করোনাভাইরাস মোকাবিলা

বিশেষ জনগোষ্ঠীর কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে

ডিসেম্বর ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের জনবহুল উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। শুরুর দিকে চীনও এর ভয়াবহতা বুঝতে দেরি করায় তা দ্রুত উহান এবং ধীরে ধীরে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩ হাজার চীনা নাগরিক মারা যায় এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। 

তাৎক্ষণিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে চীন দ্রুত সাড়া দেয় এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, চীন পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ভাইরাসটি বিশ্বের প্রায় ১৯৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে; ২৬ মার্চ ২০২০ইং তারিখ পর্যন্ত (সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটার)। করোনাভাইরাস এরই মধ্যে ২৮,৭১৭ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ৬,১৫,৫১৯ জনকে আক্রান্ত করেছে (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, ২৯ মার্চ)। 

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত ৪৮, মৃতের সংখ্যা ৫: (সূত্র:আইইডিসিআর)। বর্তমানে মহাপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আক্রান্তের (ইতোমধ্যে ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে) সংখ্যা রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এই রোগটির নতুন নামকরণ করেন কভিড-১৯। 

বাংলাদেশে ৭ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়। বিশাল জনগোষ্ঠী, ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, সচেতনতার অভাব, বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাব, সমন্বয়হীনতা, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে আসা আমাদেরকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। রোগ বিস্তারের ধরন অনুযায়ী, এখন তা কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকার মধ্যে চলে এসেছে। এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের ধারণা সত্য হলে, বাংলাদেশ এর বড় ধরণের শিকার হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বাংলাদেশকে একই ধরনের হুশিয়ারি দিয়েছে। 

সরকার এ বিষয়ে ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে এবং সম্প্রতি সরকার প্রতিরোধ কার্যক্রম এর গতি বৃদ্ধি করেছে। তারপরও আসন্ন বিপদ ঠেকাতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বিশেষ জনগোষ্ঠী যারা তাদের প্রতিও। বাস্তবতার কারণেই তারা বিশেষভাবে করোনাভাইরাস উদ্ভুত পরিস্থিতির ভয়াবহ শিকার হতে পারেন। 

এখন আমাদের জানতে হবে এই বিশেষ জনগোষ্ঠী কারা? এরা হলো ১. নারী, দরিদ্র নারী ও কিশোরী (বিশেষভাবে দরিদ্র নারী, গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী, গর্ভবতী ও দুই বছরের নিচে শিশুর মা), ২. শিশু (অসহায় ও পথ শিশু, দরিদ্র শিশু ও কর্মজীবী শিশু), ৩. শারিরীকভাবে অসহায় বিশেষ জনগোষ্ঠী (শারিরীকভাবে অন্ধ, অক্ষম, বৃদ্ধ ইত্যাদি), ৪. বিশেষ এলাকার জনগোষ্ঠী (বস্তি, রোহিঙ্গা, হাওড় অঞ্চল, পাহাড়ী অঞ্চল, চা বাগান ও সীমান্তবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠী), ৫. ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ও আচরণে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী (যৌনকর্মী ও তাদের মধ্যস্থতাকারী, মাদকসেবী ও হিজড়া), ৬. মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী এবং ৭. সেবা কর্মী (চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মচারী, সংবাদ কর্মী, পুলিশ, সেনা, নিরাপত্তা কর্মী, করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও সাপ্লাই চেইনের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠী) এবং ৮. জেলখানায় আটক বা শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদি। সামাজিক ক্ষমতা কাঠামো, সামাজিক অবস্থা, জীবন-যাপন পদ্ধতি, আবাসন ব্যবস্থা ও অবস্থান, পেশা, পেশার ঝুঁকি, দরিদ্রাবস্থা, পেশার বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি কারণে উপরোক্ত জনগোষ্ঠীর করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ও এর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। করোনায় কিভাবে আক্রান্ত হয়, এটা আমরা এখন কম-বেশি সবাই জানি, এজন্য এবিষয়ে আলোচনা আর নাই করলাম। তাই, প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিয়ে আলাদাভাবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করতে চাই। 

১. নারী, দরিদ্র নারী ও কিশোরী (বিশেষভাবে দরিদ্র নারী, গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী, গর্ভবতী ও দুই বছরের নিচে শিশুর মা): আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। এদের বড় অংশ আবার প্রজননক্ষম (১৫-৪৯) বয়সের নারী। তারা যে পেশায়ই  থাকুন না কেন, তাদেরকে সন্তানের লালন-পালন করতে হয় ও তারা পরিবারের গৃহস্থ কর্মের নেতৃত্ব দেন। আবার দরিদ্র নারী তার সামাজিক অবস্থানের কারণেই বাড়তি ঝুঁকিতে থাকেন। এই জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ আবার শ্রমঘন পেশা যেমন- গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত আছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, প্রায় ৩ মিলিয়ন বা ততোধিক নারী ও গার্মেন্টস শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকের দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে নারী বা কিশোরী। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই প্রায় বড় সংখ্যার গৃহকর্মী আছেন (যারা গড়ে প্রতিদিন ৩-৪টি পরিবারে কাজ করে থাকেন)। প্রতি বছর লাখ লাখ মা গর্ভধারণ করেন ও সন্তান জন্ম দেন। যাদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী বিশেষ যত্ন, বাড়তি পুষ্টিকর খাবার ও সেবা গ্রহণ আবশ্যিক। এর ব্যত্যয় হলে মা ও শিশুর উপর থাকবে এর জীবনব্যাপী বাড়তি প্রভাব। দুগ্ধদানকালীন সময় অতিক্রম করছে এই ধরনের মায়েরাও রয়েছেন এই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর তালিকায়। 

আবার জনমিতি অনুসারে মোট জনগোষ্ঠীর ১৮% (৩ কোটির উপর) কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স ১০-১৯ বছরের মধ্যে। এদের বড় অংশ বিদ্যালয়গামী অথবা গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী অথবা বেকার। এদের বড় অংশ আবার গ্রামে বসবাস করে। মোট কিশোর-কিশোরীর অর্ধেক আবার কিশোরী। কিশোরীরা সবসময় বাড়তি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বাংলাদেশে একথা আরো বাস্তব। করোনাপূর্ব সময়ে নারীর প্রতি প্রচুর সহিংসতার ঘটনা যা মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের নজরে এসেছে তারই প্রমাণ বহন করে। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়লে অভিভাবকরা চাপমুক্ত হওয়ার জন্য তাদের কন্যাদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দিতে পারেন। যা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এরা সবাই করোনা বিষয়ক সাম্প্রতিক যেসকল গঠনাপ্রবাহ ঘটছে তার শিকার হতে পারেন। তাই, আমাদের বিশেষ করে যারা করোনা পরিস্থিতি সরাসরি মোকাবেলা করছেন - এই জনগোষ্ঠীর কথা মনে রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য উপরোক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে। 

২. শিশু (অসহায় ও পথ শিশু, দরিদ্র শিশু ও কর্মজীবী শিশু): শিশুরা মোট জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ। এরা স্বাভাবিকভাবেই চলমান তথ্য প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনায় থাকবে। দরিদ্র ও অসহায় শিশুর বেলায় এটা আরো জোরালোভাবে প্রযোজ্য। দরিদ্র, অনাথ ও পথ শিশু করোনা আক্রান্ত হলে তার কি করণীয়, সে ব্যাপারে একেবারেই সুবিধাবঞ্চিত থেকে যাবে। তাই, ঐ শিশুর সেবা ছাড়াই মৃত্যুর সম্ভাবনা শতভাগ। আবার কর্মজীবী শিশু কাজে না গেলে তার জীবন চলবে না, আবার সে ঘর হতে বের হলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকবে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় গৃহবন্দী শিশুর যথাযথ বিকল্প ব্যবস্থা নিতে না পারলে, তারাও মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। বাড়িতে যথাযথ বিকল্প সেবা কর্মী না থাকলে কর্মজীবী অভিভাবকদের সন্তানরা পড়বে বাড়তি ঝুঁকিতে। আবার, তাদের মা-বাবা বা তাদের যারা যত্ন নেয় তাদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হলে তারা এ পরিস্থিতির নেতিবাচক শিকার হতে পারে। আবার ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রতি অনেক সময় নেতিবাচক আচরণ করে ফেলতে পারেন। যা শিশুর মনে গভীর রেখাপাত করতে পারে।  

আবার শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদের অভিভাবক ও তাদের যারা যত্ন নেন এমন সদস্যদের আক্রান্ত হয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকবে।  এমতাবস্থায় পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার সময় শিশুযত্ন সহায়িকা, অভিভাবক ও শিশুর সেবা প্রদানকারী পরিবারের সদস্যদের জন্য কাউন্সেলিং সেবার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং শিশুরা কিভাবে এই দীর্ঘ অবসর সময় ভালভাবে অতিক্রম করতে পারে তার জন্য বিকল্প উপায়সমূহ ভেবে দেখতে হবে। নিরাপদ ইনডোর গেমস, হালকা শারীরিক কসরত, জীবনগঠন মূলক বই, বিনোদন, শিশু উপযোগী চলচ্চিত্র ও অন্যান্য কার্যক্রমের কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাছাড়া পথ ও অনাথ শিশুদের রক্ষার জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন- নিরাপদ আশ্রয়, খাবার ও চিকিৎসার সুবিধা ও যত্ন ইত্যাদি।

৩. শারিরীকভাবে অসহায় বিশেষ জনগোষ্ঠী (শারিরীকভাবে অক্ষম, বৃদ্ধ ইত্যাদি): দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ হলো শারিরীকভাবে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ জনগোষ্ঠী এবং বৃদ্ধ বা বয়স্ক নাগরিক। স্বাভাবিকভাবেই তারা মূলধারার সুযোগ-সুবিধা ও তথ্য থেকে বঞ্চিত। এই জনগোষ্ঠীকে তাদের বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের আপনজন, গৃহকর্মী অথবা শুভানুধ্যায়ীদের উপর নির্ভর করতে হয়। করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে তারা আরো বিপদাপন্ন অবস্থার মধ্যে পড়বে, যা তার অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ হবে। অনেককেই নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়, এ মুহুর্তে  বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হাসপাতালে গমন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যা বিশেষ জনগোষ্ঠী ও বৃদ্ধদের জন্য সুখবর নয়। এদের যত্ন নেয় পরিবারের এমন সদস্য অথবা গৃহকর্মী কোনোভাবে  করোনা আক্রান্ত বা অনুপস্থিত থাকলে তাদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের যত্ন, চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদি কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে তা মাথায় রাখতে হবে। তাদের কথা বিবেচনা করে, বিশেষ যোগাযোগ উপকরণ তৈরি করতে হবে। 

৪. বিশেষ এলাকার জনগোষ্ঠী (বস্তি, রোহিঙ্গা, হাওড় অঞ্চল, পাহাড়ী অঞ্চল, চা বাগান ও সীমান্তবর্তী এলাকার জনগোষ্ঠী): মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন নগরে বাস করে। এর বড় একটা অংশ আবার ভাসমান ও বস্তিতে বসবাস করে। বস্তিতে জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিকের পরিবেশের চাইতে অনেক নিচে। ফলে করোনা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোই সেখানে বিদ্যমান না থাকায়, তারা করোনা আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকিতে আছেন এবং বস্তিবাসীদের মধ্যে অপুষ্টি তার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বিধায় তারা সহজেই করোনা আক্রান্ত হতে পারে। বস্তিবাসী নারী ও শিশুদের অবস্থা আরো বিরুপ। 

কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া নিজ দেশ থেকে বিতারিত মিয়ানমারের নাগরিকরা যেভাবে ঘনবসতিপূর্ণ অবস্থায় আশ্রয় ক্যাম্পে বসবাস করেন, তাতে একবার ওখানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে কমিউনিটিতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না। যা থেকে স্থানীয় জনগণও বিপদ থেকে রক্ষা পাবে না। এ অবস্থা যদি সত্যি সত্যিই হয় তার ভয়াবহতা কল্পনাও করা যায় না। পাশাপাশি প্রায় ১১ লাখ আশ্রিত জনগোষ্ঠীর সেবায় নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি সেবাকর্মীরার ঝুঁকিতে পড়ে যাবেন। ফলে তারা চলমান মুলধারার কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। যা মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। 

পাশাপাশি হাওড়, পাহাড় ও চা বাগানে বসবাসরত নাগরিকদের কথাও আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সবচেয়ে ভাল হতো যদি এসময় এসব অঞ্চলে নগর ও প্রবাসীদের আগমনকে ঠেকানো যেত। যা ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এমনিতেই এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেতে এ এলাকার নাগরিকদের অনেক কাঠগড় পোহাতে হয়। জাতীয় জরুরি পরিস্থিতিতে তা আরো দুঃসাধ্য হতে পারে। চা বাগানের ব্যপারে এখনো হয়ত সুযোগ আছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। যেহেতু তারা মূলধারা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এটা এখন তাদের জন্য আর্শীবাদ হয়ে উঠতে পারে। হাওরে এখন ধান উঠার মৌসুম আসছে। এ প্রক্রিয়া ভালভাবে যাতে সম্পন্ন হয় আশা করি প্রশাসন তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। ফলে আসন্ন সংকটে তা হাওরবাসীর জন্য বেঁচে থাকার অন্যতম সহায়ক হবে। 

পাহাড়ে পাহাড়ীদের আস্থায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে পাহাড়ের কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির জন্য সংক্রামক ব্যাধি হাম রুবেলা ছড়িয়ে পড়ার খবর সংবাদপত্রে এসেছে। পাহাড়ের পুষ্টি পরিস্থিতিও নাজুক। তাই পাহাড়ের জন্য বিশেষ পদক্ষেপের দাবি রাখে। যেহেতু করোনা একটা বৈশ্বিক সমস্যা এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও তা ছড়িয়ে পড়েছে, তাই সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নাগরিকরা বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছেন। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদেও প্রায় ৪ হাজার কিমি এর সীমান্ত এবং অনেক কারণে সীমান্ত এলাকার লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত এলাকার সাথে ব্যবসায়িক ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করেন। তা অব্যাহত থাকলে এ সকল এলাকার লোকজন করোনার বিপদে পড়তে পারেন। তাই তাদেরকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার এখনই সময়। তাই উপরোক্ত আলোচনা ও বিপদের কথা বিবেচনা করে এসকল জনগোষ্ঠীর জন্য আশু করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। 

৫. ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ও আচরণে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী (যৌনকর্মী ও তাদের মধ্যস্থতাকারী, মাদকসেবী ও হিজড়া): সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হলো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা ও আচরণে অভ্যস্থ জনগোষ্ঠী যেমন- যৌনকর্মী ও তাদের দালাল, মাদকসেবী এবং হিজড়া সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠী অন্যান্য সংক্রামক রোগ  যেমন - এইচআইভি/এইডস, যৌনবাহিত রোগের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এমনিতেই তারা মূলধারা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ও সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার এবং তাদের মধ্যে যাতে ইতিবাচক ও নিরাপদ আচরণ বাড়ানো যায় তার জন্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে তারা আরো বিপন্ন অবস্থায় পড়বে। যা তাদের বেঁচে থাকার সর্বশেষ প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অনেকে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠতে পারে ও তাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ (যেমন- সুই, সিরিঞ্জ শেয়ারিং ও অনিরাপদ যৌন মিলন) বেড়ে যেতে পারে। ফলে করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। সরকারি ও সেরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এসময় তাদের জন্য চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালু করা দরকার। 

৬. মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী: তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় মাঠ পর্যায়ে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী রাজনৈতিক কর্মী গোষ্ঠী গড়ে উঠে। এরা মূলত: স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে জীবন নির্বাহ করে থাকে।  যেমন- রাস্তার বা ফুটপাতের পাশে গড়ে উঠা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। আবার তারা সভা-সমাবেশে লোক সমাগম বা অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করতে সহায়তা করে থাকে। করোনা পরিস্থিতির কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে যাওয়া এভাবে জীবন যাপনকারী জনগোষ্ঠী বিপদে পড়তে পারে। দীর্ঘসময় ধরে লকডাউন চললে এরা ও এদের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়বে। এর প্রভাব হতে পারে বহুমাত্রিক।

৭. সেবা কর্মী: চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মচারী, সংবাদকর্মী, পুলিশ, সেনা, নিরাপত্তাকর্মী, করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী, পরিবহনকর্মী, ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও সাপ্লাই চেইনের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠী ও আরো অনেক পেশার লোক এ দলের মধ্যে পরে। বৈশ্বিক প্রতিবেদন থেকে আমরা ধারণা পাচ্ছি, করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা এবং এদের মধ্যে আক্রান্তের হার উল্লেখ করার মতো। ইতোমধ্যে অনেক চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ও মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি উন্নত দেশেও সকল প্রকার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ব্যবহার নিশ্চিত করেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। তাই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা খাত যথেষ্ট সুসংগঠিত না এবং এ ধরণের জনস্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত না, সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। 

সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা ইতোমধ্যে করোনা রোগীর সেবা প্রদান ও সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই চিকিৎসক ও নার্সদের সুরক্ষার কথা বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাবতে হবে। পিপিই সামগ্রী সরবরাহের পাশাপাশি তাদের মানসিক সুস্থিরতা বজায় রাখার জন্যে কাউন্সেলিং ও বীমা কর্মসূচি চালুর ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা খাতের সাথে জড়িত অন্যান্য কর্মচারীর সুরক্ষা বিধানও যথেষ্ট জরুরি এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী যথাযথভাবে ব্যবহার সংক্রান্ত গাইডলাইন যাতে তারা যথাযথভাবে অনুসরণ করে তারও মনিটরিং করতে হবে।

সংবাদকর্মী, পুলিশ, সেনা, নিরাপত্তা কর্মী, করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী, গণপরিবহন কর্মী, সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও সাপ্লাই চেইনের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠী ও আরো অনেক পেশার লোক যারা কমবেশি সেবা খাতের সাথে জড়িত তাদের সুরক্ষার কথাও আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয়  সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি তাদের উদ্দীপনা ধরে রাখার জন্য তাদের কাজের স্বীকৃতি, ঝুঁকি ভাতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মানসিক চাপ উত্তরণে আমাদের সব প্রচেষ্টা উজার করে দিতে হবে। জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সাথে জড়িত বিপুল মানব সম্পদের মনোবল ধরে রাখাও এসময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন করোনা মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে নানান অনেক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন। তাদের কার্যক্রম উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি তারা যাতে কোনোভাবে হয়রানির স্বীকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর জন্য একটি সমন্বয় সেল গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগটি নিতে পারেন। এসময়ে মানসিকভাবে চাপে থাকা এসকল সাহসী স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের পরিবারের জন্য কাউন্সেলিং সেবা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।   

 ৮. জেলখানায় আটক বা শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদ: লাখ লাখ কয়েদী জেলখানায় আটক আছেন বা শাস্তি ভোগ করছেন। যেকোনো সংক্রামক ব্যধি বিস্তারের জন্য জেলখানার পরিবেশ যথেষ্ট উপযোগী।  তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভাল উপায় আমাদের সন্ধান করতে হবে এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য। যারা ইতোমধ্যে সাজার বেশি অংশ ভোগ করেছেন, তাদের বিশেষ ক্ষমতাবলে বাকি শাস্তির মেয়াদ মাফ করে দেয়া যেতে পারে। আবার যারা জামিনযোগ্য অপরাধ করেছেন, তাদের জামিন দেয়া যেতে পারে। তবে সবক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমরা মহান বরফ খণ্ডের উপরাংশের অংশটুকু মাত্র দেখতে পাচ্ছি। এর মূল অংশ গভীর সাগরের নীল পানির নিচে, এর অস্তিত্ব কত গভীর আমরা জানি না। তেমনি করোনা প্রাদুর্ভাবের আমরা শুরুটা দেখছি, এই বিপর্যয় কত মারাত্মক হতে পারে তা হয়ত আমাদের কল্পনা শক্তির অনেক বাইরে। 

আসুন, সর্বোচ্চ ও দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করি। পরিশেষে এই প্রত্যাশাও করি, আমাদের ধারণা যেন ভুল প্রমাণিত হয় ও সহজেই  যেন এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই। 

লেখক: উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী

[email protected] 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //