মুকুল প্রায় ফার্স্ট নিউজ নামে একটি ইংলিশ ম্যাগাজিন আমাকে পড়তে দিতেন। মুকুল তখন নিয়মিত ফার্স্ট নিউজে লিখতেন। মুকুলের কাছ থেকে ফাস্ট নিউজ পাওয়ার পর আমি এই ম্যাগাজিনের ভক্ত হয়ে যাই। ম্যাগাজিনটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। প্রচ্ছদ, ভেতরের মেকাপ, স্টোরিসহ সবকিছুতেই ভিন্নরকম স্বাদ পেতাম। এ রকম আন্তর্জাতিক মানের একটি ম্যাগাজিন যে বাংলাদেশ থেকে বের হতে পারে, তা কল্পনাও করিনি তখন। ম্যাগাজিনটি পড়তে পড়তে একটা সময়ে এতে লেখালেখির আগ্রহ জন্মায়।

খবর নিয়ে শুনলাম রেডিয়েন্ট পাবলিকেশন্স থেকে ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশক ও সম্পাদক মোহাম্মদ বদরুল আহসান। যিনি ফার্স্ট নিউজ সম্পাদনা ছাড়াও দি ডেইলি স্টারে নিয়মিত কলাম লেখেন। ২০১০ সালের কোনো একদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান ফটো সাংবাদিক আবু তাহের খোকন ভাইয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথম দেখাতেই একজন আন্তরিক ও বিনয়ী মানুষ মনে হলো আমার। তিনি বেশ আড্ডা জমিয়ে দিলেন। ফার্স্ট নিউজে নিয়মিত লেখার অনুরোধ করলেন এবং ওই দিনই কিছু লেখার বিষয় বলে দিলেন। আমার কাছে বিষয়গুলো বেশ ব্যতিক্রমী মনে হলো। সেই থেকেই তার সঙ্গে টানা প্রায় সাত বছর কাজ করেছি। 

বদরুল ভাইয়ের টানেই নিয়মিত ফার্স্ট নিউজ অফিসে যেতাম। সপ্তাহ অন্তর ব্যতিক্রমী কভার স্টোরি করে তিনি ওই সময়ে আলোচনায় এসেছিলেন। পত্রিকাটি যে কেউ একবার হাতে নিলে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অল্পদিনেই ম্যাগাজিনটি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে তার কারিশমা ছিল। রুচিশীল ম্যাগাজিন হিসেবে পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকরাও ফার্স্ট নিউজে লেখালেখি শুরু করেন। 

তিনি শুধু একজন সম্পাদক ছিলেন না, প্রত্যেক রিপোর্টারের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। যখনই তার রুমে যেতাম- এক ঘণ্টার আগে উঠতে পারতাম না। এমন কোনো বিষয় নেই- যা আলোচনায় স্থান পেতো না। রাজনীতি নিয়েই তার সঙ্গে আলোচনা হতো বেশি। দেশ নিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি সব সময়। সব সময় তিনি রাজনীতির বিষয়ে আপডেট থাকতেন। প্রচুর পড়াশোনাও করতেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকায় লেখকরা মূল্যায়িত না হলেও তার কাছে লেখকরা ছিলেন বেশ সম্মানিত মানুষ। অত্যন্ত প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন তিনি। বছর খানেক আগে নানা কারণে ফার্স্ট নিউজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার লেখালেখি থেমে যায়নি। লেখালেখির প্রতি অত্যন্ত দুর্বল মানুষটি দুবাইয়ের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে মোটা অংকের বেতনের চাকরি নিয়েছিলেন এবং পরে লেখালেখির প্রতি গভীর আবেগের কারণে দেশে ফিরে আসেন। ‘ক্রস টক’ নামে নিয়মিত কলাম লিখতেন ডেইলি স্টারে।

তিনি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কানসাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জে লফ্লিনের সঙ্গে ‘A Strategic Model for Multinational Corporate Social Responsibility in the Third World’ শীর্ষক গবেষণাপত্র তৈরি করেন। ১৯৯২ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত বই ‘In search of a Nation’ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৪ সালে  একই প্রকাশন থেকে ‘A Good Man in the Woods and Other Essays’ প্রকাশিত হয়েছে। ডেইলি স্টারে লিখিত তার কলামগুলোর প্রথম সংগ্রহ এটি।

সমাজ বাস্তবতা ও রাজনীতি তার লেখায় বেশ প্রাঞ্জলভাবে উঠে আসতো। তথাকথিত উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অপরাধ, আইনের শাসন, বৈষম্য, অচলাবস্থা, সহিংসতা, বিদ্বেষ, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতার অভাব বিষয়ে লিখতেন। 

অনেক কিছুর মোহ ছেড়ে যে বদরুল ভাই কলম হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই তার কলম এখন থেমে গেল। ৬০ বছর বয়সে তার জীবনপ্রদীপ হঠাৎ নিভে গেল। হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। তিনি নেই, কিন্তু বহু স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়িত করে। 

২০১৩ সালে আমি ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম ফার্স্ট নিউজের বাল্যবিয়ে নিয়ে একটি কভার স্টোরির জন্য। ওই পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি অফিসে বড় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। একজন লেখককে কীভাবে সম্মান দিতে হয়, তা তিনি জানতেন। 

বদরুল ভাই একজন স্বজ্জন মানুষ, যোগ্য সম্পাদক এবং শক্তিশালী লেখক হিসেবে চিরকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তিনি বয়সে প্রবীণ না হলেও লেখালেখিতে ছিলেন বেশ দক্ষ। তার লেখার কৃতিত্ব, প্রতিভা, অদম্যতা, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা এবং তার কলামে প্রদর্শিত লেখার উচ্চমানের গুণের কারণে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষার ওপর তার দুর্দান্ত দখল ছিল। লেখার স্টাইল ছিল স্মার্ট। আমরা যখন তার প্রসংশা করতাম তখন তিনি মুচকি হাসতেন এবং লজ্জা পেতেন। বয়সে অনেক বড় হলেও তার বিনয় আমাকে মুগ্ধ করত। আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। সারাজীবন একাকিত্বে কাটিয়েছেন। বিয়েও করেননি, চলেছেন স্বাধীনভাবে। নম্র-ভদ্র স্বভাবের এ মানুষটি নির্জন জীবন কাটিয়ে নিঃশব্দেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। জীবনে প্রণয়ঘটিত ট্র্যাজেডি ছিল। ভেতরে অনেক দুঃখ থাকলেও কাউকে বুঝতে দেননি। আমাদের তথাকথিত সমাজের উচ্চবিত্তদের মতো তার জীবন ছিল না। তিনি অত্যন্ত পরিশীলিত এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি ৩০০ পৃষ্ঠার একটি ইংরেজি উপন্যাস লিখেছেন। যেটি পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত হবে। কিন্তু তিনি সেটা দেখে যেতে পারলেন না। অসময়ে  তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আমরা একজন মেধাবী, যোগ্য ও রুচিশীল লেখককে হারালাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //